ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের দিকে যাচ্ছে দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপ। আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে সরকারি দল ও বিরোধী দলের বাদানুবাদ এবং দীর্ঘদিনের বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তীব্রভাবে। আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ আল ইয়ামিন ১৫ দিনের জরুরী অবস্থা জারি করেছেন। প্রেসিডেন্টের পক্ষে আইনমন্ত্রী জরুরী অবস্থা জারির ঘোষণা দেন এবং এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে মালদ্বীপে বসবাসরত দেশি এবং বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছে সরকার এবং দেশের জনগণকে সজাগ থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মূলত জরুরী অবস্থা জারির পর থেকেই থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে সমগ্র মালদ্বীপ জুড়ে। সাধারণ মানুষও আতংকে রয়েছে দেশটির সর্বশেষ পরিস্থিতি অবলোকনের জন্য। বিশ্ব গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব সহকারে মালদ্বীপের রাজনৈতিক সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে।
সরকার কখন জরুরী অবস্থা জারি করে থাকে? জরুরী অবস্থা তখনি জারি হয়ে থাকে যখন সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। পাশাপাশি এও বলা যায়, বিরোধী পক্ষদের দাবি যখন যৌক্তিক হয় এবং তার স্বরূপে সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয় ঠিক তখনি পরিস্থিতি অনুকূলে রাখার নিমিত্তে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়ে থাকে। মালদ্বীপ সরকারও হয়তো উদ্ভূত পরিস্থিতির ভাবার্থ অনুধাবন করতে পেরেই বিরোধীদলের আন্দোলনের সুযোগকে নস্যাৎ করার জন্য জরুরী অবস্থা জারি করেছে। আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। তবে দেশি-বিদেশি নানা রকম চক্রান্তের পায়তারাও হয়ে থাকতে পারে মালদ্বীপে। যাই হোক, টানা ১৫ দিনের জরুরী অবস্থা কোনভাবেই কাম্য নয়।
মালদ্বীপের সংবিধানের ২৫৩ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে আগামী ১৫ দিনের জন্য জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। আহুত সমস্যা সমাধানের জন্য সংবিধানের ২৫৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পার্লামেন্টে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে না ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে। ঘটনাটা যেভাবে এগোচ্ছে সেভাবে সংকট আরো ঘনীভূত হবে বলে মনে হচ্ছে। পার্লামেন্টে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে পাহারা দিচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। তাছাড়া রায় ঘোষণাকারী মালদ্বীপের প্রধান বিচারপতি আব্দুল্লাহ সাঈদকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রধান বিচারপতির পাশাপাশি অন্য একজন বিচারপতিকেও গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সুপ্রীম কোর্ট ঘিরে রেখেছে পুলিশ।
প্রধান বিচারপতিকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সরকার তার স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করার মতো হেয় কাজ আর হয় না এবং সেটিই করেছে সরকার। বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে পথ চলতে দিতে হয় এবং দেওয়া উচিত দেশের মঙ্গলের স্বার্থেই। মালদ্বীপের বর্তমান সরকার বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ ঘটনার পরে জনগণ এবং মানবাধিকার কর্মীরা নিন্দা জ্ঞাপন করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সরকার একনায়কতন্ত্রের মতো আচরণ শুরু করেছে।
আদালতের যে আদেশের ভিত্তিতে দেশটির রাজনৈতিক মাত্রা ভিন্নরূপ পেয়েছে তা হলো: সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে কারাবন্দী নেতাদের মুক্তির আদেশ দিয়েছে আদালত। এর মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদও রয়েছেন। পাশাপাশি বর্তমান প্রেসিডেন্টের বহিস্কৃত ১২ জন আইন প্রণেতার উপর থেকে বহিস্কারাদেশ তুলে নেওয়ার রায় দেয় আদালত। রায়গুলো বাস্তবায়িত হলে ৮৫ সদস্যের আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে সরকারি দল। কিন্তু সরকারি দল আদালতের নির্দেশকে অমান্য করলে দেশে শুরু হয় রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মামলাগুলো হয়েছিলো বিধায় আদালত যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে অভিযুক্তদের খালাস প্রদান করে এবং সেটা যৌক্তিকভাবেই। এক্ষেত্রে রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ সচেতন মহলকে চিন্তিত করে তোলে এবং সরকার তার স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ ও ঘটিয়েছে একমাত্র ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার প্রয়াসে।
তাছাড়া প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি রুল জারি করেন। জারিকৃত রুলে ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও প্রেসিডেন্টের দুর্নীতি শীর্ষক সমালোচনা করা হয় রুলটিতে। সরকারের উচিত ছিল আদালতের রুলের বিরুদ্ধে প্রমাণাদি দাঁড় করানো। কিন্তু সরকার রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগকেই অনেকটা প্রমাণিত করে ফেলেছে। সৎসাহস থাকলে রায়ের বিরুদ্ধে পিটিশন করতে পারতো সরকার। তা না করে রায় প্রদাণকারীকে ক্ষমতার দাপটে গ্রেফতার করতে দ্বিধা করেনি সরকার। এটি চরমভাবে বিচার বিভাগের প্রতি বিরুদ্ধাচরণ এবং কোন সরকারই তা করতে পারে না। কিন্তু মালদ্বীপের সরকার এহেন ঘৃণিত ও নেতিবাচক কাজটি করার দুঃসাহস দেখিয়েছে।
পাশাপাশি সুপ্রীম কোর্টের রায় মান্য না করায় অ্যাটর্নি জেনারেল ও প্রধান কৌসুলিকে অপসারণের জন্য বিরোধীদলের নেতারা সংসদে পিটিশন দেয়। কিন্তু সেসব কিছুকে অগ্রাহ্য করে সরকার নিজেদের মতো করে সংসদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বিরোধীদলের নেতারা এবং সাধারণ জনগণও এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বহির্বিশ্বের নিকট আবেদন জানিয়েছে। জনগণের হাতে ক্ষমতাকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে অনেকেই। আমরাও আশা করবো, মালদ্বীপের সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ফিরিয়ে দিবে সরকার, জনগণের নিকট গণতন্ত্রের সুবাতাস বয়ে নিয়ে যাবে বর্তমান সরকার। যাতে কোন পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, মালদ্বীপের সাধারণ জনগণ কখনোই হানাহানিতে বিশ্বাসী ছিল না। এ ঘটনার রেশ ধরেও যেন কেউ ভিক্টিম না হয়। জনগণের গণতন্ত্র ফিরে আসুক মালদ্বীপে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংকট উত্তোরণে জনগণকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)