‘আসলে আমি গান গাইতাম। ১০ বছর থেকেই গান শেখা শুরু হয়। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম। আমার বাবা বাসায় রেকর্ড প্লেয়ার শুনতেন। সেখানে অনেক বিখ্যাত শিল্পীর গান বাজতো। আমি এক কান দিয়ে শুনতাম, অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যেত। কিন্তু ব্যাতিক্রম ঘটলো একটা জায়গায়। আমি থমকে গেলাম কাজী সব্যসাচীর কণ্ঠে। বলা যায় তিনি বশ করে ফেললেন আমাকে। সেই থেকে আবৃত্তির প্রতি শুরু হলো এক ধরনের ভালো লাগা। তখন চেষ্টা করতাম ওনার মতো করে আবৃত্তি করতে।’ আবৃত্তিশিল্পী হয়ে ওঠার গোড়ার দিকের গল্প এভাবেই বলেলেন কাজী আরিফ। গত বছর ‘কাজী সব্যসাচী স্মৃতি পুরস্কার’ পাওয়ার পর দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স বিডি ডটকমকে এক সাক্ষাৎকার দেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা, আবৃত্তিশিল্পী ও স্থপতি কাজী আরিফ (৬৪) এখন ক্লিনিক্যালি ডেড। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মাউন্ট সেইন্ট লুকস হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত ২৬ এপ্রিল এই হাসপাতালে দ্বিতীয় বারের মতো তার হৃদপিন্ডে অস্ত্রোপচার করা হয়।
কাজী আরিফের হার্টের বাল্ব অকেজো হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাল্ব পুনঃস্থাপন এবং ধমনীতে বাইপাস অস্ত্রোপচার করার পর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তাকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে নেওয়া হয়।
কাজী আরিফকে দিয়ে যে আবৃত্তি ভালো হবে, সেটা বোঝা গিয়েছিল অনেক আগেই। তিনি বলেন, ‘১৯৬৮ সালের কথা। একটা অনুষ্ঠানে উপস্থাপক আসেনি তাই আমাকে তুলে দেওয়া হলো উপস্থাপনা করতে। আমি রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম বলে তাদের ধারণা হয়েছিল আমি উপস্থাপনা করতে পারব। হলোও তাই। তখন অনেকেই বলেছিল, আমার কণ্ঠ আবৃত্তির মতো। কিন্তু আবৃত্তির শুরু হলো আরও অনেক পরে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। যুদ্ধ শেষে ক্লাস শুরু করলাম বুয়েটে। তখনই প্রবলভাবে শুরু হয় আবৃত্তিটা।’
কাজী সব্যসাচীর সরাসরি ছাত্র ছিলের কাজী আরিফ। বললেন, ‘১৯৭৩ সালে তার সঙ্গে দেখা হয়। ওনাকে আবৃত্তি করে শোনালাম। সেই থেকে শুরু হৃদ্যতা। এবার তিনি নিজেই মাঝে মাঝে যেতে বললেন আমাকে। আমি নিয়ম করে চলে যেতাম ধানমন্ডির নজরুল ভবনে। গুরুর সামনে আবৃত্তি করতাম কবিতা। ভুল হলে তিনি শুধরে দিতেন। এভাবেই শেখা ওনার কাছ থেকে।’
১৯৮০ সালে বাংলাদেশে প্রথম যে আবৃত্তির অ্যালবাম বেরিয়েছিল, সেটা ছিল কাজী আরিফের। নাম ‘পত্রপুট’। এরপর তার আবৃত্তির ১৭টা অ্যালবাম বেরিয়েছে বিভিন্ন সময়।
অ্যালবামের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বললেন, ‘১৯৮৫ সালে পত্রপুট শুনতে দেই কবি অন্নদাশঙ্কর রায়কে। তিনি শুনে আমাকে বললেন, গলা থেকে সব্যসাচীকে বের করে দাও, নিজের আবৃত্তিটা করো। তখন থেকেই আমার গলা থেকে নামলেন গুরু। কিন্তু মাথার উপরে, বুকের ভেতরে সব জায়গাতেই থেকে গেলেন কাজী সব্যসাচী।’