রাম গোপাল ভার্মার “সরকার রাজ” সিনেমায় ঐশ্বরিয়া রাই ছিলেন লন্ডনভিত্তিক একটি পাওয়ার কোম্পানির প্রধান নির্বাহী আনিতা রাজন। তার বাবার মালিকানাধীন কোম্পানিটি মহারাষ্ট্রে বিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে রাজ্য সরকারের সাথে চুক্তি করেছে, কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলের বাধার কারণে নির্মাণ কাজই শুরু করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে মাস্তান রাজনৈতিক নেতা সুভাষ নাগরে (অমিতাভ বচ্চন) যিনি সরকার নামে পরিচিত ও তার ছেলে শংকর নাগরের (অভিষেক) দ্বারস্থ হন। মূল বাধা নাগরেরা যখন নমনীয় হলো কোটারি স্বার্থে দাড়িয়ে গেলো আরেক বিরোধীপক্ষ।
ভারতে রাজনৈতিক ও ব্যক্তি স্বার্থে উন্নয়ন প্রকল্প কিভাবে বাধাগ্রস্ত হয় তার একটি প্রদর্শনী এই সিনেমা। বুঝে না বুঝে সহজ সরল জনতা কিভাবে প্রকল্প ঠেকাতে জীবন দিতে রাস্তায় নেমে পড়ে তারও উদাহরণ আছে প্রশান্ত পান্ডের চিত্রনাট্যে।
রামপাল নিয়ে যা হচ্ছে তা অনেকটা রাম গোপাল ভার্মার ‘সরকার রাজ’র কপি। গল্পে সুভাষ নাগরেদের সক্ষমতা ছিলো প্রকল্প বন্ধ করার। আর এখানকার নাগরেদের সক্ষমতা হচ্ছে অসত্যের প্রলেপ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার। নিজের কান জায়গায় আছে কি না পরখ না করেই চিলের পিছে দৌড়াতে অভ্যস্থ লোকজন যোগ দিয়েছে দলে দলে। তবে, এসব কথা জোর দিয়ে যারা বলতে চান বা যারা রামপালের সমর্থক তাদের হাতে সরকার কি যথেষ্ট প্রমাণ তুলে দিয়েছে?
এদেশে ভারত বিরোধিতার যথেষ্ট কারণ আছে। সুযোগ পেলেই দুর্বল প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তারা প্রয়োজনের চেয়েও বেশী নেয়, কার্পণ্য করে দিতে। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে দরকষাকষি করেই হোক আর সম্পর্কের খাতিরেই হোক, যেটুকু আদায় করতে সক্ষম হয় তা অন্য কেউ পারেনি কোন কালে। কিন্তু কারণে-অকারণে ভারতের নাম শুনলেই যাদের এলার্জি হয় তাদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, ভারত মাত্র ১৫% বিনিয়োগ করে ১৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেক মালিকানা নিয়ে নিচ্ছে। আর বাংলাদেশ বাকিটার সবটুকু বিনিয়োগ করে মালিকানা পাচ্ছে অর্ধেকের। তারা বলছে, ৭০ ভাগ ব্যাংক ঋণের দায় বাংলাদেশের একার। তাই ১৫ ভাগ ইকুইটি আর ৭০ ভাগ ব্যাংক ঋণসহ বাংলাদেশের বিনিয়োগ ৮৫ ভাগ। এমন প্রচারণার জবাবে সরকার কি স্পষ্ট করে বলেছে যে, প্রস্তাবিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেটি বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, এর ৫০ ভাগ মালিকানা বাংলাদেশের (পিডিবি) আর ৫০ ভাগ ভারতের (এনটিপিসি)। ইকুইটি ৩০ ভাগ অর্থাৎ ৫৯৬ মিলিয়ন ডলার সমানভাবে দুই শেয়ার হোল্ডার বিনিয়োগ করছে। বাকি ৭০% অর্থাৎ ১৩৯০ মিলিয়ন ডলার ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক থেকে। প্রচলিত সুদ হারের চেয়ে কমে এই ঋণের ব্যবস্থা করেছে ভারত সরকার। সুদে আসলে পরিশোধের দায়টা কোম্পানির। খেলাপি হলে দুই শেয়ার হোল্ডার হবে। যাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার বা কোম্পানি সম্পর্কিত ন্যুনতম ধারণা আছে তাদেরতো অজানা নয় যে কোম্পানিটি ব্যবসার মুনাফা থেকেই ঋণ শোধ করবে। দুই দেশের কোষাগার থেকে নিয়ে নয়। এই সামান্য বিষয়টি বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ বা চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হওয়ার প্রয়োজন আছে কি?
