নির্বাচনের মৌসুমকে সামনে রেখে ফেইক নিউজ যে বড় ধরনের হুমকি সেটা সরকার ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছে। সরকারবিরোধী ফেইক নিউজ বন্ধ করতে তাই হাজার কোটি টাকার প্রজেক্টও নেয়া হয়েছে।
এতদিন আমরা যেটা দেখে আসছিলাম সেই হিসেবে ফেইক নিউজ ছিল মোটামুটি দুই ধরনের।
এক. উন্নয়নশীল ফেইক নিউজ; যেমন: শেখ হাসিনা বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী, তারেক রহমানকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অধ্যাপক হওয়ার আমন্ত্রণ। দুই. আক্রমণাত্মক ফেইক নিউজ; যেমন: কোটা আন্দোলনে ঢাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থী নিহত, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে জিগাতলায় ধর্ষণ, ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর ফেইক নিউজে কারও তেমন ক্ষতি না হলেও দ্বিতীয় ধরনের ফেইক নিউজে সহিংস প্রভাব পড়েছিল জনজীবনে। শেষের ফেইক নিউজ বন্ধ করতেই মূলত সরকারের এত আয়োজন ছিল।
কিন্তু এখন আরেক প্রকারের ফেক নিউজের দেখা যাচ্ছে নির্বাচনকে সামনে রেখে। এবারেরটা আগের দুটোর চেয়ে ভয়াবহ। এবারকার ধরণ হচ্ছে: দেশ-বিদেশের প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ার ওয়েবসাইট এদিক সেদিক করে হুবহু ডিজাইন নকল করে বিরোধী পক্ষের নামে সংবাদ প্রচার করা। বিশেষ করে ওই নিউজের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে দেয়া।
এই ফেইক নিউজের পরিণাম খুবই ভয়াবহ হতে পারে। যেমন ধরুন, নির্বাচনের আগে এমন কোনো সেন্সিটিভ কথা ওই সাইটে ছড়িয়ে দিয়ে স্ক্রিনশট ছড়ানো হতে পারে, যা যেকোন দল এবং পুরো সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণাম বয়ে আনতে পারে। এমনকি এতে নির্বাচনের ফলাফলও পাল্টে যেতে পারে।
যদিও আজকে বিবিসি বাংলার হুবহু নকল ডিজাইনের যে সাইট এবং নিউজ নজরে এলো, তা সরকারপন্থীদের কাজ বলেই মনে হয়েছে। একজন সাবেক সহকর্মী বিবিসির নিউজ ভেবে সেটা শেয়ারও দিয়ে ফেললেন।
প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট নকলের কারণ কী?
ডটকম বিস্ফোরণের শুরু থেকেই ফেইক নিউজ প্রচার হত অখ্যাত কোনো অনলাইন বা অন্য কোনো মাধ্যমে। এ কারণে বেশ কয়েক বছর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় অখ্যাত অনলাইনের বিরুদ্ধে এক ধরনের জনমত গড়ে উঠেছে। এমনকি এসব সাইটকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা ‘বেওয়ারিশ অনলাইন’ বলেও আখ্যায়িত করতে থাকেন।
এই প্রবণতা থেকে প্রতিষ্ঠিত অনলাইনের ওয়েবসাইটের কাছাকাছি ডোমেইন ক্রয় করে তাদের ডিজাইন হুবহু নকল করে ফেক নিউজ ছড়ানোর আইডিয়া আসতে পারে অপরাধীদের।
সরকার বা বিরোধীপক্ষের যার পক্ষেই এসব নিউজ যাক না কেন, এই প্রবণতা যদি এখনই থামানো না যায়, তাহলে এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। এমনকি এটা ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়েও ব্যবহার হতে পারে।
প্রতিকারের উপায় কী?
প্রথমত, যেই সংবাদমাধ্যেমের ওয়েবসাইট হুবহু নকল হচ্ছে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তাদেরকেই নিতে হবে। যেমন, প্রথম আলোর নামে ভুয়া একটি সংবাদের বিষয়ে সম্প্রতি তারা নিউজ করে জানিয়েছিল যে তাদের নামে একটি ভুয়া নিউজ ছড়ানো হচ্ছে। সাইট নকলের ক্ষেত্রে যেকোন প্রতিষ্ঠিত হাউজের আইনী ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের সচেতনতা। এছাড়া কোনটা নিউজ, আর কোনটা ফেইক নিউজ এ সম্পর্কেও প্রাথমিক ধারণা রাখা। আমরা আসলে কী ধরনের লিংক বা সংবাদ ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছি তা শেয়ারের আগে অন্তত কয়েকবার চিন্তা করা উচিত।
কারণ, অসচেতনভাবে হলেও আপনার আমার শেয়ার করা একটি ফেইক নিউজের কারণে যেকোন অঘটন ঘটে যেতে পারে, যার দায় আপনি এড়াতে পারবেন না। আর আজ আপনি সজ্ঞানে ফেক নিউজ শেয়ার করলে আগামীকাল যে নিজেই এর শিকার হবেন না, তা বলা যায় না।
এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে মিডিয়ার ওপর চাপ না থাকা এবং মিডিয়ার সত্য এড়ানোর প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মানুষের সত্য জানার পথ যেখানে বন্ধ হয়ে যায়, ফেইক নিউজের পথ চলা সেখান থেকেই শুরু হয়।
ফেইক নিউজ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফেইক নিউজ বন্ধের তেমন কোনো সম্ভাবনা তেমন একটা নেই বললেই চলে। কারণ, ফেইক নিউজ সরকার কিংবা বিরোধী যার পক্ষেই যাক না কেন, তারা কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা ছাড়াই তা লুফে নেয়। আর যদি বুঝেও যে এটা ফেইক নিউজ তবুও বেশি করে শেয়ার দেয়, কারণ এটা যে নিজের পক্ষে গেল।
আবার মূলধারার মিডিয়ার সত্য রিপোর্ট নিজেদের বিরুদ্ধে গেলেও তা ফেইক নিউজ বলে উড়িয়ে দেয়ার মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলছে।
অবশ্য এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নিজের বিরুদ্ধে গেলে যেকোন সংবাদকে ফেইক নিউজ হিসেবে আখ্যা দেন। অথচ ফেইক নিউজকে পুঁজি করে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়েছেন বলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও অভিযোগ রয়েছে। তারই সূত্র ধরে এই সমস্যা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী, এমনকি বাংলাদেশেও।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)