যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল অরেগনের প্রাইনভিল, উচ্চ বেকারত্বের হারে জর্জরিত ছিলো শিল্প শহরটি। পরিবর্তনের ঢেউ তুলে ফেসবুক যেখানে প্রাণ এনেছিলো। ফেসবুকের ডাটা সার্ভারের প্রয়োজনীয়তাই এর দুর্দশা কাটায়।
বর্তমানে ফেসবুকের তিনটি ডাটা সেন্টার রয়েছে প্রাইনভিলে, বিশ্বজুড়ে রয়েছে আরও ছয়টি। অ্যাপলও প্রাইনভিলে এসেছে। তারা সেখানে তাদের ৩টি ডাটা সেন্টার নির্মাণ করেছে।
বর্তমান বাস্তবাতায় জমজমাট-ব্যস্ত চিত্র উপলব্ধিতে আসলেও কদিন আগেও ধুঁকছিলো শহরটি। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বেকারত্ব উদ্বিগ্ন করছিলো স্থানীয়দের, শহর ছাড়তে বাধ্য করছিলো। তখনকার সেই আঁধার কাটিয়ে ঝলমলে বর্তমানে আসার গল্প জানিয়েছে বিবিসি।
‘মায়াবী- জাদুকরী স্থান’
ঘন জঙ্গল বেষ্টিত এক গভীর উপত্যকায় বাস এর অধিবাসীদের। ১৮০০ শতকে সেন্ট্রাল অরেগনের এই স্থানেই প্রথম নতুন শহর গড়তে স্থানীয় আমেরিকানদের তাড়িয়ে দিয়েছিলো শ্বেতাঙ্গ সেটলাররা।
১৯০২ সালে এখানে আসেন স্টিভ ফরেস্টারের দাদা। ১৯৭০-এর দশকে তিনি যখন বেড়ে উঠছেন তখন প্রাইনভিল ছিলো শান্ত-মনোরোম এক স্থান। সেই সময়কার কথা স্মরণ করে ফরেস্টার বলেন, “এটা ছিলো মায়াবী, বেড়ে উঠার জন্য জাদুকরী স্থান।”
“আমার বাবা করাতকল শিল্পে ইলেকট্রেশিয়ান হিসেবে কাজ করতেন। আমার মা কোন কাজ করতেন না। শিকার ও বন্দুক চালনা আমরা সবাই শিখতাম।”
তিনি বলেন, ১৬ বছর হওয়ার আগেই আমরা জঙ্গলের ভেতরে গাড়ি চালানো শিখতাম। বসন্তের সময় আমরা সকালে স্নো-স্কি ও দুপুরে ওয়াটার-স্কি করতে পারতাম।”
“সবারই চাকরী ছিলো এবং সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভালো করছিলো।”
মৃত শিল্পের মাঝে
বিশ্বে সবার্ধিক পন্ডেরোসা পাইন গাছ হতো প্রাইনভিলে। কিন্তু ফেডারেল সরকার গাছ কাটা ও এর ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে এবং খুড়ুলে পেঁচার (spotted owl) মতো অন্যান্য প্রাণীদের সুরক্ষা বাড়ালে, শহরটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়।
এরপরেও টিকে থাকা গুটিকয় কারখানার একটিতে চাকরি নেন ফরেস্টার, কারণ তিনি প্রাইনভিলেই থাকতে চেয়েছিলেন।
এরিক ক্ল্যানের ভাবনাও ছিলো এমনই। তিনি এখানে বাস করা তার পরিবারের সপ্তম প্রজন্ম। কলেজের পড়াশোনা শেষ করেই তিনি প্রাইনভিলে চাকরী নেন, যা তিনি নিজেও জানতেন টিকবে না।
তার তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, “সবসময় আমার মাথার পেছনে একটি ক্ষিণ কন্ঠ শুনতাম, ‘তুমি কি করছো?- তুমি এখানে থাকতে চাও?, তুমি তো একটা মৃত শিল্পের মাঝে রয়েছো’।”
কয়েক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন শিল্পেও ধস নামে। অবশিষ্ট কারখানাগুলোর চাহিদাও কমে যায়। আবারও অনেক লোকজন চাকরি হারায়, চলে যেতে বাধ্য হয়। তখনকার অবস্থাদৃষ্টে প্রাইনভিলের ভাগ্য কখনোই প্রসন্ন হবে না বলেই ধারণা ছিলো।
প্রাইনভিলকে বাঁচানোর সুযোগ
ফরেস্টার এবং ক্ল্যান দুজনই নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবেন, শহরে চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য। ফরেস্টার শহর ব্যবস্থাপক এবং ক্ল্যান শহর প্রকৌশলী। ২০০৯ সালে প্রাইনভিলকে বাঁচানোর একটা সুযোগ পান তারা। আর তা আসে ভিটেস নামের একটি কোম্পানির রহস্যজনক ইমেইলে।
ক্ল্যান বলেন, “একটা দীর্ঘ সময় আমাদের কোন ধারণাই ছিলো ভিটেস মানে কি।”
