কুকুর আর মানুষের মাঝে তফাৎ হলো, মানুষ কুকুরের মত কামড় দিতে পারে না। কিন্তু বর্তমান সময়ে মানুষ নিজের মনুষ্যত্ব, বিবেকবোধ সব যেন হারিয়ে ফেলছে। প্রতিশোধ প্রবণতার কারণে বাড়ছে অপরাধমূলক কাজ। ক্ষমতার দাম্ভিকতায় অন্ধ হয়ে সমাজকে নষ্ট করে, অতীতকে উদাহরণ হিসাবে দাঁড় করানো মানে নিজেদের পরিবর্তনের পথকে রুদ্ধ করা। তাই কুকুরের কর্ম মানুষ করলে সে অমানুষ হয়ে যায়।
দুর্নীতি অভিযানে দেশ যখন নড়চড়ে উঠেছে ঠিক তখনই এক মায়ের সন্তানকে বীভৎসভাবে মেরে হত্যা করেছে অন্য মায়ের সন্তানরা। একজন মা হিসাবে মেলানো যায় না এ হিংস্রতার অংক। সে কারণে স্তব্ধ হয়ে ভাবতে হয় নয় মাস মাতৃজঠরে ধারণ করে ভূমিষ্ঠ সন্তানের মুখ দেখে যে মা প্রসব বেদনা ভুলে যায়; সেই মা ২১ বছরের ছেলে আবরারের মৃত্যু শোক বয়ে বেড়াবে কী করে? মা হিসেবে এ প্রশ্নের উত্তর কোনো নারীর কাছে নেই এ সমাজে।
রাজনৈতিক বা ভিন্ন কারণে এ দেশে শিক্ষাঙ্গনে অনেক মা-ই সন্তানহারা হয়েছে। আর সন্তান হারানো শোকের মিছিলে আবারও যোগ হলো আবরারের মা রোকেয়া খাতুন। আবরারে মত মেধাবী ছেলের জন্য মা হিসাবে সান্ত্বনার কথা বলার শক্তি কোন মায়ের নেই৷ একবার নিজেকে সন্তান হারা মায়ের জায়গাতে চিন্তা করলে কোনভাবে সহ্য হয় না আবরারের নিথর কালশিটে দাগ পড়া শরীরটা।
গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমে বারবার আবরার সে মৃত্যুক্ষণের বর্ণনা যতবার প্রচার হচ্ছে ততবার মনে হয় একটা ছোট্ট শিশুকে কতটা যত্ন করে ২১ বছরের যুবক আবরারে পরিণত করেছে তার মা। আর সেই আবরারকে ঠাণ্ডা মাথায় অত্যাচার করেছে তারই বয়সের সহপাঠীরা। এরা কেউ অসচেতন অশিক্ষিত নয়। সবাই মেধাবী বলেই বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু এদের নিজেদের ভেতরের পশুত্বটাকে জয় করতে পারেনি। যার কারণে তারা রাজনীতির ভুল পথে চলছে অতীতের মত। যা এ সময়ের রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রতিকূলে বলেই প্রধানমন্ত্রী অন্যায়ের বিচার করতে বদ্ধপরিকর। তিনি একজন মা হিসাবে আরেক মায়ের সন্তানের এমন মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেননি বলে নিজে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছেন। যা সন্তানের জননী হিসাবে মা জাতির কাছে আশা জাগানিয়া বাঁশি।
পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে সন্তান কুপথে বিপথে যায়। কিন্তু পৃথিবীতে কোনো মা কু-সন্তান জন্ম দেয় না। আবরার তার চিন্তা চেতনা দিয়ে মত নিজস্ব মত প্রকাশ করার অধিকার রাখে। আর সে মত যদি সমাজ রাষ্ট্রের জন্য হুমকি স্বরূপ হয় তার জন্য দেশের আইন ও প্রশাসন রয়েছে। কিংবা আবরার যদি ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী হয়ে থাকে সেটার কারণে তাকে নির্যাতন করে মেরে ফেলার অধিকার কোনো রাজনৈতিক দলের নেই। সন্তানকে সুশিক্ষিত করতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে আবরার হত্যাকারী হিসাবে অভিযুক্ত অমিত সাহাসহ অন্যদের পরিবার। কিন্তু তারা ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যে বিপথে গিয়েছে তার প্রমাণ করেছে তাদের হিংস্র মনোভাব আর আচরণ দিয়ে।
