কয়েকঘণ্টা পরই এশিয়া কাপে শিরোপা লড়াইয়ে নামবে বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে ইতিহাস গড়ার সংকল্প নিয়ে অপেক্ষায় থাকা টাইগার দল ম্যাচে ঢেলে দিতে প্রস্তুত সর্বস্ব। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত তিনটি জয় ও দুটি হারকে সঙ্গী করে ফাইনাল মঞ্চে এসেছে মাশরাফী বাহিনী।
গ্রুপপর্ব ও সুপার ফোরের ম্যাচগুলোতে পরতে পরতে ঠাসা ছিল রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা। জমে ওঠা লড়াইয়ে কখনও হাসি, কখনও বেদনা নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। ফাইনালে নেমে পড়ার আগে দেখে নেয়া যাক কেমন ছিল শীর্ষ দুইয়ে উঠে আসার পথ-
প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা
বাংলাদেশ ১৩৭ রানে জয়ী।
টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে। দর্শকরা নড়েচড়ে না বসতেই সাজঘরে বাংলাদেশের জোড়া উইকেট। এমন সময় হাতে চোট নিয়ে সোজা হাসপাতালে তামিম ইকবাল। পথ হারাতে বসা সেই বাংলাদেশকে টেনে তোলেন মুশফিকুর রহিম ও মোহাম্মদ মিঠুন। দুজনের ১৩১ রানের জুটি। মিঠুন ফেরেন ৬৩ করে।
তারপর আবারও ব্যাটিংয়ে পথ হারাতে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু একপাশে আগলে ছিলেন মিডলের ভরসা মুশফিক। অভিজ্ঞ এ তারকা ক্যারিয়ারসেরা ১৪৪ রানের ইনিংস খেলে চ্যালেঞ্জিং সংগ্রহ এনে দেন। ইনিংসের শেষদিকে অভাবনীয় একটি ঘটনা ঘটে। নবম উইকেট পড়ার পরও মুশফিক যখন ক্রিজে, তামিম দলের খুব প্রয়োজনের এমন মুহূর্তে ব্যান্ডেজে বাঁধা হাত নিয়েই ব্যাটিংয়ে নেমে পড়েন।
তামিম পরে এক হাতেই ব্যাট করেন। তাকে পেয়ে আরও উজ্জীবিত মুশফিক শেষ জুটিতে অবিচ্ছিন্ন ৩২ রান যোগ করেন। আড়াইশ পেরিয়ে যায় দল। তামিমকে আগলে স্ট্রাইক নিয়ে নিয়ে করা ওই রান বাড়তি উদ্দীপনা এনে দেয় টাইগার ড্রেসিংরুমে। পরে বাংলাদেশের দেয়া ২৬২ রানের লক্ষ্যে স্রেফ উড়ে যায় শ্রীলঙ্কা।
দুবাইয়ে হাথুরুসিংহের শিষ্যদের ৩৫.২ ওভারে ১২৪ গুটিয়ে দেয় বাংলাদেশ। মাশরাফী-মোস্তাফিজ-মিরাজ ২টি করে, সাকিব-রুবেল-মোসাদ্দেক একটি করে উইকেট নিয়ে উড়ন্ত জয় ত্বরান্বিত করেন।
প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান
বাংলাদেশ ১৩৬ রানে হেরে যায়।
গ্রুপপর্বের দ্বিতীয় ম্যাচ। লঙ্কানদের গুঁড়িয়ে দেয়া উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ সেদিন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। দুই ফিফটিতে ৭ উইকেটে ২৫৫ রান তুলেছিল আফগানরা। সাকিব নেন ৪ উইকেট। অভিষিক্ত আবু হায়দার ২ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি দারুণ বোলিং করেন। ধরাছোঁয়ার মতই স্কোর। কিন্তু তামিমহীন ব্যাটিংয়ে পথ খুঁজে পায়নি টাইগাররা।
ফিফটিহীন সেই ইনিংসে ৪২.১ ওভার পর্যন্ত ধুঁকে ধুকে ১১৯ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। সাকিবের ৩২, রিয়াদের ২৭ আর মোসাদ্দেকের অপরাজিত ২৬ ছাড়া দুঅঙ্কের ঘর ছুঁতে পারেননি আর কেউই।
