পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন গ্রিন সিটি আবাসন পল্লীর ভবনের আসবাবসহ অন্যান্য মালামাল কেনা ও তা উঠানোর কাজে ৬২ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকার অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে জড়িত আছেন ৩৪ জন প্রকৌশলী।
রোববার বিচারপতি বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদীর হাইকোর্ট বেঞ্চে দাখিল করা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দুই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।
এমন অনিয়মের তথ্য পেয়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘যেহেতু তদন্ত প্রতিবেদনে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে; তাই আমরা একটু অপেক্ষা করে দেখতে চাই কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
আজ আদালতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারে আমাতুল করিম। আর রিটকারী পক্ষে ছিলেন সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম উপস্থিত ছিলেন।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রূপপুর গ্রিন সিটি প্রকল্প’র নির্মাণাধীন ভবনের আসবাব ও প্রয়োজনীয় মালামাল কেনা ও উঠানোর কাজে ৬২ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকার অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী চারটি ভবনের আসবাবপত্র ও ইলেকট্রিক অ্যাপ্লায়েন্স সরবরাহ কাজের জন্য ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ৯ হাজার টাকা বেশি পরিশোধ করা হয়েছে।
মোট ৬টি পর্যায়ে ৫৩ জন কর্মকর্তার নাম প্রতিবেদনে আসেলেও একই কর্মকর্তা একাধিক দায়িত্ব পালনের কারণে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ৩৪ জন প্রকৌশলীকে এই দুর্নীতির জন্য দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি।
এছাড়াও তদন্ত প্রতিবেদনে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এবং অতিরিক্ত পরিশোধিত অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও সুপারিশ করা হয়েছে।
রোববার আদালতে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন উস্থাপনের পর রিটকারী আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন প্রতিবেদন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা নয়, দায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা চান।
তখন আদালত বলেন, ‘যেহেতু দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে তাই আমরা একটু অপেক্ষা করে দেখতে চাই কী ব্যবস্থা নেয়।’
এসময় আদালত দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে সময় দেওয়া প্রয়োজন। তাই এক্ষেত্রে দুই মাস সময় অন্তত দেওয়া হোক।
এরপর আদালত আগামী ২০ অক্টোবর এবিষয় পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য নির্মাণাধীন গ্রিন সিটি আবাসন পল্লীর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা ও তা ভবনে তোলায় অনিয়ম নিয়ে গত ১৬ মে দৈনিক দেশ রূপান্তর ‘কেনা-তোলায় এত ঝাঁজ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের থাকার জন্য গ্রিন সিটি আবাসন পল্লীতে ২০ তলা ১১টি ও ১৬ তলা আটটি ভবন হচ্ছে। এরই মধ্যে ২০ তলা আটটি ও ১৬ তলা একটি ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।
২০ তলা ভবনের প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর ভবনে বালিশ ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। প্রতিটি রেফ্রিজারেটর কেনার খরচ দেখানো হয়েছে ৯৪ হাজার ২৫০ টাকা। রেফ্রিজারেটর ভবনে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ৫২১ টাকা। একেকটি খাট কেনা দেখানো হয়েছে ৪৩ হাজার ৩৫৭ টাকা। আর খাট ওপরে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ হাজার ৭৭৩ টাকা।
প্রতিটি টেলিভিশন কেনায় খরচ দেখানো হয়েছে ৮৬ হাজার ৯৭০ টাকা। আর টেলিভিশন ওপরে ওঠাতে দেখানো হয়েছে ৭ হাজার ৬৩৮ টাকার খরচ। বিছানার খরচ ৫ হাজার ৯৮৬ টাকা দেখানো হয়েছে; তা ভবনে তুলতে খরচ দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা। প্রতিটি ওয়ারড্রোব কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫৯ হাজার ৮৫৮ টাকা। আর তা ওঠাতে দেখানো হয়েছে ১৭ হাজার ৪৯৯ টাকার খরচ।
এরকম বৈদ্যুতিক চুলা, বৈদ্যুতিক কেটলি, রুম পরিষ্কারের মেশিন, ইলেকট্রিক আয়রন, মাইক্রোওয়েভ ইত্যাদি কেনাকাটা ও ভবনে তুলতে এরকম অস্বাভাবিক খরচ দেখানোর প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন পত্রিকার প্রতিবেদনটি যুক্ত করে জনস্বার্থে হাইকোর্টে একটি রিট করেন।
এরপর হাইকোর্ট এ বিষয়ে রুল জারি করে এবং এ ঘটনা তদন্তে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের করা দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের করা দুটি তদন্ত প্রতিবেদন রোববার হাইকোর্টে উপস্থাপন করা হয়।