হালাল রিজিক তালাশ করা ইসলামের অন্যতম ফরজ দায়িত্ব। রাসূল সা. বলেছেন, ‘হালাল উপার্জন করা অন্যান্য ফরজ ইবাদতের পর ফরজ।’ (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান: ৮৩৬৭) সকল নবী-রাসূল হালাল উপার্জন করতেন। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি অলস বসে সময় ব্যয় করলে তার হিসাবও আল্লাহ পাকের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। আল্লাহ পাক আদেশ দিয়েছেন, ‘যখন নামাজ সমাপ্ত হবে, তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করবে।’ (সূরা জুমুআ: ১০) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী র. বলেন, ‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যাবে, তখন তোমরা ব্যবসায়ীক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজন পূরণে বের হয়ে পড়ো।’ (কুরতুবী: ১৮/৯৬)
হালাল উপার্জনের সকল যে সকল মাধ্যম আছে, তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। রাসূল সা. বলেছেন, ‘তোমরা ব্যবসা করো। কেননা রিজিকের দশ ভাগের নয় ভাগ ব্যবসার মধ্যে রয়েছে।’ (আল মুগনী :১/৪১৯) ব্যবাসায়ীদের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণের সাথে জান্নাতী হবেন।’ (তিরমিজী: ১২০৯)
মাহে রমজান মুসলমানদের জন্য যেমন ইবাদতের বসন্তকাল, তেমনি এটা পার্থিব ব্যবসা-বাণিজ্যেরও একটি মৌসুম। আসন্ন সিয়াম-সাধনা, সাহরী, ইফতার, ঈদ ইত্যাদি নানা উৎসবের আয়োজনও মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে করা হয়। অন্যান্য যে কোনো সময়ের চেয়ে মানুষ এ সময়টাকে বেশি বাজারমুখী হন। ব্যবসার প্রতিটি সেক্টরেই তখন ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়, যা ঈদ রাত পর্যন্ত থাকে। তাই স্বভাবতই বলা যায়, এটা ব্যবসায়ীদের জন্যও একটি সৌভাগ্যের মাস।
রমজান এলেই বিশেষ করে আমাদের দেশের কিছু ব্যবসায়ীরা বেপড়োয়া হয়ে যান। মিথ্যা শপথ করা, ওজনে কম দেওয়া, দাম বাড়িয়ে দেওয়া, মুজুতদারী করা, খাদ্যে ভেজাল দেওয়া থেকে শুরু করে এহেনও নেককার জনক কাজ নেই, যা তারা করেন না। রোজার আগে আগেই রমজানের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশ স্পর্শ করা শুরু করে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তসহ গরীব শ্রেণীর সকল মুসলমানদের জন্য রমজানের বাজার হয়ে যায় এক অভিশাপের নাম। সাহরী ও ইফতারের প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম তখন নাগালের বাহিরে চলে যায়। ঈদের মার্কেট করতে গেলেও একই অবস্থা বিরাজ করে। পরিবারের সদস্যদের জন্য জামা-পোষাক কিনতে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস ওঠে।
ইসলাম ব্যবসায়ীদেরকে এ সকল গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। বিশেষ করে রমজান মাসে যখন ক্রেতাদের একান্ত প্রয়োজন তখন সকল ব্যবসায়ীদের ইসলামের এ সকল নির্দেশ মান্য করা একান্ত কর্তব্য। ইসলাম ব্যবসায়ীদের জন্য যে সকল নির্দেশনা দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে,
১. মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। কেননা, মিথ্যা সকল পাপের মূল। মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করা ইসলাম সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। কেননা এ মিথ্যা বান্দার হকের সাথে সম্পৃক্ত। যদি ক্রেতাকে মিথ্যা শপথের মাধ্যমে ঠকানো হয়, তবে আল্লাহ সে অপরাধকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণ করো না এবং জেনে-শুনে সত্যকে গোপন করো না। (সূরা বাকারা: ৪২) রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক কথা বলবেন না, রহমতের নজর দেবেন না এবং তাদেরকে মুক্তি দেবেন না; বরং তাদের জন্য থাকবে মর্মন্তুদ শাস্তি। সাহাবায়ে কেরাম তাদের পরিচয় জানতে চাইলে নবী পাক সা. জানালেন, যারা টাকনুর নীচে পোষাক পরিধান করে, যারা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করে এবং যারা চোগলখোরী করে।’ (আবূ দাউদ: ৪০৮৯)
২. ওজনে কম দেওয়া যাবে না। অন্যকে দেওয়ার সময় ওজনে কম দেওয়া আর নিজের বেলা বেশি নেওয়া জঘন্য অন্যায়। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘পরিমাপে কম প্রদানকারীদের জন্য ধ্বংস, যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় বা ওজন করে, তখন কম দেয়।’ (সূরা মুতাফ্ফিফীন: ১)
৩. কারো ক্ষতি করা যাবে না। ব্যবসা হবে পরস্পর উপকারের জন্য। কারো ক্ষতি করার চিন্তা থাকলে সে ব্যবসায়ী নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাসূল সা. বলেন, ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা কোনোটিই সমীচীন নয়।’ (ইবনে মাজা: ২৩৪০)
৪. ধোকা ও প্রতারণা করা যাবে না। রাসূল সা. বলেছেন, ‘যে আমাদেরকে ধোকা দিবে, সে আমাদের দলভূক্ত নয়।’ (মুসলিম: ২৯৪) হাদীস শরীফে রয়েছে, রাসূল সা. একবার বাজারে বের হয়ে দেখলেন, এক ব্যবসায়ীর খাদ্যের উপরের অংশ শুকনো, কিন্তু ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেখলেন তা ভেজা। নবী পাক সা. তখন বললেন, তুমি কেন ভিতরের খাদ্যকে উপরে রাখলে না, যাতে কেউ ধোকায় না পড়ে।
৫. মজুদদারী করা যাবে না। রাসূল সা. বলেন, ‘যারা মুজুদদারী করে, তারা অভিশপ্ত। আর যারা মানুষের কাছে পণ্য সহক করে পৌঁছে দেয়, তারা রহমতপ্রাপ্ত।’ (কানজুল উম্মাল) সংযমের মাস রমজানের শুরুতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এমন সব পণ্যের দাম বেড়েছে, যেগুলো আমদানী করতে হয় না; বরং দেশেই উৎপাদন হচ্ছে এবং এর সরবরাহও প্রচুর পরিমাণে আছে। রমজানে ব্যবসায়ীদেরকেও সংযমের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল করলে ব্যবসায়ীরা জান্নাতী হবেন কোনো সন্দেহ নেই। তা নাহলে হাদীস শরীফে এটাও রয়েছে, রাসূল সা. বলেন, ‘অনেক ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন পাপীদের কাতারে দন্ডায়মান হবে।’ (তিরমিজী: ১২১০)
লেখক: মাওলানা মোহাম্মদ বদরুজ্জামান রিয়াদ