সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে চলমান বিতর্কে অনলাইনেও চলছে আশঙ্কা বনাম আস্থার তর্কযুদ্ধ। চ্যানেল আই অনলাইন যে মতামত আহ্বান করেছিল তাতেও ফুটে উঠেছে সেই চিত্র।
রামপাল প্রকল্পবিরোধীদের মূল শংকা যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হলে সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশে প্রভাব পড়বে যার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়বে দেশের পরিবেশ আর জলবায়ুতে।
অন্যদিকে, এ প্রকল্পের পক্ষের মানেুষেরা বিশ্বাস করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক পর্যালোচনা করেই প্রকল্পটিতে অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি এমন কোন প্রকল্পে যাবেন না যা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের ক্ষতি হয়।
চ্যানেল আই অনলাইনের ফেসবুক পেজে মতামত আহ্বান করার পর শত শত পাঠক তাদের মতামত জানিয়েছেন। সেখানে যেমন অনেকে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন তেমনি অনেকে শুধু চাই বা চাই না বলে তাদের অবস্থান জানিয়েছেন।
যে কারণে রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতা
রামপালে ভারতের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পবিরোধীদের মূল কথা, সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবেই; তাই কোনভাবেই সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি করা যাবে না। তাদের কেউ কেউ পুরোপুরি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রবিরোধী, কেউ কেউ প্রকল্পের জায়গাটি অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে।
‘রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে, তাছাড়া লাভবান হবে ভারত সব দিক থেকে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে,’ এভাবে মতামত তুলে ধরেছেন ‘আমাদের অধিকার’ নামে পরিচয়ের একজন।
কেউ কেউ অংশীদার ভারত বলেই বেশি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে, অনেকে বলেছেন, ভারত বা পাকিস্তান বিষয় না’ যে দেশিই অংশীদার থাকুক না কেন সুন্দরবন লাগোয়া জায়গায় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে না।
মো. নুরুজ্জামান নামে একজন চ্যানেল আই অনলাইনের ফেসবুক পেজে লিখেছেন: রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা পুড়লে এর নির্গত ধোঁয়া কি সাদা পাওডার (তিব্বত টেলকম) আসবে না কালো ধোঁয়া? কালো ধোঁয়া কি মানুষ, গাছপালা এবং পশুপাখির জন্য উপকারী না ক্ষতিকর? কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কে বানাচ্ছে এটা মূখ্য বিষয় নয়, এর ক্ষতিকর দিকটা বিবেচ্য বিষয়।
মনিরুজ্জামান মনির নামে আরেকজনের বক্তব্য: বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবে খুব ভাল কথা, তাই বলে কি রামপালেই করা লাগবে? …১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটারের মানচিত্রে কি রামপাল ছাড়া অন্য কোন জায়গা নাই?
সাফি খান নামে একজন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে দেশের পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরেছেন।
একইরকম আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে আতিকুর রহমান নামে সাম্প্রতিক ডিএপি সার কারখানার দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ‘কিছু দিন আগে সার কারখানায় গ্যাস বিষ্ফোরিত হয়ে এখন সেখানকার এলাকার মাছ, গাছের পাতা ঝরে পড়ছে। যদি রামপাল এমন হয় তাহলে কী হবে আপনারা ভাবুন।’
রামপাল প্রকল্পবিরোধীদের কেউ কেউ আবার বিকল্প প্রস্তাব করেছেন। যেমন ওবায়দুর রহমান লিখেছেন: ঋণ করে পরিবেশের ক্ষতি ডেকে না এনে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের পুরাতন যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করলে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সেভ হবে তা রামপাল এর উৎপাদিত বিদ্যুৎ থেকে অনেক বেশি। … শুধু ভারতকে খুশি করে এ প্রজেক্ট এর দরকার কি আমাদের?’
ভারতের কথা উল্লেখ করে নাঈম আহমেদ উপহাসের সুরে বলেছেন, ভারত করলে আপত্তি থাকবে কেন! তারাওতো বন্ধু দেশ। দেখছেন না পানি দিয়ে কি উপকার করছে! সাথে হাতিও দেয়!
