ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ লিখিত বক্তব্যের বাইরে যেসব কথা বলেছেন সেগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে। এই আলোচনার একটা পক্ষ বলতে চাইছেন রাষ্ট্রপতির পদ ও অবস্থানে বসে এমন মন্তব্য তার মানায় না; আরেক পক্ষ এই বক্তব্যগুলোর মর্মার্থকে ইঙ্গিত করে বক্তব্যের মূল সুরকে আলোচনায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। এই দুই পক্ষের এক পক্ষ নিশ্চিতভাবেই পদ-পদবি আর অবস্থানের গুরুত্বকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখিয়ে বক্তব্যের বহিঃস্থ অংশকেই দেখানোর প্রয়াসী; অন্যপক্ষ সেই পদ-পদবি আর অবস্থানকে মাথায় রেখেই বক্তব্যের বিমূর্ত ইঙ্গিতের আলোচনার পক্ষপাতী।
রাষ্ট্রপতির আলোচনায় উড়ে এসে জুড়ে বসা রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বলিউড অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার আলোচিত বিয়ের প্রসঙ্গও এসেছে। এই বিয়ে প্রসঙ্গে নিজের স্বভাবজাত রসিকতার আশ্রয় নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, এবং নিজেকে একটা পক্ষ হিসেবেই উপস্থাপন করে। এতে হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে উপস্থিতিদের মাঝে। উপস্থিতজন এ থেকে আনন্দ পেয়েছেন, রাষ্ট্রপতি নিজেও আনন্দ পেয়েছেন; এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা গণমাধ্যম মারফত জেনে আমরাও আনন্দ পেয়েছি।
প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার বিয়ে প্রসঙ্গে আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘কিছুদিন আগে প্রিয়াঙ্কা দেশে এসেছিল। বাংলাদেশে দেশের বাইরে থেকে যতো রাষ্ট্রপতি, গণ্যমান্য ব্যক্তি আসেন তাদের সবাই শেষ দেখা করতে আসেন গণভবনে। প্রিয়াঙ্কা যেদিন আসবে তার আগের দিন আমার স্ত্রীকে বললাম এবার তো প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আসবে। তারপর আর প্রিয়াঙ্কা আসলো না। পরে শুনেছি, আমার স্ত্রী নাকি টেলিফোন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছে, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার বঙ্গভবনে আসার কী দরকার! প্রিয়াঙ্কা যাওয়ার কিছুদিন পরই জানতে পারলাম প্রিয়াঙ্কা নাকি আমেরিকা গিয়ে তার চেয়ে বয়সে ১০-১২ বছরের ছোট নিক না কি জানি নাম এক ছেলেকে বিয়ে করেছে। এখন আমি তো তার ৩০ বছরের বড়। সে যদি ১০ বছর নিচে নামতে পারে তাহলে ৩০ বছরের উপরেও তো সে উঠতে পারতো। এ ধরনের একটা সুযোগ নষ্ট করে তো সে ঠিক করে নাই!’