ধাক্কা খাওয়া ওই জয়ের আগেই অবশ্য সুপার ফোর রাউন্ডে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। রশিদ-নবির দল শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দেয়ায় জয়শূন্য ভাবে শেষ হয় হাথুরুসিংহের শিষ্যদের এশিয়া শ্রেষ্ঠত্বের মিশন।
প্রতিপক্ষ ভারত
ভারত ৭ উইকেটে জয়ী।
আফগান ধাক্কার পরের দিনই দুবাইয়ে নেমে পড়তে হয় বাংলাদেশকে। সুপার ফোর পর্বের প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষ ভারত। হতশ্রী সেই বাংলাদেশের দেখাই মেলে যেখানে।
শুরুতে ব্যাট করে ৪৯.১ ওভারে গুটিয়ে যাওয়ার সময় কেবল ১৭৩ রান পর্যন্ত যেতে পারে বাংলাদেশ। মিরাজ ৪২, মাশরাফী ২৬, রিয়াদ ২৫ ও মুশফিকের ২১ রানে এপর্যন্ত যেতে পারে দল।
জবাব দিতে নেমে শেখর ধাওয়ানের ৪০ আর রোহিত শর্মার অপরাজিত ৮৩ রানে হেসেখেলে জেতে ভারত, ৭ উইকেট আর ১৩.৪ ওভার হাতে রেখেই।
প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান
বাংলাদেশ ৩ রানে জয়ী।
সুপার ফোর পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচ। জয়ের বিকল্প নেই। হারলেই টুর্নামেন্ট শেষ। শুরুতে ব্যাট করে ৭ উইকেটে ২৪৯ রানের সংগ্রহ গড়ে বাংলাদেশ। শুরুতে লিটন দাসের ৪১ ও মুশফিকের ৩৩ রানের পর সাকিব রানের খাতা না খুলেই সাজঘরে হাঁটা দিলে পথ হারাতে থাকে টাইগাররা।
সেখান থেকেই প্রতিরোধের শুরু মাহমুদউল্লাহ ও ইমরুল কায়েসের। দুজনে ১২১ রানের ম্যাচজয়ী জুটি আনেন। মাহমুদউল্লাহ ৭৪ রানে ফিরে গেলেও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন ইমরুল। টুর্নামেন্টের মাঝপথে তামিমের বিকল্প হয়ে দুবাই উড়ে যাওয়ার পরের দিনই মাঠে নেমে পড়তে হয়েছিল তাকে। অপরাজিত ৭২ রানের ইনিংস খেলে জরুরী তলবে আস্থার প্রতিদান ব্যাটেই দেন ওপেনিংয়ে সুযোগ না পেয়ে মিডলঅর্ডারে নামা ইমরুল।
আড়াইশ পেরোনো সংগ্রহে অবশ্য সহজে জয় আসেনি। আফগানরা ছেড়ে কথা বলেনি। দুই ফিফটি আর দুই ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংসে ম্যাচের শেষ ওভার পর্যন্ত লড়াই জমিয়ে রাখে দলটি। শেষ ওভারে দরকার পড়ে ৮ রান। মাশরাফী বল তুলে দেন মোস্তাফিজের হাতে। কাটার মাস্টার দুর্দান্ত বোলিংয়ে ওই ওভারে দেন মাত্র ৪ রান। যার দুই আবার বাই-রান হয়ে এসেছে। শেষ বলে যখন ৪ রান দরকার আফগানিস্তানের, মোস্তাফিজ করেন ডট। উল্লাসে মাতে বাংলাদেশ।
সেই ম্যাচে প্রথম বাংলাদেশি বোলার হিসেবে ২৫০ উইকেটের মাইলফলকে ঢুকে যান মাশরাফী। মুশফিক ঢুকে যান তৃতীয় বাংলাদেশি হিসেবে পাঁচ হাজার ওয়ানডে রানের ক্লাবে। যেখানে আগে থেকেই আছেন তামিম ও সাকিব।
প্রতিপক্ষ পাকিস্তান
বাংলাদেশ ৩৭ রানে জয়ী।
সুপার ফোর পর্বের শেষ ম্যাচ। ভারত ফাইনাল নিশ্চিত করেছে। আফগানিস্তান বাড়ির পথে। তাতে অঘোষিত সেমিফাইনালে রূপ নেয় আবু ধাবিতে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ম্যাচটি। মহাগুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচের একাদশ দেখে চমকেই যেতে হয়েছে! সাকিব আল হাসান আঙুলের পুরনো চোটে ব্যথা বাড়ায় দলে নেই। এমনকি সতীর্থরা যখন মাঠে নেমে পড়েছেন, সাকিব তখন বাংলাদেশগামী বিমানে!
