চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

রুশ বিমান ভূপাতিত, বিশ্ব রাজনীতিতে ঝড়ের আভাস

রুশ যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করার পর বিশ্ব রাজনীতিতে আরো ঝড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।এর ফলে সিরিয়ায় বিশ্বের দুই প্রতিদ্বন্দ্বি পরাশক্তির মধ্যে উদ্বেগ বহুগুণে বেড়ে গেছে।

যুদ্ধবিমানকে ভূপাতিত করার পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এর তীব্র নিন্দা করে বলেছেন ‘সন্ত্রাসীদের সহযোগিরা আমাদের পিঠে ছুরি মেরেছে’। আর এই ঘটনার পর ন্যাটো ও ‍যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের পাশে পেয়েছে তুরস্ক। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত।

বারবার সতর্কবার্তা পাঠানোর পরও রুশ বিমানটি তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে নিজেদের ভূমি ও আকাশসীমা রক্ষার চেষ্টা হিসেবে তারা গুলি চালায় বলে দাবি করেছে তুরস্ক। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, রুশ বিমানটি সিরিয়ার আকাশসীমার মধ্যেই ছিলো।

মস্কো বলছে, তাদের বিমানটি সিরিয়ার আকাশসীমার বাইরে কখনোই যায়নি এবং তুরস্কের আকাশসীমায় ঢোকেনি। তারা তা প্রমাণ করতে পারবে। এটাকে সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ‘ঘোর আগ্রাসন’ বলে উল্লেখ করেছে মস্কো।

ক্রেমলিনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটি একটি অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা। রাশিয়া আরো বলছে, বিমানটিকে গুলি করা হয়েছে আকাশ থেকে নয়, বরং মাটি থেকে।

ন্যাটোর পাশাপাশি তুরস্কের দাবিকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রও। তুরস্কের আহ্বানেরে পর রাতেই এক জরুরি বৈঠক করে ন্যাটো। বৈঠক শেষে, সংস্থাটি তুরস্কের আত্মরক্ষার দাবিকে গ্রহণযোগ্য বলে বর্ণনা করে এবং দেশটির পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার জানিয়েছে।

বিমান ভূপাতিতের পর ন্যাটোর মতো তুরস্কের পাশে দাঁড়িয়েছে ইউরোপিয় ইউনিয়নও। এদিনই তুরস্কে থাকা শরণার্থীদের জন্য ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দেয় সংস্থাটি।

ন্যাটো মহাসচিব জেন্স স্টেলোনবার্গের পর পরিস্থিতি আর ঘোলাটে না করতে দুদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলছেন, ‘আর সব দেশের মতো তুরস্কের নিজেদের আকাশসীমা ও ভূমি রক্ষা করার অধিকার আছে।’

কিন্তু রাশিয়া বলছে, তাদের বিমানটি তুর্কি আকাশসীমায় ঢোকেনি আর তুরস্কও কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি। এই হামলার জন্য তুরস্ককে গুরুতর পরিণতি ভোগ করতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাশিয়া। আঙ্কারাকে ‘সন্ত্রাসের সহযোগি’ উল্লেখ করে তুরস্কের সঙ্গে সবধরনের সামরিক সম্পর্ক স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন পুতিন।

১৩ নভেম্বর প্যারিসে হামলা পর জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পশ্চিমা জোটের সঙ্গে রাশিয়ার নতুন সম্পর্কের যে সামান্য সুবাতাস বইছিলো বিমান ভূপাতিতের ঘটনা সেই সম্পর্কে জোর ধাক্কা খাবে। প্যারিস হামলার পরে আলোচনার কেন্দ্রে আইএস দমন এলেও এখন পশ্চিমী নজরে নিজেকে উপরে তুলতে পারেননি আসাদ।

অন্য দিকে, আসাদকে নতুন সিরিয়ায় কোনো একটি ভূমিকায় রেখে দেয়া নিয়ে অনড় রাশিয়া। তুরস্কের অভিযোগ, তাই এদিনও উত্তর সিরিয়ার দিকে গিয়েছিল রাশিয়ার যুদ্ধবিমান।

রাশিয়া প্রথম যখন সিরিয়া যুদ্ধে জড়ায় তখন প্রশ্ন তুলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেছিলেন, ‘আমাদের সিরিয়ার সঙ্গে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, রাশিয়া এখানে কী করছে?’

তিক্ততা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। শুরু হয়েছিলো শঙ্কারও। রুশ যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামানোর মধ্যে দিয়ে সেই শঙ্কাই সত্য প্রমাণ করলো। বিমান ভূপাতিত করার পর দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় আঙ্কারার রুশ রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তুরস্ক।

বাসার আল-আসাদ সরকারকে সমর্থন করে সিরিয়া বিমান হামলার শুরু পর এই প্রথম রুশ বিমান গুলি করে ভূপাতিত করার ঘটনা ঘটলো। এর আগে সিরিয়ার আকাশ সীমায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিমানের সঙ্গে বেশ কয়েক মুখোমুখি সংঘর্ষের উপক্রম হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

এর আগে আইএসের কাছ থেকে তেল কেনা এবং এই মাধ্যমে জঙ্গিদের আর্থিক সাহায্য করার জন্য তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন পুতিন। আর ঘটনার পর জরুরি ভিত্তিতে তুরস্ক সফর বাতিল করেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ। পুতিনের পেছন থেকে ছুড়ি মারার কথা পুনরাবৃত্তি করে ল্যাভরভ বলেছেন, এই দুঃখজনক ঘটনা রাশিয়া-তুরস্ক সম্পর্কের পরিণতি গুরুতর হতে পারে।

ক্ষুব্ধ ল্যাভরভ তুরস্ককে মিশরের সঙ্গে তুলনা করতেও ছাড়েননি। নিজ দেশের নাগরিকদের তুরস্ক সফরের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন তিনি। এটা তুর্কি পর্যটনকে চাপে ফেলার একটি কৌশলও। তুরস্ককে মিশরের সঙ্গে তুলনা করে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিনাইতে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ২২৪ জন নিহত হয়েছিলো সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, তুরস্কের এই ঘটনা সিনাই ঘটনার চেয়ে কোনো অংশেই কম না।

বিমান ভূপাতিত করার পর রাশিয়ান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রুডস্কি হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘ভয়ংকর পরিণতির’ জন্য রাশিয়া ভূমধ্যসাগরের লাটাকিয়ায় মিসাইল স্থাপনের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের জন্য সম্ভাব্য হুমকি হতে পারে এমন সব লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করা হবে।

আগে থেকে মতোবিরোধ থাকায় প্যারিস হামলার পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ও আমেরিকার লক্ষ্য ছিলো আক্রমণের মুখ আইএসের দিকেই ঘুরিয়ে দেয়া। কিন্তু রাশিয়া যে এবার বেঁকে বসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এই ঘটনার পর তুরস্কের উপরে প্রত্যাঘাতের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে এতোদিন পেছনে থাকলেও (অস্ত্র ও আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করলেও) এবার তুরস্ককে সম্মুখ সমরে আসতে হবে। তুরস্কের সামরিক শক্তি নিয়ে শঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সেক্ষেত্রে সমাধানের পথ থেকে সিরিয়ার সমস্যা আরও জটিলতার দিকে সরে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।