চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের পাঁচ দশক

‘আমরা কোনো দেশের ভূখণ্ড দখলে নিতে চাই না’ – ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান এবং এ ভূখণ্ডে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার চূড়ান্ত অভিযানে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত প্রকাশের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ ঘোষণা ছিল অপরিসীম তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কিন গবেষক-লেখক গ্যারি জে ব্যস ‘দি ব্লাড টেলিগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন ভারতের স্বীকৃতির গুরুত্ব কেবল ক্ষমতার শূূন্যতা পূরণ কিংবা মুক্ত ভূখণ্ডে বিশৃঙ্খলারোধ অথবা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার মধ্যে সীমিত করে দেখলে চলে না। মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যৌথ কমান্ড গঠন করে বাংলাদেশ ভূখ- হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করার অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের উচ্চ পর্যায় থেকে বার বার স্পষ্ট করে দেওয়া হয়, এই স্বীকৃতির মাধ্যমে একটি বার্তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, আমরা ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে নতুন কোনো ভূখণ্ড যুক্ত করতে চাই না কিংবা কোনো ভূখণ্ড দখলও করতে চাই না। [দি ব্লাড টেলিগ্রাম, পৃষ্ঠা ২৮২]

আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের কথা স্মরণ করতে পারি। যুদ্ধ অবসানের ৭৬ বছর পরও জার্মানি ও জাপানে আমেরিকান সৈন্য রয়ে গেছে। ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মুক্তিদাতা হিসেবে প্রবেশ করেছিল, বিজয়ী শক্তি হিসেবে নয়। দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র মিলিতভাবে গঠন করেছিল যৌথ বাহিনী। এ কারণেই ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের এক সপ্তাহ আগেই সকল ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের মাটি ত্যাগ করে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ বা এশিয়ায় এটা করেনি বা করতে চায়নি। কারণ ‘In Germany and in Japan, the Americans who came into their countries did not arrive as liberators but as conquerors.’

গ্যারি জে ব্যস লিখেছেন, চীনের পক্ষ থেকে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে বলা হচ্ছিল, ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে নিজের দখলে নিতে চায়। বাস্তবে এমনটি ঘটেনি। কারণ বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা চেয়েছে এবং ভারতের জনগণ আমাদের এ এ আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। কেন ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে এ বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী ৬ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পেছনে জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই স্বাধীনতার পেছনে সে দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন আমরা দেখি।

দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্ণ হওয়ার দিন ৬ ডিসেম্বর। অনেকেই বলেন, রক্তের বন্ধন দুই দেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তি। বাংলাদেশকে পাকিস্তনি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করতে গিয়ে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছে। অনেকে আহত হয়েছে। সে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ও ভারতীয় সৈন্যদের লড়াই করতে হয়েছে, যার কারণও ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি ভারতের সমর্থন। ২৫ মার্চ গণহত্যা অভিযান শুরুর পর ভারত সরকার ও জনগণ যদি বাংলাদেশের পাশে না দাঁড়াত হলে আরও কত বাঙালিকে প্রাণ দিতে হতো, ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। পাকিস্তানি শাসকরা মানুষ চায়নি, সম্পদ চায়নি। এই বর্বর শাসকরা কসাই হিসেবে পরিচিত টিক্কা খানকে কেবল গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর পদেও বসিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে সচেষ্ট হয়। কিন্তু প্রথম স্বীকৃতি আসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। ভারত ও ভুটান কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ততদিনে বাংলাদেশ ভূখ-ের বেশিরভাগ মুক্ত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ নিয়েছিল। কিন্তু ভারত ও ভুটান ব্যতিরেকে কোনো দেশই ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আগে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। রাশিয়া স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে, ব্রিটেন ফেব্রুয়ারিতে এবং যুক্তরাষ্ট্র এপ্রিলে। চীন ও সৌদি আরবের স্বীকৃতি মিলেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটার পর। কেউ কেউ তর্কে মাতেন, ভারত না ভুটান কে আগে স্বীকৃতি দিয়েছিল? মনে রাখতে হবে ভারত তখনও বড় শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়িয়েছিল সর্বশক্তি দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া একটি কোটি নারী-পুরুষ-শিশুকে আশ্রয় দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জিত করেছিল। রণাঙ্গণে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য হতাহত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ইন্দিরা গান্ধী ও অন্য নেতারা বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক অভিযান পরিচালনা করেছিল। তাদের স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জোরদার হয়েছে।

