দেশে চলমান শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, অরাজনৈতিক নয় রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমেই দুর্নীতিবিরোধী ও শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা যায়৷
তিনি দুর্নীতি প্রতিরোধে ওয়ান ইলেভেনের আশঙ্কা ও প্রয়োজনীয়তাকেও অস্বীকার করেছেন৷ একটু পেছন ফিরে তাকালে ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বর। সারাদেশে তখন আন্দোলনমুখর টানটান উত্তেজনা। নির্বাচন নিয়ে আওয়ামীলীগ – বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। এমনই একটি সংঘাতমুখর উত্তপ্ত সময়ে বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেন চলে এসেছিল। ওয়ান ইলেভেন বাংলাদেশে বিরাজনীতিকীকরণের একটি স্মরণীয় উদাহরণ৷ রাজনৈতিক দলগুলোর চরম ব্যর্থতাতেই এমন অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসার সুযোগ পায়৷
প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন যে, ওয়ান ইলেভেন দরকার নেই, আমিই অনিয়ম বন্ধ করব। তিনি আরও বলেন, রাজনীতিই পারে দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে, রাজনীতিই পারে সব আবর্জনা পরিষ্কার করতে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবহ নয় কি? তবে কি ওয়ান ইলেভেনের মত পরিস্থিতির উদ্ভব ঠেকাতেই এই দুর্নীতি বিরোধী অভিযান? আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ সহযোগী সংগঠন আজ বিতর্কিত৷
ইমেজ সংকটে পড়েছে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) উপাচার্য (ভিসি) ড. মীজানুর রহমান বলছেন, যুবলীগ ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। এই সংগঠনের ভাবমূর্তি উদ্ধারে যদি তাঁকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে তিনি সেই দায়িত্ব সাদরে গ্রহণ করবেন। ইমেজ রক্ষার জন্য একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে প্রয়োজন!এটা কি সক্রিয় যুবলীগারদের জন্য চরম ব্যর্থতা নয়?
যুবলীগের নেতৃত্বের বয়সসীমা নিয়েও কথা উঠছে৷ এক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র কি বলে?গঠনতন্ত্রে অবশ্যই যুবনেতাদের জন্য নির্ধারিত বয়স উল্লেখ থাকার কথা৷ যিনি ইমেজ সংকট দূর করতে যুবলীগের সভাপতি হতে চাচ্ছেন তার বয়সও ৬১৷
এক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র কী বলে? যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার যুবনেতা মিজানুর রহমান কি গঠনতন্ত্র সম্মত কথা বললেন?ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে ছাত্রলীগও৷ তাইত ছাত্রলীগ না করে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করার পরামর্শ দিলেন ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম কবির। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ছাতক উপজেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ হোসেন ও সিনিয়র সদস্য স্বপন দাসের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলে হেলমেট না থাকায় ৪ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা আদায় শেষে তাদের পরিচয় জানতে চাইলেএ সময় তারা নিজেদের ছাত্র নেতা বলে পরিচয় দিলে তিনি জানতে চান এর পাশাপাশি তারা কি করে।
তখন তারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত জানালে তিনি তাদেরকে ছাত্রলীগ না করে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করার পরামর্শ দেন। এবং সারাদেশেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি৷ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পরিস্থিতিও কি রাজনৈতিক সরকারের আরেকটি ব্যর্থতা নয়?
দেশে নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ।
তিনি বলেন,রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) রাজধানীতে জাতীয় শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে ‘শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বপ্নসারথী’ শীর্ষক আলোকচিত্র ও শিল্পকর্মের মাসব্যাপী প্রদর্শনী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী এ অভিযোগ করেন। ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে যখন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়, তখন হত্যার পথ বেছে নেয়। আজকেও শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে পারতো, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে ক্রমাগতভাবে তারা পরাজিত হয়েছে। তাই তারা ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে।কি সে ষড়যন্ত্র ও কারা এরা?এই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কি রাজনৈতিক না অরাজনৈতিক?
রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দুর্বলতা ও ব্যর্থতাই অরাজনৈতিক শক্তিগুলোকে আবির্ভূত হতে সাহায্য করে৷ বিগত দিনের রাজনৈতিক ইতিহাস তাই বলে৷ ২০০৬ সালে ক্ষমতাসীন বিএনপির রাজনৈতিক দুর্বলতা ও ব্যর্থতাই কি ওয়ান ইলেভেনের আগমনকে অনিবার্য করে তুলেনি?বিএনপি তখন ভাবেনি যে এমন কিছু ঘটতে পারে৷ হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে গেল ফখরুদ্দীন ও মঈন উদ্দীন গং৷তারা ক্ষমতায় এসে বলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়৷
উন্নয়নের আড়ালে দেশ আজ দুর্নীতিতে সয়লাব৷ভুয়া বিল ভাউচারে বালিশ,পর্দা, ইলেক্ট্রিক সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য আজ দেশবিদেশে আলোচিত৷লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে৷ উঁচু দালানের ছাদ হতে টাকার বস্তা ফেলে দিচ্ছে দুর্নীতিবাজেরা৷ দুর্নীতিতে লিপ্ত মন্ত্রী,এমপি, পুলিশ,আমলা৷ ক্যাসিনোর অভিযোগে আটক ব্যক্তি বলছে একজন ছাড়া আওয়ামীলীগের সকল নেতাদেরকেই টাকা দিয়েছে৷
এই যদি অবস্থা হয় দল ও সরকারের কি কোন চেইন অব কমান্ড থাকে?খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও একবার বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে আমি চিনি সকলকে টাকা দিয়ে কেনা যায় একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া৷
টাকা দিয়ে বিএনপি জামাত ও ফ্রিডম পার্টির নেতা হয়ে যায় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতা৷ এসব টাকা কে নিয়েছে?যারা টাকার বিনিময়ে দলের নেতৃত্বকেও শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারে কী ভরসা রাখা যায় তাদের উপর?আর টাকা দিয়ে মানুষ চাকরি নেয় বেতন পাবে বলে৷ কিন্তু এসব পদে কেন?এসব পদের কি কোন বেতন আছে?এইসব টাকা দেয়া ও নেয়ার লোকেরাই রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থাবোধ নষ্ট করেছে৷
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নষ্ট করেছে ভোটারদের ভোটদানের আগ্রহ৷ মানুষ এখন আর ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যেতে চায়না৷ সার্বিক অর্থেই রাজনীতির প্রতি আস্থাহীনতায় এখনই সময় দুর্নীতি রুখার কথা বলে তবে কি ওয়ান ইলেভেনের মত অরাজনৈতিক কোন শক্তির আবির্ভাব ঘটার সম্ভাবনা ছিল? তবে কি সেই সম্ভাবনাকে নাকচ করতেই এই ক্যাসিনো বিরোধী,দুর্নীতিবিরোধী তথা শুদ্ধিকরন অভিযান? ২০০৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া হয়তো তা বুঝতে পারেননি৷ শেখ হাসিনা তা বুঝতে পেরেছেন৷ এটা নিঃসন্দেহে তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা৷
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, এ অভিযান চলবে৷ দুদক তদন্ত করবে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের স্টাফদেরও৷এটা নিঃসন্দেহে পক্ষপাতমুক্ত একটি সাহসী পদক্ষেপ৷ কারা প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে নিজের আখের গুছিয়েছে?কারা প্রধানমন্ত্রীর কাছ হতে প্রকল্প নিয়ে লুটেরাদের হাতে তুলে দিয়েছে অথবা কমিশন ভোগী হয়েছে এগুলোও খুঁজে বের করতে পারবে কি এই অভিযান?
সোশ্যাল মিডিয়ায় গণজাগরন মঞ্চের নেতা, চিত্রকর কামাল পাশা চৌধুরী লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ফটোগ্রাফার সাইফুল ইসলাম কল্লোলের বাবা গোলাম আম্বিয়া মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা ফ্রিডম পার্টির সহ সভাপতি ছিল। সাইফুল ইসলাম কল্লোল ফ্রিডম পার্টির ছাত্র ফোরামের নেতা ছিল। ১৯৮৯ সালের ৫ জানুয়ারি খুনি হুদাকে সাইফুল ইসলাম কল্লোল ও তার বাবা তার নিজ গ্রাম চিতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সংবর্ধনা দিয়েছিল এবং তাদের নিজ বাড়িতে ছাগল জবাই করে খাইয়েছিল। চিতলা বাজারে তারা ফ্রিডম পার্টির খুনি মেজর বজলুল হুদার কার্যালয় বানিয়ে ছিল। কিছুদিন আগে সেটা জনগণ আগুন জালিয়ে পুড়িয়ে দেয়৷ একথা সত্যি হলে কি এই একটিই সত্যি? প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে আর কি কেউ নেই? প্রধানমন্ত্রী কি পারবেন এসব স্টাফদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে?
আওয়ামী লীগ সভাপতিকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বিষয়ে তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সত্য হলে ষড়যন্ত্রকারীদের যে কোন মূল্যে রুখে দেয়া হোক৷ ওয়ান ইলেভেনে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দুজনই গ্রেপ্তার হয়েছিল৷ তারেক রহমানকে আজও নির্বাসনেই থাকতে হচ্ছে৷আওয়ামী লীগ বিএনপির বাঘা বাঘা নেতা ছিল কারাগারে কিংবা আত্মগোপনে৷ সেই হিসাবে শেখ হাসিনাই কি পুনরায় এই বিপদ মুক্তির কান্ডারি হলেন না? এমনটি হলে শেখ হাসিনার উচিত হবে এই অভিযানটিকে সুশৃঙ্খল সমাপ্তির দিকে নিয়ে দেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্বকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে দেয়া ওয়ান ইলেভেন পারেনি, আমি পেরেছি৷ হ্যাঁ একমাত্র রাজনীতিই পারে দেশকে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন মুক্ত করতে৷
এতে দেশ বিদেশে বাড়বে রাজনীতির মান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়ে উঠবেন দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের আন্তর্জাতিক আইকন৷ তাই গণমানুষের প্রত্যাশা, আপনি এগিয়ে যান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পিছু হটবেন না৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)