যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে ২৭ জনের চিরবিদায়ের খবরটিই ছিল আলোচনায়। দেশ নিম্নমধ্য আয়ের স্বীকৃতি পাবার পর পরই পরনের বস্ত্রের জন্য জীবনদানের এই মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের আর্থিক দারিদ্রের পাশাপাশি চিন্তার দারিদ্রকেও নতুন করে সামনে নিয়ে আসে। বোঝা যায় যে চেতনায় আমরা নিম্নবিত্তের চেয়েও নীচে। ময়মনসিংহের জর্দা কারখানার মালিকের দানের নামে টাকার উত্তাপ ছড়ানোর যে ধর্মীয় লেবাস তা স্পষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ যারা নানা অসাধু প্রক্রিয়ায় দ্রুত সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন তারাও চাইলে নড়েচড়ে বসতে পারেন এই ঘটনার পর। এমন খবরও এখন বের হচ্ছে যে, পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া অনেকেরই সামর্থ ছিল কাপড় কিনে পরার। সামান্য দামের যাকাতের কাপড়ের ওপর হামলে পড়ার জন্যে এক ধরনের চিন্তার দৈন্য কাজ করেছে, যেটি আমাদের সমাজের আরেক রুগ্ন রূপ।
চিন্তা এভাবেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। নিত্যকার দুর্ঘটনার দেশে অপঘাতে ২৭ জনের মৃত্যু এবং এর জের খুব বেশি দীর্ঘ হবে না সেটি সবারই জানা। এই ঘটনার আগুন দপ করে নিভিয়ে দিয়েছে সিলেটের ১৩ বছরে শিশু রাজন। মৃত্যু নিয়ে তুলনা চলে না, তারপরও এই ২৭ জনের চেয়ে ঢের ভারী কতিপয় পিশাচের হাতে তার করুণ মৃত্যু। এই ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিদ্যুৎগতিতে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে বর্বরোচিত রাজন হত্যার ঘটনা।
বাংলার প্রতিবাদী শিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায় রাজনকে নিয়ে গান লিখেছেন। ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম আহ্বান জানিয়েছেন শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষকে এক হতে। মন্ত্রিসভায় রদবদল, টেস্ট ক্রিকেটের উত্তেজনা কিংবা ঈদ নিয়ে সব বিনোদন চিন্তা যেন গৌণ হয়ে গেছে রাজনের মৃত্যুর কাছে। মানুষ তার সবটুকু ক্ষোভ আর ঘৃণা উচ্চারণ করছে হত্যাকারীদের প্রতি। কেউ বলছে, ওদেরকে প্রকাশ্যে গুলি করে মারা হোক, কেউ বলছে ফাঁসি চাই, কেউ বলছে গাছে বেঁধে খাদ্য ও পানি বঞ্চিত করে ওদেরকে যন্ত্রণা দিয়ে মারা হোক।
দেশে বহু শিশুরই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কিন্তু রাজনের মৃত্যুটি মাপা যাচ্ছে না বর্বরতার চূড়ান্ত কোন পাল্লাতেও। কারণ, রাজনকে শাস্তি দেয়ার দৃশ্যটি হত্যাকারীরা মোবাইল সহযোগে ভিডিও করে রেখেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা উপভোগ করেছে এক বিকৃত-সুখ। বিশ্বব্যাপী একেক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া আইসিস, বোকো হারাম কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গীগোষ্ঠির মানব নিধনের মধ্যেও এত বিকৃত সুখ উপলব্ধির শখ থাকে কি-না সন্দেহ। হত্যাকারীদের ভিডিওধারণ বিদ্যাটির ব্যবহার দেখে মনে হয়েছে, রাজনের জীবন কেড়ে নেয়ার ঘটনাটি তাদের কাছে এতোটাই স্বাভাবিক ও ছুঁ মন্তর যে, এটি জানাজানি হলেও ওদের কিছুই যায় আসবে না।
রাজনের হত্যাকান্ডটিকে ঘিরে শিশুর প্রতি নির্যাতন ও শিশু হত্যা ইস্যুতে সরকার অবশ্যই পারে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। প্রচলিত আইনি ব্যবস্থাকে তার গতিতে চলতে দিলে রাজন হত্যার ঘটনাও সবার দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে। সরকার এমন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক যার মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীর মানবতার বিরুদ্ধে তৎপর গোষ্ঠিগুলোর টনক নড়ে, যা থেকে শিক্ষা নিতে পারে সকল জাতিগোষ্ঠি।
আর বাংলাদেশে ১৩ বছরের রাজনের বদৌলতে নিশ্চিত হোক প্রতিটি শিশুর বেঁচে থাকার আরো বাস্তবসম্মত অধিকার। প্রতিষ্ঠিত হোক শিশু নির্যাতনের কঠিনতম সাজা। শিশুর প্রতি ক্রুর হয়ে উঠতে পারে যে চেতনা, সে চেতনা ধ্বংস হোক, সমুলে নস্যাৎ হয়ে যাক। রাজন পৃথিবী হয়ে উঠুক, লাখ লাখ রাজনের নিরাপদ জীবনের স্বার্থে।