ক্ল্যান জানতেন, প্রাইনভিলের প্রাকৃতিক সম্পদ তাকে একটি নতুন শিল্পের জন্য নিখুঁত করে তুলেছে- আর তাহলো তথ্য শিল্প। ওয়েবে পোস্ট করা বিশাল পরিমাণের তথ্য সংরক্ষণের জন্য যার প্রয়োজন।
ভিটেস একটি বড় ‘গুদাম’ এখানে গড়ে তুলতে চায়, যা সারি সারি সার্ভারে পূর্ণ থাকবে- সার্ভারগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই উত্তপ্ত হয়। সেন্ট্রাল ওরেগনের শীতল রাত একে প্রাকৃতিক ভাবেই ঠান্ডা করবে।
ক্ল্যান স্মরণ করেন ভিটেসের সাথে প্রথম বৈঠকের কথা এবং কিভাবে তা প্রাইনভিলের শেষ সুযোগ বলে অনুভূত হয়েছিলো।
“তাদের (ভিটেসের) নয়জন আইনজীবীর সাথে দেখা করতে কনফারেন্স রুমে ঢুকার ঠিক আগমুহুর্তে একটি ইমেইল পাই। যাতে দেখি আমাদের বেকারত্বের হার ২৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। মেইল পেয়ে আমি রুমটিতে যাই। ভাবতে থাকি, এই সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না।”
ক্ল্যান এবং ফরেস্টার সীদ্ধান্ত নেন, ভিটেসের বিবেচনায় অন্যান্য শহর থেকে নিজেদের এগিয়ে রাখার। তারা তাদের শহরের সম্ভাবনার কথা জানায় ভিটেসকে। ‘বড়-শহরের গতিতে’ চলতে পারার সক্ষমতার কথাও জানায়।
অন্যান্য শহরগুলো এতটা তৎপর হয়নি বলেই পরবর্তীতে শুনেছেন ফরেস্টার।
তাদের এই কৌশল কাজে দেয়, ২০১০ সালে প্রাইনভিল শেষ পর্যন্ত জানতে পারে ভিটেস আসলে কে।
ফেসবুকের প্রথম নিজস্ব ডাটা সেন্টার
নতুন ডাটা সেন্টারটি উদ্বোধনের দিনটি স্মরণ করে মেয়র বেটি রোপি বলেন, থাম্ব-আপ ফেসবুক সাইনের সেই চিহ্নটি তাদের ছিলো। এটা একটা বড় ঘোষণা-এটা ছিলো ফেসবুক।
এটা ছিলো ফেসবুকের প্রথম নিজস্ব ডাটা সেন্টার। সূচনার সেই সময় ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গও সেখানে ছিলেন।
রোপি ভেবে রেখেছিলেন তাকে একটি কাউবয় টুপি উপহার দিবেন। যা ছিলো কাউবয় সংস্কৃতির জন্য শহরটির গৌরবের বহিঃপ্রকাশ।
ফেসবুকের ও অ্যাপলের তিন ডাটা সেন্টার
সাত বছর পরে, ফেসবুকের আরও দু্ইটি ডাটা সেন্টার রয়েছে প্রাইনভিলে এবং বিশ্বজুড়ে রয়েছে আরও ছয়টি। অ্যাপলও প্রাইনভিলে এসেছে। তারা সেখানে তাদের ৩টি ডাটা সেন্টার নির্মাণ করেছে।
প্রাইনভিল উপত্যকার উঁচু স্থানে এগুলো প্রতিষ্ঠিত। এর বড়, দীর্ঘ ভবনগুলোর রঙ ফ্যাকাশে নীল এবং ধূসর। যেনো তারা আকাশের সাথে মিশে যেতে পারে।
সেন্টারে কাজ করে প্রায় ৫ শত কর্মী। এদের অধিকাংশই প্রাইনভিলের। নিরাপত্তায় যথেষ্ট কড়াকড়ি রয়েছে। এই ডাটা সেন্টারের রয়েছে গভীর প্রভাব।
পরিবর্তনের ঝুঁকি নিতেই হবে
রোপি বলেন, এই কারখানা প্রাইনভিলকে একটি শিক্ষা দিয়েছে যে শুধুমাত্র এক শিল্পের উপর নির্ভর করলে চলবে না। তাই বহু চাকরী প্রার্থীর কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে এমন কিছুতে মনোনিবেশ করেছি আমরা।
“আমরা বড় শহর হতে চাই না।” মন্তব্য করে রোপি বলেন, “আমরা ছোট শহরের অনুভূতি ধরে রাখতে পারি। আমি এব্যাপারে নিশ্চিত।”
প্রাইনভিলের ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে শঙ্কিত ফরেস্টার। কিন্তু জানেন তা গ্রহণ না করলে পিছিয়ে যেতে হবে, টিকে থাকাও দুষ্কর হয়ে পড়বে।ফরেস্টার বলেন, “আমরা একটি ছোট শহরের অধিবাসী। আমরা পশ্চিমা ধাঁচে বাঁচি। সেন্ট্রাল অরেগনের শান্ত-নীরবতা, সৌন্দর্য্য; সবমিলিয়ে এখানে থাকাটা অসাধারণ।”
ফরেস্টার দেখেছেন, সেন্ট্রাল অরেগনের যে শহরগুলো নতুনকে গ্রহণ করতে পারে না, তারা মারা যায়। প্রাইনভিলকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে পরিবর্তনের ঝুঁকি নিতে হবে বলেই অভিমত তার।