ব্যবসার দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে বলা যায়, প্রয়োজন যখন অনেক বেশী থাকে দরকষাকষির সক্ষমতা কমে। বাসা বাড়িতে বিদ্যুতের চাহিদা মিটানো যাচ্ছে না। দেশে নতুন নতুন শিল্প কারখানা হচ্ছে প্রতিদিন। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আগেই রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা ৫০ বিলিয়ন ডলার অর্জনেও প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত, রামপালের মত আরো কয়েকটি নতুন কেন্দ্র। ২০২১ এর মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ওয়াদাতো তার নিজকেই পূরণ করতে হবে। বিদ্যুতের কষ্টে অতিষ্ঠ শহুরে জীবনে শেখ হাসিনা কিছুটা স্বস্তি এনে দিলেও মফস্বলে এখনো বিদ্যুতের লুকোচুরি চলছে। শেখ হাসিনার কাছে মানুষের আকাশ সমান প্রত্যাশার চাপের মধ্যেও নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় দরকষাকষিতে কোন ছাড় দেয়া হয়নি এই প্রমাণের পক্ষে সরকারের বক্তব্য কি স্পস্ট হয়েছে?
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেহেতু একটি লিমিটেড কোম্পানি, ধরে নেয়া যায় এটি সেবা খাতের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠন। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অংশিদাররা ভর্তুকি দিতে পারে, কিন্তু কতদিন? এতে বিশাল বিনিয়োগ ও ঋণ আছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রির আয় থেকে খরচ নির্বাহ করতে হবে না? ব্যাংক ঋণ শোধ করে মূলধন তুলে আনতে কত বছর লাগবে? মুনাফা কত ভাগের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তা কবে থেকে পাওয়ার আশা? প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ কতটুকু ঝুঁকিমুক্ত। বাংলাদেশে বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে উৎপাদন খরচ কতভাগ কম হবে নাকি বেশি? ভর্তুকি না দিলে উৎপাদন খরচ ৬০ ভাগ বেশী হবে এমন তথ্যের সত্যতা কতটুকু? ব্যবস্থাপনা যেহেতু আইটিপিসির হাতে থাকছে সকল পর্যায়ের ব্যাবস্থাপক কি ভারত থেকে নিয়োগ হবে? টেকনিশিয়ানের নামে সকল পর্যায়ের ফ্যাক্টরি স্টাফ ভারতীয় নিয়োগ দিয়ে ডলারে উচ্চ বেতন নিবে? কম বেতনের ডাইরেক্ট লেবার কেবল বাংলাদেশী হবে? ভারত তাদের কয়লা রপ্তানী করবে এই শর্তে প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে এই তথ্যের সত্যতা কতটুকু? এর সত্যতা না থাকলে ভারত থেকে নিম্ন মানের কয়লা আমদানী না করে ইন্দোনেশিয়া ও চায়না থেকে আমদানী করা যাবে কি না? ১৫ বছরের ট্যাক্স হলিডে দিতে গিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভর্তুকি কত? জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তিতে এমন বিষয় নিশ্চয়ই স্পস্ট। সাথে ব্যাংক ঋণের শর্ত। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা করলেইতো আজগুবি আলোচনা ও গুজব বন্ধ হয়। যারা রামপালের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন তারা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে সরকারের উপর আস্থা রাখতে পারেন। রামপালের পক্ষে তর্কে জড়াতে গলায় জোরটা বাড়ে।
আর সুন্দরবনের কাছাকাছি বাগেরহাটের রামপালে প্রস্তাবিত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে, জীব বৈচিত্র ধ্বংস হবে, পানি দূষণ এবং শব্দ দূষণ হবে এমন অসংখ্য অভিযোগের জবাবে সরকার এনভায়নমেন্টাল ইমপেক্ট এসেসমেন্ট (ইআইএ) এর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে অনেক আগেই। সবকিছু তাতে বলা হলেও কেউ কেউ আস্থা রাখতে পারছেন না। তবে, শেখ হাসিনার সরকারের উপর ভরসা রাখা মানুষের অভাব নেই। সেই সরকারের তাই সবকিছু খোলামেলা জানিয়ে দিলেই পারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)