সংযমের মাস রমজান আসন্ন। বিচিত্র এই দেশে রমজান একা আসে না; সঙ্গে নিয়ে আসে নানা কিসিমের নানা আয়োজন। বাহারি ইফতার থেকে শুরু হয়ে উপুর্যপরি কেনাকাটা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাজারে উপচে পড়া ভিড়, টেলিভিশন চ্যানেলে নানা অনুষ্ঠান আরো কতো কি! সবকিছুর ভিড়ে শেষ পর্যন্ত থাকে না ঐ রমজানটাই! আরো স্পষ্ট করে বললে, সংযমটাই।
অথচ পুরো এক মাস জুড়ে মুসলমানদের জন্য রোজা পালন করার কথা বলা হয়েছে মূলত সংযম শেখানোর জন্য। কথায় সংযম, জীবনাচরণে সংযম, খাদ্যে সংযম- এসবের মধ্য দিয়ে যেন শ্রষ্টার আরো কাছাকাছি যাওয়া যায় সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এই সিয়াম সাধনা। কিন্তু পুঁজিবাদের ক্রমাগত বিস্তারের কারণে রোজার মতো একটি তাৎপর্যপূর্ণ এবং একান্তই ব্যক্তিগত ইবাদতকেও “পণ্য” বানানো হয়েছে। রোজা এখন এই দেশে বাণিজ্যের বড় উপলক্ষ। অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে রোজার সময় দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসের দাম কমে। বাংলাদেশে দাম বেড়ে চলে যায় নাগালের বাইরে। পাইকাররা সারা বছর ধরে অপেক্ষা করেন কখন রমজান আসবে, মুনাফার পালে লাগবে উদ্দাম হাওয়া! রমজান আত্মশুদ্ধির উপলক্ষ হয় না; হয় অর্থবৃদ্ধির হাতিয়ার। আল্লাহ পাক বলেছেন, “তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও। এর মধ্য দিয়ে তোমরা আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে পারবে।” আত্মশুদ্ধির চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে আমরা নেমে পড়েছি অর্থ অর্জনের অশেষ প্রতিযোগিতায়।
ফাইভ স্টার হোটেল থেকে শুরু করে পাড়ার ছোট্ট দোকানটিও ইফতারির বাহারি পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। যেন রোজা মানেই খাওয়া! অশেষ আয়োজন! সারা বছর ধরে যে দোকানটিতে আপনি বেশন কিংবা রুহ আফজা দেখবেন না, রমজান শুরুর দু’একদিন আগে থেকেই সেই দোকানে বেশমের প্যাকেট, রুহ আফজার কাঁচের বোতল! মনে করবার কারণ নেই- দোকানী সওয়াবের আশায় এগুলোর আয়োজন করেছে। এর পেছনে স্পষ্টতই রয়েছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য। এলাকার বেকার ছেলেটিকে রোজা এলেই হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠতে দেখবেন। কয়েকজন বন্ধু মিলে টমের দোকানের মতো একটি অস্থায়ী দোকান বানিয়ে বিক্রি করছে ইফতার সামগ্রী! তার কাছেও রোজা দেখা দেয় “পণ্য” হয়ে। লাভের টাকা দিয়ে সে ঈদের কেনাকাটা করবে। কিশোর যুবকদের আরেকটি অংশ থাকে যারা নানা রকম গান ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভোররাতে এলাকায় ঘুরে ঘুরে সেহরি খাওয়ার জন্য লোকদের ঘুম ভাঙ্গাবে। আপাতদৃষ্টিতে কাজটি ভালো মনে হলেও এটি অপ্রয়োজনীয়। এখনকার ডিজিটাল সময়ে লোকদেরকে ঘুম থেকে জাগানোর নানা ব্যবস্থা রয়েছে। মূলত এটিও এক ধরনের বাণিজ্যিক “ইবাদত!” সেটি স্পষ্ট হয় ২৭ রমজানের পরপরই এই গ্রুপটিতে যখন আপনার বাসার দরজায় নক করে। আপনার কাছে টাকা চায়। টাকার উদ্দেশ্যে/টাকায় বিনিময়ে যেটি করা হয় সেটি আর যা-ই হোক; ইবাদত হতে পারে না। অর্থাৎ তাদের কাছেও রোজা “বাণিজ্যের” মৌসুম।
এবং রোজার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে রাজনীতিও! প্রতিবছর প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল রমজান মাসের প্রায় প্রতিটি দিন ফাইভ স্টার হোটেল কিংবা এরকম অন্য কোথাও ইফতার পার্টির আয়োজন করে। এসব পার্টিতে (এতিম শিশুদের জন্য বরাদ্দ একদিন বাদ দিলে) তাদেরকেই ইফতার করানো হয় যাদের টাকার অভাব নেই। এই পার্টিগুলোর যত না উদ্দেশ্য থাকে ইফতার, তার চেয়ে বেশি থাকে রাজনীতি। রাজনীতির হাত থেকে এ দেশে কিছুই রেহাই পায় না; এমনকি রোজাও না! প্রতিটি ইফতার পার্টিতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তা দিয়ে কতো না-খেয়ে থাকা মানুষকে ইফতার করানো যেত, সত্যিকারের অভাবীদের সাহায্য করা যেত!
