চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প: কল্পনা বনাম বাস্তবতা

কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে রামপাল নিয়ে নতুন করে অপপ্রচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বল্প জ্ঞান নিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে কিছু মানুষ মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই করছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থান, যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে, কার্বন নিঃসরণ এবং পরিবেশ দূষণ রোধে কি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, ইউনেস্কোর উদ্বেগের বিষয়ে তাদেরকে জবাবে যে চিঠি দিয়ে দেয়া হয়েছে এমন সব মীমাংসিত বিষয়ে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল অপপ্রচারে নেমেছে।

সাবেক মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট আল গোর যে উদ্বেগ জানিয়েছেন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে তার জবাবে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামপাল নিয়ে তার সন্দেহ দুর করতে বাংলাদেশ সফরের আহ্বান জানান তাকে।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে কাল্পনিক এবং মিথ্যা অপপ্রচার সম্পর্কে বর্তমানে সত্যটা উপলদ্ধি করতে পারছে বহু সংখ্যক মানুষ। এটা সম্ভব হয়েছে রামপালে যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে তা সবার সামনে পরিস্কার করতে পেরেছে কর্তৃপক্ষ। এসব করে যখন স্বার্থান্বেষী মহল হালে পানি পাচ্ছে না তখন, ভারতকে জড়িয়ে নতুন করে অপপ্রচার শুরু করেছে। কিছু পর্যবেক্ষক এটা বলার চেষ্টা করছেন যে, বাংলাদেশ চীন থেকে সাবমেরিন কেনার কারণে ভারত তাদের সঙ্গে বাংলাদেশকে সামরিক চুক্তির জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি অপ্রাসঙ্গিকভাবে ইস্যু তৈরী করে মিডিয়াতে সক্রিয় থাকছে। এই প্রেক্ষাপটে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে বিভ্রান্তি দুর করতে এই লেখাটি।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রকল্প। বিপিডিবি বাংলাদেশ এবং এনটিপিসি ইন্ডিয়া এই দুই কোম্পানীর ৫০ শতাংশ করে সমান মালিকানা থাকবে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী কয়লা বিদ্যুৎ কোম্পানীতে। বাংলাদেশ সরকার বাগেরহাটের রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জায়গা নির্ধারণ করেছে যেটা সুন্দরবনের পেরিফেরি বা মূল অংশ থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশের পরিবেশ আইনে ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এমন কোন স্থাপনা বসানো নিষেধ রয়েছে।

রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐহিত্যের যে অংশ সুন্দরবনের মধ্যে অবস্থিত তা থেকে ৬৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সংরক্ষিত বনের পাশে একেবারে শহরের প্রাণকেন্দ্রে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এ ধরনের বহু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, সাউথ আফ্রিকা ও তাইওয়ানে। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের গ্লাডস্টোনে গ্রেট বেরিয়ার রিপের মত খালের পাশে গত ৫০ বছর ধরে ১৮শ মেগাওয়াট সাবক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রয়েছে। সেখানে ৪শ কিলোমিটার দূর থেকে ট্রেনে করে খনি থেকে সরাসরি কয়লা সরবরাহ করা হয়। সেখানে কোন বায়ু দূষণ বা পানি দূষণের অভিযোগ এখনো পর্যন্ত কেউ করেনি।

