রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কৌতুককর বক্তব্য আজ দেশবিদেশে আলোচিত হচ্ছে। তার বক্তব্যে দর্শক গ্যালারির সকলেই হাসেন। মানুষকে হাসায় কৌতুক অভিনেতারা। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে হাস্যরসের পাশাপাশি কিছু সামাজিক বাস্তবতা ও নিজের স্ববিরোধিতাও উঠে এসেছে। সারাজীবন রাজনীতি বিযুক্ত থেকে রাজনীতিতে একটা সময়ে উড়ে এসে জুড়ে বসা ব্যক্তিদের নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, ‘যদি রাজনীতি করতে চান তবে লেখাপড়া শেষ করে অন্য কোনো চাকরি না নিয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ুন। আগে হাতেখড়ি ছাড়া রাতারাতি রাজনীতিবিদ হওয়া ঠিক নয়। যারা তরুণ বয়স থেকে রাজনীতি করবেন, রাজনীতিতে তাদেরই অগ্রাধিকার থাকা উচিত।’
তার এই বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের এলাকার ফজলুর রহমান খান ও অজয় কর খোকনের কথা মনে পড়ল। রাষ্ট্রপতির প্রত্যাশিত তরুণ বয়স হতেই তারা রাজনীতি শুরু করেছিলেন। তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। কিন্তু দুজনের একজন রাষ্ট্রপতির আশীর্বাদ না পেয়ে আওয়ামী লীগে প্রত্যাশিত জায়গা না পেয়ে চলে গেলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগে ও এরপর বিএনপিতে। আরেকজন অজয় কর খোকন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের আশীর্বাদ না পেয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেন না।
তিনি হাস্যরসাত্বক বক্তৃতা বিবৃতিতে হয়তো পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রপতিকেই ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি কিশোরগঞ্জের সংবর্ধনায় নিজের স্ত্রীকে নিয়েও রসিকতা করেছেন। সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়: প্রিয়াঙ্কা ১০ বছর নিচে নামলে ৩০ বছরের উপরে কী সমস্যা: রাষ্ট্রপতি
বলিউড অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে নিয়ে কৌতুক করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন: বিয়ের ক্ষেত্রে প্রিয়াঙ্কা ১০ বছরের নিচে নামলে ৩০ বছরের উপরে উঠতে কী সমস্যা?
শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘কিছুদিন আগে প্রিয়াঙ্কা দেশে এসেছিল। বাংলাদেশে দেশের বাইরে থেকে যতো রাষ্ট্রপতি গণ্যমান্য ব্যক্তি আসেন তাদের সবাই শেষ দেখা করতে আসেন গণভবনে। প্রিয়াঙ্কা যেদিন আসবে তার আগের দিন আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম এবার তো প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আসবে।’
‘তারপর আর প্রিয়াঙ্কা আসলো না। পরে জানতে পারলাম, আমার স্ত্রী নাকি টেলিফোন করে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছে, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার আসার কী দরকার। তার আসার দরকার নাই।’
তিনি বলেন: ‘আমাদের এখান থেকে যাওয়ার কিছুদিন পরই জানতে পারলাম প্রিয়াঙ্কা নাকি আমেরিকা গিয়ে তার চেয়ে বয়সে ১২ বছরের ছোট এক ছেলেকে বিয়ে করেছে। এখন আমার কথা হলো। সে যদি ১০ বছর নিচে নামতে পারে তাহলে ৩০ বছরের উপরে উঠতে সমস্যা কী। এ ধরনের সুযোগ সে যদি এখানেই পেয়ে যেতো, তাহলে তো তাকে সুদূর আমেরিকা যেতে হতো না।’
রাষ্ট্রপতি বলেন: ‘সংসদে প্রধানমন্ত্রী যখন নারী নির্যাতন বিল পাশ করেন তখন প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, পুরুষ নির্যাতন বিল দরকার। প্রধানমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, এই মুহূর্তে এটা দরকার নাই। পরে দেখা যাবে। ৬ বছর পার হয়েছে এখনো কিছু হয়নি। আসলে সারা বিশ্বের নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী পুরুষরা এটা টের পাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের ভাষণের সময় তিনি বলেন, ‘প্রেমপত্র লেখার চর্চাটা রাখেন তাহলে সাহিত্যটা বেঁচে থাকবে। কলেজে পড়ার সময় আমরা প্রেমপত্র লিখেছি। অনেক সময় বন্ধুদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে লিখতাম। কত সুন্দর সুন্দর কোটেশন ব্যবহার করে প্রেমপত্র লেখা যায় সেই চেষ্টা করতাম। আর এখনতো কেউ আর প্রেমপত্র লেখে না। প্রেমপত্র লেখার ও দরকার হয় না। এখন তো চিঠি লেখা খুব সহজ। বাংলা-ইংরেজি দিয়ে ইংরেজি-বাংলা দিয়ে লেখা হয় মোবাইলে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কিছুটা কৌতুকের ছলে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমিও মোবাইল ব্যবহার করি। কিন্তু একটা টিপ দিয়ে খালি রিসিভ করতে পারি। অার নম্বর টিপে টিপে কল করতে পারি। আমি ব্যাকডেটেড। এর বাইরে মোবাইলে আর কিছু পারি না।’
রাষ্ট্রপতিকে যদি এক্ষেত্রে বাংলার ১৬ কোটি মানুষ অনুসরণ করে কি হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের? এসব কথা বলে মূলত তিনি কি বুঝাতে চান? মানুষের সঙ্গে যারা ব্যাডাগিরি দেখায় তাদের মনোনয়ন না দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ লুটেপুটে খায় এমন প্রার্থীদের বর্জন করে ভালো মানুষকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে হবে৷ এই ব্যাডাগিরি কথাটা কি না বললে হতো না? তিনি নেত্রকোনায় এলেন আশপাশের উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুত না দিয়ে সব বিদ্যুত এখানে দেয়া হলো। সারা শহর সাজানো হলো৷ এসব করা থেকে বিরত থাকার জন্য কি তিনি আহবান জানিয়েছেন? তিনি কি এটাকে উপভোগ করেননি? এটাও কি ক্ষমতার ব্যাডাগিরি নয়?