এই বক্তব্য প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চমৎকার মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মাসকাওয়াথ আহসান। তার ভাষায়, ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ ছবির শিক্ষককে দেখা যায় তার ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে ঠিক এমন আলোচনা করতে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার খুব প্রিয় একজন পণ্ডিত শিক্ষক দেখা হলে কোনদিন একটু গুছানো সাজ-পোশাকে দেখলেই জিজ্ঞেস করতেন, কী হে আজ কোন ডেট আছে নাকি! এই সাবলীল সম্পর্কের মাঝ দিয়ে প্রজন্ম ব্যবধানকে গুঁড়িয়ে দেবার ক্ষমতা যাদের থাকে; রাষ্ট্রপতি হামিদ তাদের মতো একজন। এমন শিক্ষকই প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো কারাগার নয়; এ হচ্ছে আনন্দযজ্ঞ। আনন্দের মাঝ দিয়ে শিক্ষাই অর্থবহ শিক্ষা।’
এই রসবোধ যেকোনো মানুষের আলাদা গুণ। সবার থাকে না। রাষ্ট্রপতির সেটা আছে, এবং সেটা আগে থেকেই। জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকাকালে তার সেই গুণটা দেশবাসীর সামনে আসে, এবং রাষ্ট্রপতি হয়েও সেটা বহমান।
অবশ্য যে পক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের মত অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির এমন হাস্যরসাত্মক বক্তব্য নাখোশ তাদেরও জানা থাকা জরুরি সমাবর্তনের মূল বক্তা ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি মূল বক্তা নন, এর মানে এই নয় যে তার বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়; সেটাও গুরুত্বের। মননশীল আলোচনা ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামানের সেই বক্তব্য আলোচনার দাবি রাখে, অথচ বাস্তবতা হলো অধিকাংশের কাছে সেটা অনুপস্থিত। হয়ত অনেকেই আনিসুজ্জামানের বক্তব্য শুনেননি কিংবা পড়ে দেখার প্রয়োজনটুকুও মনে করেননি।
এই হাস্যরস-রসবোধ কিংবা কৌতুক প্রবণতা যেকোনো বক্তার বক্তব্যে উপস্থিতির মনোযোগ আকর্ষণের সহায়ক হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ফলে কেবল রসিকতা অংশই নয়, পুরো বক্তব্যই সুধীজনদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে বলে বিশ্বাস করি। এ প্রসঙ্গে কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের ফেসবুকে কদিন আগের এক লেখা মনে ধরেছে খুব। তিনি গত ৫ অক্টোবর লিখেছেন, ‘কবি মোহাম্মদ সাদিককে আমি বছর দশেক আগে অ্যাডমিন একাডেমিতে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম। তিনি ঐ সময় ম্যানারের উপরে আমাদের বেশ কিছু ক্লাস নিয়েছিলেন। প্রথম দিন ক্লাসে এসেই তিনি অন্য একজনকে কোট করে বলেছিলেন, ‘আমি ছাব্বিশ বছর সংসার করেও আমার বউরে শিখাইতে পারি নাই কিভাবে মশা না ঢুকাইয়া মশারি টানাইতে হয়, সেই আমি তোমাগো শিখাবো ম্যানার?’
শিক্ষক কিংবা অনুসরণীয় ব্যক্তিদের এমন কিছু বক্তব্য শিক্ষার্থী অথবা অনুসরণ-প্রত্যাশীদের মাঝে এভাবেই প্রভাব বিস্তার করে। তাই এই হাস্যরসাত্মক কথাবার্তাগুলো কোনোভাবেই কারও ব্যক্তিত্বের ও পদাসীনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় না।
এবার ফিরে দেখা যেতে পারে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের মধ্যকার অন্য দিকগুলো। ঢাবির ওই বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতম দিকের দিকেও দৃষ্টিপাত করেছেন। সারাজীবন রাজনীতি বিযুক্ত থেকে রাজনীতিতে একটা সময়ে উড়ে এসে জুড়ে বসা ব্যক্তিদের নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। বলছেন, ‘যদি রাজনীতি করতে চান তবে লেখাপড়া শেষ করে অন্য কোনো চাকরি না নিয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ুন। আগে হাতেখড়ি ছাড়া রাতারাতি রাজনীতিবিদ হওয়া ঠিক নয়। যারা তরুণ বয়স থেকে রাজনীতি করবেন, রাজনীতিতে তাদেরই অগ্রাধিকার থাকা উচিত।’