হাবিল নান্দিনা নামে একজন রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপক্ষে মত দিয়ে লিখেছেন: বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনেকে বানাতে পারেন। এমন কেউ কি আছেন একটা সুন্দরবন বানাতে পারবেন? সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তা প্রহরী।
একইরকম কথা বলেছেন আরো অনেকে। যেমন হিমুর রুপালী রাত্রি আইডি থেকে বলা হয়েছে: পৃথিবীতে বাংলাদেশ যেমন একটা তেমন বাংলাদেশে সুন্দরবনও কিন্তু একটা, আমরা বিদ্যুৎ চাই কিন্তু সেটা সুন্দরবন ধ্বশের বিনিময়ে না, চাইলেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অন্য কোথাও স্থাপন করা সম্ভব, কিন্তু সুন্দরবন? তাই বিষয়টি বারবার বিবেচনা করে দেখা উচিৎ।
রামপালের পক্ষে যে যুক্তি
তবে, চ্যানেল আই অনলাইনের ফেসবুক পেজে মতামত দেওয়া অনেকে বলেছেন, রামপাল প্রকল্পের বিরোধীরা শুধু আবেগ আপ্লুত হয়ে প্রকল্পটির বিরোধিতা করছেন।
মো. সারোয়ার খান নাম একজন লিখেছেন: মানবসৃষ্ট যে কোন স্থাপনা প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলে। তাই বলে সভ্যতা বিনির্মাণ থেমে থাকে না। সভ্যতার মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সে প্রভাবকে কত নুন্যতম রাখা যায়। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটিতে আমার মনে হয় না সুন্দরবনের এত ক্ষতি হবে যেটার রেমিডিয়াল মেজার্স নেয়া যাবে না। সেগুলো যেহেতু ইতিমধ্য প্রজেক্টের বিবেচনা নেয়া হয়েছে তাই সুন্দরবন শেষ হয়ে যাবে বলে এটার বিরোধিতা করা ঠিক নয় বলে মনে করি।
‘আর গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আমাদের অবশ্যই বিকল্প জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ভাবতে হবে। আগেই ভাবা উচিত ছিল। গ্যাস শেষ হয়ে গেলে বা তেলের দাম বেড়ে গেলে শুধুমাত্র কুইক রেন্টাল প্লান্টের উপর ভর করে থাকলে আবার একদিন আমাদের কুপি বা হারিকেন জ্বালাতে হবে। তাই এখনই এরকম আর দুই তিনটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প করা খুব দরকার,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সারোয়ার খান সঙ্গে এও বলেন: আমি এর বিরোধীদের খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি এর অন্তর্নিহিত উপাদান হল নিছক ভারত বিরোধিতা।
মো. শাহীন নামে একজন একটু উপহাসের সুরে বলেছেন: আপনাদেরকে একটু না বললে নয়, বড় বড় আওয়াজ দিচ্ছেন বাড়িতে ফ্যান আর এসি’র নিচে বসে তাই না? আমরা আর তালপাতার পাখা ঘুরিয়ে পারছি না। আপনাদের সমস্যা বেশি হলে লন্ডন চলে যান, মরতে হয় আমরা মরব। ফাউ জ্ঞান বিতরন বন্ধ করুন।
‘আমাকে হয়তো দালাল বলতে পারেন, যদি দালাল বলার ইচ্ছাটা আপনার জাগ্রত হয় দয়া করে বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বলবেন তাহলে সাদরে গ্রহণ করব,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মিজানুর রহমান শাওনের মতে: অনেকেই বলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু আমি এর সাথে একমত না। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ধরনের বিদ্যুৎ প্লান্ট আছে। বনের সীমানা থেকে ১৪ কি,মি, দূরে হওয়ায় হয়তো অল্পকিছু ক্ষতি হতে পারে। ভারতে বনের ২৫ কি,মি, এর মধ্যে এ ধরনের প্লান্ট করা নিষিদ্ধ।
নাসিম ভূইয়া রামপাল বিদুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চালানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনার চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক বাংলাদেশে আছে নাকি সন্দেহ। সুতরাং শেখ হাসিনা কোন ভুল সিদ্ধান্ত বা দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত নেননি এইটা আমার বিশ্বাস। চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে চিলের পেছনে না দৌড়ে নিজের কানে হাত দেওয়া উচিৎ। বাংলাদেশে এমন কিছু লোক বা ব্যক্তি রয়েছে তাদের কাজ বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা। এবং মিডিয়ার সামনে এসে পাকা পাকা কথা বলা। এখানে কাঁচের মত স্বচ্ছ এবং পরিস্কার যে রামপাল বিদুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না। যে আশংকা করা হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
‘ইদানীং আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবী অধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে । আর পরিবেশবিদেরতো অভাবই নাই ।… নতুন করে আমাদের দেশে হাইব্রিড পরিবেশবিদ জন্ম নিয়েছে। ঐ সকল পরিবেশবিদ নেতার মধ্যে স্বশিক্ষিত নেত্রীও আছেন, যিনি নির্বাচনের হলফনামায় নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্বশিক্ষিত লিখেছিলেন,’ বলে উল্লেখ করেন নাসিম ভূইয়া।
শাহীন নামে একজন লিখেছেন: মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি সেটা মনে করি না। দেশ উন্নত করতে হলে শিল্পে উন্নত হতে হবে, আর শিল্পে উন্নত হতে প্রয়োজন চাহিদা মাফিক বিদ্যুৎ। পেটে ভাত থাকলে অনুন্নত পরিবেশকে উন্নত করার উপায় একটা হবে। চিন্তা করার কিছু নেই।
আর শান্ত আকাশ লিখেছেন: যারা এর বিরুদ্ধাচরণ করছে আমি বলবো তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে, কারণ তাদের সুন্দরবন নিয়ে এতো দরদ, আর সুন্দরবন যে কেটে কুটে এ পর্যন্ত ইট ভাটায় পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে,, তার জন্যতো কাউকে সোচ্চার হতে দেখলাম না! শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে কী লাভ?
আতাউর রহমান কায়সার বলেছেন: আমার দিকে ভালো হবে বিদুৎ কেন্দ্র করলে। তবে সরকার কে তার অবস্থান আর পরিস্কার করা উচিত। সাথে রামপাল বিদুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে মানুষকে আরও জানানো উচিত।