বিগত ইউপি নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের এলাকায় দুটি ইউনিয়নে কাউকে নৌকা মার্কাই দেয়া হয়নি৷ কারণ এই দুই ইউনিয়নে রাষ্ট্রপতির সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তি দলীয় মনোনয়ন পায়নি৷ এ নিয়ে তৎকালীন সময়ে একটি লেখার শিরোনাম ছিল, দেশ জুড়ে বিদ্রোহী বহিস্কার রাষ্ট্রপতির এলাকায় নৌকা বহিষ্কার। এটাকে ক্ষমতার ব্যাডাগিরি বললে কি অযৌক্তিক হবে? প্রিয়াঙ্কাকে গণভবনে কেন যেতে নিষেধ করলেন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী? তবে কি তার স্বামীর প্রতি আত্মবিশ্বাস নেই? এই আগমন ঠেকাতে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করলেন তিনি সুতরাং বিষয়টা অগুরুত্বপূর্ণ নয়৷ আর যদি সেটা স্রেফ রসিকতা হয়ে থাকে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীকে ফোন না দিয়ে থাকেন এমন রসিকতা কি ঠিক? রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মহামান্য জনেরা এমন স্থূল বিষয় নিয়ে ফোনাফোনি করেন এতে কি এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়না?
৬ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে পুরুষ নির্যাতন আইন পাশ হলোনা বলে এজন্য তিনি দায়ীও করেছেন প্রধানমন্ত্রীকে৷ কেন এই আইনটি হলোনা? পৃথিবীর কোন দেশে পুরুষ নির্যাতন বিরোধী আইন রয়েছে৷ আর বাংলাদেশের কোথায় কোন পুরুষ নির্যাতিত হয়েছে ও কিভাবে নির্যাতিত হয়েছে? আদৌ কি পুরুষ নির্যাতন বিরোধী বিল পাশ হওয়ার বাস্তবতা কি আছে? তাহলে এই অবাস্তব দাবির যুক্তি কী? বহু আগে ফেনীর সাংসদ জয়নাল হাজারী সংসদে পুরুষ নির্যাতন বিরোধী আইন পাশের দাবি করেছিলেন৷ রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের এই দাবি বাস্তবায়িত হবে কি কোনোদিন? রাষ্ট্রপতির যারা ব্যাডাগিরি করে তাদের মনোনয়ন নয় বক্তব্যকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলই সমর্থন করেছে৷ সংবাদপত্রে লিখেছে, রাষ্ট্রপতির পরামর্শ আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই মেনে নিলেন৷
তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে হাইব্রিড কিংবা উড়ে এসে জুড়ে বসাদের কারণে দেশের মানুষ তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়। ভবিষ্যতে যেন এমন কেউ জনপ্রতিনিধি না হয় সেদিকে সবাইকেই লক্ষ্য রাখতে হবে। হাইব্রিড কি সরকারি দলে আসে না বিরোধী দলে আসে? ব্যাডাগিরি ক্ষমতার ব্যাডাগিরি নয় কি? এক যুগ ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে৷ এসময় ক্ষমতায় ছিল ওয়ান ইলেভেন ও আওয়ামী লীগ৷ তিনি বলেছেন সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দ যারা লুটেপুটে খায় তাদের মনোনয়ন না দেয়ার জন্য৷ তার এই কথাটা কি আওয়ামী লীগের দিকেই যায়না? উন্নয়ন বরাদ্দ লুটপাটে সরকারের ব্যর্থতার দিকই কি ফুটে উঠলো না? আর সত্যিকার অর্থেই কি এসব মনোনয়ন ঠেকানো যাবে? রাষ্ট্রপতির পরামর্শ মানতে সম্মতিতে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা ও বিএনপির হাততালির দিকই যে ফুটে উঠল এটা বললে কি বেশি অবান্তর কথা বলা হয়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)