‘পেশাভিত্তিক পার্লামেন্টে’ গুরুত্ব দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। বলছেন আদর্শভিত্তিক রাজনীতির কথা। এ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য, ‘ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণ আদর্শভিত্তিক। সেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠির স্বার্থ মুখ্য ছিল না।’ এগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখলে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এর অনুশীলন হলে দেশের রাজনীতির খোলনলচেই পালটে যাবে বলেই বিশ্বাস।
আমাদের বর্তমান সংসদ কিংবা এর আগের কয়েকটা সংসদের দিকে তাকালে দেখা যাবে রাজনীতিবিদদের চাইতে পেশাজীবী কিংবা ব্যবসায়ীদের আধিক্য। এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। আমলা, পুলিশেরা অবসরে জীবনে যাওয়ার পর রাজনীতিতে নেমে অবসর সময়টা কাটিয়ে দিচ্ছেন, অথবা সংসদে যাচ্ছেন। ফলে রাজনীতিবিদদের কাছেই রাজনীতি দূর গ্রহ-সম হয়ে পড়ছে। জীবনভর তৃণমূলে রাজনীতি করে দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন এমন কেউ যিনি এতদিন রাজনীতিবিযুক্ত ছিলেন। স্রেফ দলীয় আনুগত্য আর দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের কেন্দ্র ঘোষিত শাস্তির হুমকি কিংবা ভয়ের কারণে মুখ খুলতে পারছেও না অনেকেই। ফলে দলীয়ভাবে গণতন্ত্রের অনুশীলনের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। একই সঙ্গে উড়ে এসে জুড়ে বসাদের মাধ্যমে জনমানুষের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিও সঠিকভাবে ওঠে আসছে না। এই প্রবণতা ক্রমে মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
আমলা, পেশাজীবী, আত্মীয়স্বজনের কাছে রাজনীতি কেন্দ্রীভূত হওয়ার এই প্রবণতা রাষ্ট্রপতিকেও আলোড়িত করছে। তিনি স্বভাবসুলভ রসিকতার সুরে বলছেন তাই সিরিয়াস কথাটাই। বলছেন তিনি, ‘পুলিশের ঊর্ধ্বতন ডিআইজি, আইজিরাও রাজনীতি করবেন। মনে মনে কই, রাজনীতি করার সময় এই পুলিশ তোমার বাহিনী দিয়ে পাছার মধ্যে বারি দিছো, তুমি আবার আমার লগে আইছো রাজনীতি করতে। কই যামু। রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এই যে রাজনীতিবিদদের সমস্যা এই সমস্যার কারণও এটা।
বিজনেসম্যানরা তো আছেই… শিল্পপতি-ভগ্নীপতিদের আগমন এভাবে হয়ে যায়। এগুলো থামানো দরকার। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে উল্লেখ ‘পাছায় বাড়ি’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে হাস্যরসের ইঙ্গিত আছে, কিন্তু এটাইত বাস্তবতা, এবং এরাই একদিন রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে রাজনীতিবিদ সেজে বসে আছেন। এতে করে আমাদের রাজনীতি ক্রমান্বয়ে রাজনীতিবিদদের থেকে দুরে সরছে। ‘এগুলো থামানো দরকার’ বলছেন রাষ্ট্রপতি, আমরাও অনুধাবন করছি সেটা, একই সঙ্গে হাসছিও। কারা থামাবে? যারা থামানোর কর্তৃপক্ষ তারাওতো আমাদের মত হাসছে, অথবা অন্য অনেক কথার মত এই কথাকেও গুরুত্বহীন ভেবে বসে আছে, অথবা ক্ষণিকের ভাবনায় এটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন করে বসে আছে।
রাষ্ট্রপতির সরস কথাগুলো আমাদের বিরস মনে হাসির উদ্রেক করছে কেবল, কিন্তু এর মর্মার্থ অনুধাবনে আমরা যারা সক্ষম কিংবা অক্ষম তাদের মধ্যে এ নিয়ে ভাবান্তর সামান্যই। আমরা দেখছি রসিকতা আর কৌতুক, অথচ এগুলো এতখানি হালকা কথামালা নয়। আমাদের দরকার এর মর্মার্থ অনুধাবনে সংশ্লিষ্টদের বাস্তবায়ন চেষ্টা। দুঃখের কথা হচ্ছে, চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বরূপ সন্ধানের ইঙ্গিত ও উত্তরণ বিষয়ক তার এই কথাগুলোও অনালোচিত থেকে যাবে, হারিয়ে যাবে বিবিধ প্রাত্যহিকতায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)