ভারত বিবেচনায় নিয়েছিল- বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি বাস্তব সত্ত্বা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রায় সমগ্র ভূখণ্ড। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনগণ বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়েছিল। এটাও ভারতের বিচেনায় ছিল যে বাংলাদেশ নেতৃত্ব পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। ২৫ মার্চ ভয়ঙ্কর গণহত্যা শুরুর দুই সপ্তাহের মধ্যে সরকার গঠিত হয় এবং তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই বাংলাদেশ ভূখ-ে শপথ অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। আমাদের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত ছিল পূর্ব নির্ধারিত। বাংলাদেশের সংগ্রাম ছিল গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ। কিন্তু ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তাৎক্ষণিক তা সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনামতো জনগণ ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা’ করতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই হাজার হাজার তরুণ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয় এবং প্রশিক্ষণ শেষে সশস্ত্র যোদ্ধা হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ সরকার মাত্র দুই মাসের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্র, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে, যার শিল্পী-কলাকুশলী সকলেই ছিল বালাদেশের নাগরিক।

বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্পষ্ট করতে পারে। কলিকাতা, দিল্লি ও লন্ডনে বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বিশ্বজনমত পক্ষে আনায় কার্যকর ভূমিকা রাখেন। এমনকি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনেও বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল উপস্থিত হয়ে প্রচার চালায়।

রণাঙ্গনে সর্বোচ্চ মাত্রায় সক্রিয় থেকেও বাংলাদেশ সরকার মুক্ত ভূখ-ে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখায় সক্রিয় ছিল। এ সময় পরিকল্পনা সেল গঠিত হয়, যার সদস্যরা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ হাতে নিয়েছিলেন।

আমরা জানি ‘For any state to enjoy the rights, duties and obligations of international law and to be a member of the international community, recognition of the entity as a state is very important. Only after recognition of the entity as a state, it becomes acknowledged by other states who are a member of the International Community.’

ভারত যখন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পদান করে, তার কয়েকদিনের মধ্যে সে সময়ের বিশ্বের প্রবল ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে পারমাণবিক অস্ত্রসহ সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করে। এ নৌবহর চট্টগ্রামের কাছে চলে এসছিল, যাদের বোমারু বিমান, ক্ষেপনাস্ত্র ও কামানের পাল্লায় ছিল বাংলাদেশ ভূখ-। চীনও পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে সামরিক অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে যে মৈত্রী চুক্তি হয়েছিল তার শর্ত অনুসারে এক দেশ তৃতীয় কোনো দেশের সামরিক আক্রমণের শিকার হলে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর কিংবা চীনা সৈন্য সামরিক অভিযান চালালে সে সময়ের বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার সমর্থন ভারত পেত। বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করার অভিযানে ভারত-রাশিয়া চুক্তির সুফল আমরা ভোগ করেছি।

প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেক সমস্যা থাকে। চীনের সঙ্গে তার প্রায় সব প্রতিবেশীদের স্থল বা সমুদ্র সীমা নিয়ে বিরোধ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেক্সিকোর বিরোধ আছে। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের বিরোধ আছে। ইরান-ইরাক যুদ্ধ করেছে। সৌদি আরব-ইয়েমেন বিরোধে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যেও বিরোধের ইস্যু রয়েছে। কিন্তু পাঁচ দশকের কূটনৈতিক সম্পর্কে ইতিহাসে দুটি দেশ অনেক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে। সীমান্ত কিংবা সমুদ্র সীমা নিয়ে জট কেটেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদনি করে। তারপরেই রয়েছে ভারত। কিন্তু চীনে বাংলাদেশ যত পণ্য রফতানি করে, তার চেয়ে বেশি করে ভারতে। পদ্মা সেতু চালু হলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়বে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর-কেন্দ্রিক সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এক সময় কেবল উন্নত দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রত্যাশী ছিল। এখন ভারতীয় বিনিয়োগও সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরাও ভারতকে পুঁজি খাটানোর জন্য বিবেচনা করছে। বাংলাদেশ ও ভারত একাত্তরের চেতনার পথ ধরে চলতে থাকলে বন্ধন জোরদার হবে, সন্দেহ নেই। এ পথে বাধা এলে সেটা অপসারণের পথও ওই একাত্তরের চেতনা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)