ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান থেকে এক বিদেশি রাষ্ট্রদূতের হাতব্যাগ চুরির এক ঘটনা উঠেছে। সামান্য এক হাতব্যাগ চুরির ঘটনা ঘটেছে ভেবে এটাকে হালকাভাবে দেখার অবকাশ নেই। কারণ এর সঙ্গে আমাদের ইজ্জত ও বিদেশিদের প্রতি প্রদত্ত ও প্রদেয় নিরাপত্তার ব্যাপারটি জড়িত।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত সোমবার (২১ নভেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘ফ্রিডম’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত লিওনি মার্গারেথা কুয়েলিনারির হাতব্যাগ চুরি যায়। কাউন্টার ফটো নামের একটি আলোকচিত্র সংগঠন নিজেদের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেশি-বিদেশি ১০ জন তরুণ আলোকচিত্রীর তোলা ছবি নিয়ে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এ ঘটনায় তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই রাষ্ট্রদূতের কান্নাজড়িত অভিব্যক্তি ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে।
হাতব্যাগ রাষ্ট্রদূতের সাথেই ছিল, কিন্তু মঞ্চে মোমবাতি জ্বালাতে যাওয়ার সময় ব্যাগটি চেয়ারের ওপর রেখে যান এবং তখনই লজ্জাজনক এ ঘটনা ঘটে। ফলে ধারণা করাই যায়, হুট করে কেউ এমন সাহস করেনি, হয়ত অনেকক্ষণ ধরে সে বিষয়ে মানসিক ও কৌশলগতভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রাষ্ট্রদূতের চুরি যাওয়া হাতব্যাগে তার আইপ্যাড, মোবাইল ফোন, ব্যাংকের কার্ড, বাসার চাবি এবং প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত জরুরি কাগজপত্র ছিল বলে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজক কাউন্টার ফটোর অধ্যক্ষ সাইফুল হকের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম।
রাষ্ট্রদূতের এ ব্যাগে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল স্বাভাবিকভাবে। আর প্রয়োজনীয় কিছু না থাকলেও সেটা অনেক বড় ঘটনা। একে সাধারণভাবে দেখার অবকাশ নেই। কারণ কুয়েলিনারি প্রথমত একজন বিদেশি নাগরিক, দ্বিতীয়ত তিনি একটা উন্নত দেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে এদেশকে তার দেশ নেদারল্যান্ডসের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তার বক্তব্য, যেকোনো পদক্ষেপ, উদ্যোগ সে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে।
এ ঘটনাকে হালকাভাবে দেখার উপায় নাই কেন বলছি, কারণ একদিকে যেমন বাংলাদেশের ইজ্জতের প্রশ্ন এখানে জড়িত, অন্যদিকে বিদেশিদের বাংলাদেশে কেমন নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে সেটাও জড়িত।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বেশ কজন বিদেশি নাগরিক খুনের ঘটনা ও গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার পর বিদেশিরা এদেশে নিরাপদ নয় এমন অজুহাতে বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে তাদের নাগরিকদের চলাচলে সর্তকতা জারি করেছিল। পরে সে সতর্কতা উঠিয়ে নিলেও এখনও যে আশঙ্কা নাই তা কেউ বলতে পারে না।
আমরা দেখেছি গুলশানের ঘটনার আগে কয়েকটি দেশ গুলশান সহ কয়েকটি এলাকাকে বিপদজনক হিসেবে উল্লেখ করে তাদের নাগরিকদের জন্যে সতর্কতামূলক বার্তা দিয়েছিল। সরকার বিষয়টিকে আগে গুরুত্ব দিয়ে না দেখলেও গুলশানের ঘটনার পর নিশ্চয়ই এখন আর হালকাভাবে দেখছে না বলে ধারণা করি।
গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় দেশি-বিদেশি ২৮জন নিহত হন। এর আগে থেকে গুলশানে জঙ্গিবাদীদের হামলার বিষয়ে সরকারের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল এক সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। পরে সমালোচনার মুখে মন্ত্রী বলেন হামলার তথ্য ছিল কিন্তু ঠিক কোথায় ছিল সে তথ্য ছিল না। মন্ত্রীর এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আদতে সন্ত্রাসবাদকে হালকা করে দেখার মত একটা ভুল ছিল।
সরকারের সে ভুলের মাশুল পুরো বাংলাদেশ দিয়েছিল। পরবর্তীকালে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে কিছু সন্ত্রাসী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে মারা যায়। টানা ক’মাসের ভয়াবহ পরিস্থিতি যখনই কেটে যাওয়ার মত অবস্থা তখনই আবার ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে, যার সবিশেষ প্রমাণ বিদেশি এক রাষ্ট্রদূতের অনুষ্ঠানে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ওই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূতের হাতব্যাগ খোয়া গেছে, প্রাণটা খোয়া গেলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াত পুরো পরিস্থিতি!
নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতের ব্যাগ চুরি যাওয়ার ঘটনার পর তার কান্নাসম চেহারা গণমাধ্যমের সূত্রে দেখেছে সারাদেশ এবং বিশ্ব। এটা আমাদের ইজ্জতকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাল সেটা ভেবেছেন কি কেউ? একই সঙ্গে কেউ যদি বিদেশিদের প্রতি বাংলাদেশের প্রদত্ত নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে তাহলে কি ভুল হবে কোনো?
আমরা বর্তমানে যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে সেখানে বিদেশি নাগরিক খুন হলেও একে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে সবকিছুকে উড়িয়ে দিতে চান দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। এরপর সরকারদলীয় কিছু নেতা যেভাবে পুরো বিষয়টি নিয়ে ‘তামাশা’ শুরু করেন তখন আদতে যেকোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান ত দুরের কথা সব ধরনের সমাধানেরই পথ বন্ধ হয়ে যায়। এমন করুণ বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে আশঙ্কা করি কখন না আবার কেউ দাবি করে বসে- দেশে ত প্রতিদিন অনেক চুরি-চামারি হয় এত লজ্জার কী আছে?
এধরনের অনুমিত প্রশ্ন বাস্তবে রূপলাভ স্রেফ কল্পনাপ্রসূত নয়, বাস্তবতার নিরিখেই। সরকারের দায়িত্বশীলদের কেউ এমন মন্তব্য এখন পর্যন্ত না করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককেই এভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে দেখা যাচ্ছে। মানুষের মানসিকতা আর তুলনামূলক আলোচনার ছিরি দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়, আর তারপর কেবল এক কথায় নিজের সান্ত্বনা খুঁজে নিতে হয়- Sometimes people lose their commonsense!
বিভিন্ন টেলিভিশন ক্যামেরার ফুটেজে রাষ্ট্রদূতের হাতব্যাগ চোরের ছবি দেখা গেছে। ওই চোরকে ধরে এনে চুরি যাওয়া জিনিসপত্র হয়ত উদ্ধারও সম্ভব হবে, কিন্তু একজন বিদেশি নাগরিক এবং একটা দেশের রাষ্ট্রদূতের ব্যাগচুরির মাধ্যমে যে ইজ্জত আমরা খোয়ালাম সেটা কি ফেরত পাওয়া সম্ভব? সম্ভব না!
একজন রাষ্ট্রদূত একটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন সেটা পুলিশ প্রশাসনের অজানা থাকার কথা নয়। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ও শাহবাগ থানার দূরত্ব মাত্র কয়েকশ মিটার, এমন অবস্থায় প্রশাসনিক এত দুর্বলতা কেমনে সম্ভব? খোদ রাজধানী শহরের পুলিশ যদি এভাবে দায়িত্বকে দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ না করে তাহলে সারাদেশের পরিস্থিতি কেমন হতে পারে? ভাবতে পারি না, ভাবতে পারছি না!
নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতের এমন ন্যাক্কারজনক অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার পর সরকারের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া। সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাকে জবাবদিহির আওতায় আনার পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)