রমজান এলেই অবধারিতভাবে বেড়ে যাবে পণ্যের দাম। বিশেষ কিছু পণ্যের দাম প্রতিবছর নিয়ম করেই বেড়ে যাবে। যেমন: পেঁয়াজ এবং বেগুন। এর সঙ্গে গরুর মাংসকেও যুক্ত করা যায়। ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অন্যায় করছেন। আমরা ভোক্তারা কি কোনো অন্যায় করছি না? আমরাই বা রমজান মাসে এতো খেতে চাই কেন? সারাদিন না খেয়ে থেকে সারা সন্ধ্যা-রাত জুড়ে খাওয়ার মধ্যে সংযম কোথায়? ইফতার তো একটি ইবাদত; কোনো উৎসব নয়। আমরা এটাকে বানিয়ে ফেলেছি উৎসব। সেই “উৎসবের” উদযাপনে কত বর্ণিল আয়োজন! আযানের সঙ্গে সঙ্গে খেজুর কিংবা শরবত দিয়ে শুরু, এরপরে কয়েক পদের খাবার শেষে নামাজের বিরতি। নামাজ শেষে আরেক দফা, যেখানে থাকে মুড়ি-ছোলা-বুট কিংবা হালিম, কোথাও কোথাও বিরিয়ানি! সারাদিন রোজা রেখে যত না ক্লান্ত, তার চেয়ে বেশি ক্লান্ত হই ইফতারির খাবার খেতে খেতে! ত্যাগের মাস যে রমজান তার সামান্যই উপস্থিত থাকে আমাদের খাদ্যাভ্যাস এবং দিনযাপনে।
বাণিজ্যিকীকরণের দৃষ্টিকটু আবরণে মুড়িয়ে ফেলা হয়েছে পবিত্র রমজানকে। রমজান এলেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি নানা ইভেন্ট খুলে রমজানের ভাবগাম্ভীর্যকে নষ্ট করে। “এই রমজানে এই অফার” স্লোগান দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, রমজান যেন কেনাকাটারই মাস! টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পরিবেশন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। বাজার ঘুরে ঘুরে ইফতারির নানা আয়োজন দেখানো হয়, ঈদের কেনাকাটার লাইভ প্রচার করা হয় প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে। ইফতারির নানা পদের রেসিপি নিয়েও অনুষ্ঠান থাকে। এগুলোর কোনোকিছুই রমজানের মৌলিক তাৎপর্যের সঙ্গে মানানসই নয়।
অথচ একটি খেজুর আর এক গ্লাস পানি দিয়েও ইফতার করা যায়। থাকলেই খেতে হবে কেন? আমার আছে কিন্তু আমি সবকিছু খাচ্ছি না- এটাই তো আসল ত্যাগ। ইফতারির পেছনে বাড়তি খরচ না করে সেই টাকা গরীব আত্মীয়-স্বজনকে দান করা যায়। অভাবী মানুষকে দেওয়া যায়। এতিমখানায় ইফতার করানো যায়। চাইলে করা যায় কতকিছুই! অনেকেই যাকাতের টাকা দিয়ে এগুলো করেন। কিন্তু যাকাতের টাকা তো গরীবেরই টাকা। সেটা তাদের অধিকার। দান তো করতে হয় নিজের টাকা দিয়ে।
বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদের যাঁতাকলে পড়ে আমরা বহু আগেই পণ্যের উপাসক হয়ে গিয়েছি। ধর্ম এবং ইবাদতের বিষয়গুলো যেন বাণিজ্যিকীকরণের ছোবল থেকে মুক্তি পায়। সত্যিকারের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে রমজানের রোজা পালন করতে পারলে তাতে কল্যাণ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথই প্রশস্ত হয়। বৈষম্যহীন পরিশুদ্ধ এক সমাজ প্রতিষ্ঠার দীক্ষা নিয়ে উদযাপিত হোক এবারের রমজান।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)