সাকিব নেই, তামিম আগে থেকেই নেই, মুশফিক চোট নিয়ে খেলছেন। একাদশে তিন পরিবর্ত নিয়ে নেমে বাংলাদেশ জমা করতে পারে কেবল ২৩৯ রান। ৭ বল হাতে রেখেই গুটিয়ে যায়। সেই রানটাও সহজে আসেনি। ১২ রানেই ৩ উইকেট সাজঘরে। এমন সময় জুটি বাধেন প্রথম ম্যাচের দুই নায়ক মুশফিক ও মিঠুন। এদিন ১৪৪ রানের জুটিতে পথ দেখান।
মিঠুন ফেরেন ৬০ রানে। মুশফিক এক রানের জন্য টুর্নামেন্টে নিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি হাতছাড়া করে ফেরেন। বাকিদের মধ্যে মাহমুদউল্লাহর ২৫-ই কেবল বলার মতো।
মুশফিকের সেই শতক হারানোর বেদনা ম্যাচ শেষ হতে হতে উধাও! বোলারদের সম্মিলিত নৈপুণ্যে দল যে ফাইনালের টিকিট কেটে ফেলেছে। পাকিস্তান ইনিংসে শুরুর ধাক্কা দিয়েছিলেন মিরাজ ও মোস্তাফিজ। ফিজ আবার জোড়া ধাক্কা দেন।
এরপরও অভিজ্ঞ শোয়েব মালিক আর নবীন ইমাম-উল-হকের ব্যাটে ম্যাচে টিকে থাকে পাকিস্তানিরা। তখন দৃশ্যপটে মাশরাফী। বোলিংয়ে নন, বুড়ো হাড়ের ভেল্কিতে ফিল্ডিংয়ে। রুবেলের বলে শর্ট মিডউইকেটে বাজপাখির মতো ক্ষীপ্রতায় শরীর বাতাসে ভাসিয়ে একহাতে মালিকের ক্যাচ লুফে নেন টাইগার অধিনায়ক। সেই ধাক্কা আর সামলে নিতে পারেনি পাকিস্তান।
পাকিস্তানকে ২০২ রানে গুটিয়ে দেয়ার পথে শেষেও ম্যাজিক দেখান মোস্তাফিজ। মোট ৪ উইকেট তুলে নেন কাটার মাস্টার। মিরাজ নেন ২টি। ম্যাচে তামিম-সাকিব ছিলেন না। ফিল্ডিংয়ে দীর্ঘ সময় ছিলেন না মুশফিক। ক্যাচ ধরতে যেয়ে আঙুল ফাটিয়ে একপর্যায়ে মাঠের বাইরে ছিলেন মাশরাফীও। জরুরী প্রয়োজনে তখন রিয়াদও কিছুক্ষণ মাঠের বাইরে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের পাকিস্তান-বধ ঠেকাতে পারেনি কোনো কিছুই।
প্রতিপক্ষ ভারত
বাংলাদেশের আরেকটি জয়?
শুক্রবার ফাইনালের মঞ্চে আরেকটি মহাকাব্য গাঁথার উল্লাসে মাতার অপেক্ষায় বাংলাদেশ, অপেক্ষায় লাল-সবুজের পুরো প্রান্তর। অপেক্ষা উৎসবের রজনীর।