চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

রমজানে আল্লাহ তায়ালার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার কুরআনের অবতরণ

“এটি রমজান মাস; যাতে আমি কুরআন নাজিল করেছি মানুষদের হেদায়াতের জন্য”।(সুরা বাকারা: ১৮৫)
ঐশীবাণী পবিত্র আল-কুরআনের অবতরণ, তার উদ্দেশ্য এবং নাজিলকৃত মাসের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা উপরের আয়াতটি নাজিল করেন। যাতে বলা হয়েছে কুরআন নাজিল হয়েছে পবিত্র রমজান মাসে। যা স্পষ্ট হয়ে যায় সুরা কদরের প্রথম আয়াতের মাধ্যমে।

ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয় আমি (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি কদর রজনীতে’। আর হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট যে, কদর রজনী রমজানের ভেতরেই। যেমনটি বুখারি শরিফের ১১৫৮ নং হাদিসে এসেছে, “সাহাবাগণ আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট স্বপ্নের বর্ণনা দিলেন যে, ‘লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকের সপ্তম রাতে’। তখন নবীজি বললেন, ‘আমি মনে করি যে, তোমাদের স্বপ্নগুলোর মধ্যে পরস্পর মিল রয়েছে। কাজেই যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান করতে চায়, সে যেন তা শেষ দশকে অনুসন্ধান করে।”

কথা হলো, পবিত্র কুরআন তো ২৩ বছর যাবৎ নাজিল হয়েছে। আয়াতে কেবলই রমজান বা শবে কদরকে নির্দিষ্ট করা হলো কেন? এর ব্যাখ্যায় তাফসিরে ইবনে আব্বাস, ইবনে কাসির, জালালাইন-সহ বহু তাফসিরে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, পবিত্র কুরআন ছিল(এখনও আছে) লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত অবস্থায়। যেমনটি বলা হয়েছে, ‘এটিই সে কুরআন; যেটি লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত’ (সুরা বুরুজ)। সেখান থেকেই রমজানের শবে কদরে পুরো কুরআন একত্রে দুনিয়ার আসমানের বায়তুল মামুরে নাজিল হয়। অতঃপর ধীরে ধীরে প্রয়োজনানুসারে পৃথিবীতে নাজিল হতে থাকে। যার ব্যাপ্তি প্রায় তেইশ বছর।

মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন হিসেবে স্বীকৃত এ কুরআনের অবতীর্ণ প্রথম শব্দেই রয়েছে জ্ঞান অন্বেষণের হুকুম। ইরশাদ হচ্ছে, “ইকরা বিসমি রাব্বিকাল লাজি খালাক—পড়ুন, আপনার পভুর নামে; যিনি সৃষ্টি করেছেন।” অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তা প্রভুর নাম নিয়ে জ্ঞান অন্বেষণে উদ্যোগী হও। অতঃপর কুরআনের শুরুতেই নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে ‘এটি সেই কিতাব; যেটিতে কোনো সন্দেহ নেই’ বলে। পুরো কুরআনকে সাজানো হয়েছে ব্যঞ্জনাময় করে। পাঠকের যাতে শৃঙ্খলাভঙ্গ না-হয় সেজন্য বিভক্ত করা হয়েছে ১১৪টি সুরায়। মাসের দিনের সাথে মিল রেখে ৩০ পারার সুশৃঙ্খল অবয়ব গঠন কুরআনের আরেক সৌন্দর্য।

হেদায়তের ঘোষণা নিয়ে আসা কুরআনের চর্চাকে বেগবান করেছে শিক্ষকরূপে প্রেরিত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কালজয়ী এই বাণীটি—“তোমাদের মাঝে সেই ব্যক্তিই সবচে’ উত্তম; যে কুরআন শেখে এবং অপরকে শেখায়।” —বুখারি। প্রতি হরফে দশ নেকি তো আছেই; এ-ছাড়াও কুরআন তিলাওয়াতকে বলা হয়েছে, ‘আফদ্বলুল ইবাদাত’ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত। বিদায় হজের মহান ভাষণেও নবীজির মুখনিঃসৃত মহান বাণী ছিল—“তোমাদের মাঝে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে কেউ পথভ্রষ্ট হবে না। যার একটি হলো কুরআন, অপরটি আমার সুন্নাহ”। (বুখারি: ১৫০১)।

ঠিক এর পরের হাদিসেই এসেছে সুস্পষ্ট ঘোষণা: এই কুরআন সুপারিশকারী। এর সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। যে ব্যক্তি এর অনুসরণ করবে, সে তাকে জান্নাতের পথ প্রদর্শন করবে। আর যে তাকে বর্জন করবে অথবা তা থেকে বিমুখ হবে, তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”

প্রসঙ্গত কুরআনের প্রথম সুরার নাম ‘বাকারা’। যার অর্থ স্ত্রী-জাতের গরু। আর শেষ সুরার নাম ‘নাস’। যার অর্থ মানুষ। বিজ্ঞজনেরা বলেছেন, এ থেকে রূপকার্থ হচ্ছে, কুরআনের শিক্ষা শুরু করার মুহূর্তে যদি কেউ পশুর মতোও থাকে, শেষ করতে করতে সে পূর্ণাঙ্গ মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠবে। সুরা ইয়াসিনকে বলা হয়েছে কুরআনের রুহ। আবার সুরা ফাতিহার অপর নাম ‘উম্মুল কুরআন’ তথা কুরআনের জননী। এ সুরাকে সমগ্র কুরআনের সারসংক্ষেপও বলা হয়ে থাকে। এভাবেই কুরআনের প্রতিটি সুরা এক বা একাধিক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ঘেরা। কেবলই সুরা নয়; বরং প্রতিটি আয়াতেই রয়েছে অগুনতি নিদর্শন। রয়েছে প্রতিটি শব্দের অন্তর্নিহিত গূঢ়ার্থ-সমগ্র।

এ উম্মতের কল্যাণের নিমিত্তে যেটি দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে খোদা তায়ালার স্পেশাল উপহার হিসেবে নাজিল হয়েছে, সেটি আজ মলাটবদ্ধ। পাওয়া যায় যে-কোনো স্থানেই। চাইলেই পড়া যায়, উল্টানো যায়, গবেষণায় মত্ত হওয়া যায়। কিন্তু আপসোস! ঘরের এককোণে পুরোনো কোনো কাপড়ে পেঁচানো অবস্থায় থেকে যায় বছরের পর বছর। খোদা তায়ালা কত মনোহর বাণী সেখানটাই ঝিকঝিক করছে—খোলে আর দেখা হয় না। আমরা ভুলে গেছি, এ-কুরআন কেবল মানুষ মরলে মাচা থেকে নামিয়ে সূরা ইয়াসিন পড়ার জন্য অবতীর্ণ হয়নি; হয়েছে পুরো মানবজীবন যাবতীয় কল্যাণের ঘোষণা নিয়ে।

যেই মাসে কুরআনের অবতরণ, সেই মাস প্রায় শেষের পথে। অতএব, এখনই সময়, কুরআনের দিকে মনোযোগী হবার। এখনই সময় কুরআনকে অনুধাবনের চেষ্টা করার। সময় যে বয়ে যায়! স্রোতের মতো সেও ফেরত আসে না।