অস্ট্রেলিয়ার দুটি বৃহৎ কয়লা বন্দর দিয়ে তারা তাদের ৪০ শতাংশ কয়লা রপ্তানী করে। দেশটির সমগ্র কয়লা এবং তিনটি এলএনজি প্ল্যান্টও কিন্তু গ্লাডস্টোনে অবস্থিত। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কয়লা রপ্তানী করে অস্ট্রেলিয়া। এই কয়লা রপ্তানী করা হয় গ্রেট বেরিয়ার রিফের সরু রাস্তা দিয়ে যে অঞ্চলটাকে ইউনেস্কো তাদের বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে ঘোষণা দিয়েছে। সুন্দরবন থেকে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূরত্ব যথেষ্ট পরিমাণে হলেও রামপাল বিরোধীদের কাল্পনিক উদ্বেগই ইস্যু তৈরী করছে।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য যে জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পতিত, অনুর্বর এবং মূলত চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহৃত হতো। খুব অল্প পরিমাণে জমির মালিক ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যে পরিমাণ মানুষকে পুনর্বাসন করতে হবে তার পরিমাণও খুব কম। প্রকল্পটি পশুর নদীর তীরে অবস্থিত হওয়াতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জায়গা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ। ভারত বা এনটিপিসি ওই জায়গা নির্ধারণ করেনি। প্রকল্প এলাকাটিতে বর্তমানে রাস্তাও হয়েছে। কৃষি জমির ক্ষতি না করে, অধিক মানুষের পুনর্বাসন করা লাগছেনা, তদুপরি নদীর ধারে প্রকল্পটির অবস্থান হওয়াতে প্রকৌশল দৃষ্টিভঙ্গিতে সবচেয়ে উত্তম জায়গাতেই এই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নকশার সময় থেকেই উচ্চ তাপ নিয়ন্ত্রণকে মাথায় রাখা হয়েছে। স্বল্প মাত্রার সালফার এবং কয়লার ছাই ব্যবহার করা হবে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে তাতে কয়লা থেকে ৯৮ শতাংশ সালফার শোষণ করবে। একইভাবে, ইলেকট্রনিক প্রিসিপাইটরি পারদ এবং কয়লার ছাইকে সরিয়ে ফেলবে। পানির তাপমাত্রা কমানোর জন্য অত্যাধুনিক কুলিং টাওয়ারের মাধ্যমে কোল্ড ওয়াটার রিসাইকেল সিস্টেম ব্যবহার করা হবে। অর্থাৎ একই পানি ঠান্ডা করে পুনরায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গরম পানি কোনভাবেই পশুর নদীতে ফেলা হবে না। রামপাল থেকে পশুর নদীতে যে পরিমাণ পানি যাবে তার পরিমান শূন্য দশমিক শূন্য ৫ ভাগ।

রামপালে যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে তার জন্য কার্বন নিঃসরণ কম হবে এবং পরিবেশের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধোয়া বের করার জন্য ২৭৫ মিটির উঁচু চিমনি থাকবে যাতে করে পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর কোন প্রভাব না পড়ে। রামপাল থেকে সুন্দরবনের দিকে বাতাসও কম থাকে, বছরের সর্বোচ্চ ৯০-১০০ দিনের মত বাতাস সেই দিকে প্রবাহিত হয়।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অস্ট্রেলিয়া অথবা ইন্দোনেশিয়া থেকে খুবই উন্নতমানের কয়লা আমদানি করা হবে। প্যানামেক্স জাহাজে করে (যার প্রতিটির ধারণ ক্ষমতা ৮০ হাজার থেকে ১লাখ ২০ টন ) কয়লা পরিবহন করা হবে। জাহাজগুলো বিশেষভাবে ঢাকা থাকবে যাতে করে কয়লার ছাই বাইরে না আসে। সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদী দিয়ে মাত্র এ রকম দুইটি জাহাজে করে কয়লা নেয়া হবে রামপালে। যদিও প্রতিদিন কমপক্ষে ২শ জাহাজ চলে সেই জলপথ দিয়ে। তার পরেও শব্দহীন এই দুটি জাহাজ হয়তো বড় কোন ইস্যু না। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তিন মাসের কয়লা সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে।

এই এলাকার সিমেন্ট কারখানাগুলো রামপাল থেকে সমস্ত ছাই নিয়ে যাবে তাদের সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য। আকস্মিক ঘটনা সামাল দিতে তিনটি গভীর ছাই রাখার পুকুরে সেগুলোকে সংরক্ষণ করা হবে।

আমরা দেখলাম রামপালের মীমাংসিত বিষয়গুলো জানার পরেও স্বার্থান্বেষী মহল কাল্পনিকভাবে মিথ্যা তথ্য তৈরী করে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা সেগুলো হয় গুগল থেকে কপি-পেস্ট করেছে না হয় বাস্তবতা বিবর্জিত কোন একাডেমিক গবেষণা থেকে ধার করেছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের স্পর্শকাতর এলাকা থেকে বহুদূরে নিরাপদ জায়গাতেই অবস্থিত। এখানে ব্যবহৃত হবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি যাতে করে পরিবেশ ও প্রতিবেশের কোন ক্ষতি না হয়।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগ। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে এটা ভারতের প্রকল্প। ভারতের এনটিপিসি রামপালের প্রধান সহযোগী হিসেবে নির্মাণের আগে এবং পরের ধাপের সব কাজেই যুক্ত থাকবে। রামপালের বিরোধীতা করতে গিয়ে মানুষের ভারত বিরোধী হয়ে ওঠার কোন কারণ নেই। কিছু আন্দোলনকারী সরকার কর্তৃক গৃহীত রামপালের বিরোধিতা করতে নেমে প্রকারন্তে রাষ্ট্রবিরোধী কাজের সঙ্গেই জড়িয়ে পড়ছে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)