আজ আবরারের মা রোকেয়া খাতুন একাই যে আহজারি করছে তা কিন্তু নয়। সেই সাথে এজাহারভুক্ত আসামী মেহেদী হাসান, মুহতাসিম ফুয়াদ, অনীক সরকার, মেহেদী হাসান রবিন, ইফতি মোশারফ হোসেন, মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মাজেদুল ইসলাম, মোজাহিদুল, তানভীর আহম্মেদ, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, জিসান, আকাশ, শামীম বিল্লাহ, শাদাত, তানীম, মোর্শেদ, মোয়াজ, মনতাসির আল জেমির মা-ও সন্তানের অন্যায় কাজ আর আগামী দিনের ভাবনাতে অসহায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতিয়ার হয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারত যে মেধাবী তরুণরা, আজ তারা রাজনীতির অন্ধ গলিতে গিয়ে ধ্বংস করছে নিজেদের।
কিন্তু দলীয় পরিচয় দিয়ে তারা পরিত্রাণ পাবে না এটা যে সুস্পষ্ট তা তাদের বুঝা উচিত ছিলো দলীয় প্রধানের বর্তমান সময়ের কঠোর মনোভাব ও অবস্থান থেকে। আবরারকে শায়েস্তা করার জন্য তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা তাদের ফাঁস হওয়া মেসেজগুলো প্রমাণ করে। অন্যায়কে নীরবে সয়ে যায়নি কেউ। প্রতিবাদ উঠেছে সাধারণ মানুষের কণ্ঠে।
আবরারের ঘটনা থেকে বিস্ময় লাগে যখন বলা হয়, আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রদের টর্চার সেল রয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে তারা যেন রাজাধিরাজ। তবে এসব ক্ষমতা অপব্যবহার করার সাহস তারা কী করে পায় তা জানা আবশ্যক।
দুঃখজনক জনক হলেও সত্য যে, ছাত্র রাজনীতি থেকে নেতৃত্ব উঠে আসার প্রচলিত ধারা এখন দেশে নেই বললে চলে। বরং ছাত্র রাজনীতিতে ক্ষমতার প্রভাব, টেন্ডারবাজি, অর্থের মোহের কাছে পরাজিত রাজনৈতিক নীতি আর আর্দশ। এ দেশে ক্ষমতা বদল হলেও সমাজের মানসিকতা বদল হয়নি। উল্টো অধঃপতনের রাজনীতিতে, একজন মেধাবী তরুণের চেয়ে একজন রাজনৈতিক ক্ষমতা ধর তরুণকে অনেক বেশি সমীহ করে চারপাশের মানুষ আর পরিবার। কারণ তার পেশীশক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব এখনকার সময় তাকে দেয় বিলাসী জীবন। আর সাময়িক এ মোহতে পড়ে দাবার গুটির মত তরুন ছেলেটি কেবল রাজনীতির বোর্ডে ব্যবহার হয় প্রয়োজনমত। ফলস্বরূপ সে ধারণ করতে পারে না রাজনৈতিক নেতার হবার সৎগুণাবলী। সত্যিকারের ছাত্র রাজনীতি কখনো মতের ভিন্নতার কারণে ক্রিকেটের ব্যাট দিয়ে মানুষ মারার শিক্ষা দেয় না।
আজ আবরার মায়ের বুকে যেমন শোকের আগুন জ্বলছে, তেমনই এ হত্যার সাথে জড়িত ছেলেদের মায়েদের বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা অসহনীয়। কারণ তাদের সন্তানদের কুকর্মের দায় সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে পরিবারকে। দল রাজনীতি বুঝবে না মা-বাবার কষ্ট। আর এ সন্তানগুলো ও একটিবার ভেবে দেখে না মা-বাবাদের কতটা আত্মত্যাগ করতে হয় তাদের জীবন গড়ার জন্য।
তাই এক মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন যখন আরেক মায়ের সন্তানের হাতে নির্মমভাবে খুন হলে, লজ্জিত হয় মা নামের শব্দটি। ঘটনার প্রবাহে দেশের মানুষ ভুলে গেছে বুয়েটের সনিকে। একইভাবে আবরারকেও ভুলে যাবে। কিন্তু তার মা স্কুল শিক্ষিকা রোকেয়া খাতুন স্কুলের ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের দেখে প্রতি মুহূর্তে মনে করবে নিজের সন্তানকে। আর একই সাথে আদালত প্রাঙ্গণে ইফতি তোহা মাজেদুল অমিত সাহাসহ সব অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে বইবে মৃত্যুসম সন্তান হারানোর শোক। এক মায়ের জন্য এটা কত নিদারুণ যন্ত্রনা তা কলমে প্রকাশ করা সত্যি দুর্বোধ্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)