দ্বিতীয় সূত্র দ্বারা নিশ্চিত না হওয়া কিছু রিপোর্ট প্রকাশের কারণে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামকে নিয়ে যে সমালোচনা, তার বিরুদ্ধে যে মানহানির মামলা এবং রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের আবেদন; সে প্রেক্ষাপটে ওই সময়ের বিস্তারিত জানিয়েছেন ইংরেজি দৈনিকটির তখনকার রিপোর্টিং বিভাগের প্রধান জায়েদুল আহসান। একসময় দেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় অন্যতম প্রধান এ রিপোর্টার এখন দেশ টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক।
চলমান বিতর্কের প্রেক্ষাপটে তার নিজের দায়-দায়িত্বের কথা উল্লেখ করে জায়েদুল আহসান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, দ্বিতীয় সূত্র দ্বারা অনুমোদিত নয় এমন কয়েকটি প্রতিবেদন ডেইলি স্টারে প্রকাশের দায় কিছুটা আমারও রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি ওই সময় তার ডেইলি স্টারের রিপোর্টিং বিভাগের প্রধান থাকার কথা উল্লেখ করেন।
তবে তিনি খোলাখুলিই বলেন যে ওই সব রিপোর্ট তারা কীভাবে পেয়েছিলেন সেই ইতিহাসের পুরোটা প্রকাশের সময় এখনো আসেনি। ‘আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সেটা গ্রহণ করার মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি বা আমরা গড়ে উঠতে দেইনি। আমার সাবেক সম্পাদক মাহফুজ আনাম সামান্য সত্য প্রকাশ করায় যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাতেই বোঝা যায় যে আমরা অতোটা ম্যাচিউর্ড হইনি যেখানে সব সত্য মেনে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে।’
‘সেনা নিয়ন্ত্রিত জরুরি সরকার’ সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন: তখন প্রতিদিনই ‘ওহি’ নাযিল হতো। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার পাঠানো সংবাদ আমরা শুরুতে বাস্কেটেই ফেলে দিতাম। এরইমধ্যে শুনি আজ অমুক সম্পাদককে ডেকে নিয়ে ডিজিএফআই অপমান করেছে। অমুক সম্পাদককে ৪ ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছে। চোখ বেঁধে অনেকে রিপোর্টারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবরও পাই। আবার কোনো কোনো সম্পাদক প্রতিদিন ডিজিএফআই কার্যালয় রজনীগন্ধায় হাজিরা দেন, এসব খবর চারদিকে চাউর হয়ে যায়। তবে ডেইলি স্টার ‘ওহি’র মতো ‘নাজেল’ হওয়া রিপোর্টগুলো বাস্কেটেই ফেলে দিচ্ছিলো।
তাহলে কীভাবে প্রেক্ষাপট পাল্টে গেলো? জায়েদুল আহসান বলেন, একদিন ডেইলি স্টার এর এক সাংবাদিককে তুলে নিয়ে যায় ডিজিএফআই। তার ওপর অকথ্য নির্যাতনও চলে। কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা তার খোঁজ-খবর নেন। তখনকার সরকারপ্রধানও বিষয়টি জেনেছিলেন। কিন্তু, তার নিজেরও যেনো কিছু করার ক্ষমতা ছিলো না।
‘অবশেষে সারাদিন দেন দরবার করে বাধ্য হয়ে চার লাইনের একটি বিবৃতি লিখিত হিসেবে দিয়ে মাহফুজ আনাম ওই সাংবাদিককে ছাড়িয়ে আনেন। পরে ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতি নির্ধারণী বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয়। বিবৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে মাহফুজ আনাম জানান, ওই ছেলেটার শারীরিক নিরাপত্তাই তার কাছে মুখ্য ছিলো।’
তাহলে বিবৃতিটি কি কোনো ‘মুচলেকা’ ছিলো যাতে ডেইলি স্টার গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা নিউজ ছাপানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো? জায়েদুল আহসান সরাসরি তা নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, সেটি ছিল লিখিত বিবৃতি যা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিলো, গোপন কিছু নয়। সঙ্গে যোগ করেন: নীতি নির্ধারণী বৈঠকগুলোতে বিভিন্ন সংবাদপত্রে ডিজিএফআইয়ের পাঠানো সংবাদ প্রকাশ নিয়ে আলোচনা হতো। সবাই এটা নীতি বিবর্জিতই মনে করতাম। কিন্তু ওই সাংবাদিককে কন্ট্রিবিউটরকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করার পর মাহফুজ আনামের মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। তিনি দুচারটি ‘ওহি’ প্রকাশের অনুমোদন দেন।
মাহফুজ আনাম একাই কি ছেপেছেন
ডেইলি স্টারের তখনকার রিপোর্টিং বিভাগের প্রধান জায়েদুল আহসান বলেন: ওই সময়ের সংবাদপত্রের আধেয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা খবর দেশের প্রায় সব গণমাধ্যম রীতিমত প্রতিযোগিতা করে প্রকাশ করেছে। শুধু জুন মাসের কথাই যদি বলি দেখা যাবে ইত্তেফাক ১৬টি, যুগান্তর ১০টি, ইনকিলাব ১০টি সমকাল ২০টি এবং ভোরের কাগজ ১৪টি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেদিক থেকে স্টার কমই ছেপেছে এসব রিপোর্ট। তবে কেউ ভয়ে ছেপেছে, কেউ অতি উৎসাহে ছেপেছে। সময়টা কিন্তু ছিলো জরুরি অবস্থা। মুক্ত সাংবাদিকতার সুযোগ ছিলো না।
এ প্রেক্ষাপটে জরুরি বিধিমালার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিধিমালায় ছিলো: সরকারবিরোধী যেকোনো তথ্য, সংবাদ, সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, টকশো, আলোচনা ইত্যাদি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সরকার চাইলে যে কোনো বই পুস্তক সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধও করে দিতে পারবে। সরকার ওই ধারা ব্যবহারও করেছে।
উল্টো প্রশ্ন রেখে দেশ টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক বলেন, এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও কি আমরা মুক্ত সাংবাদিকতা করছি? সাংবাদিকতার সব নীতি-নৈতিকতা কি মেনে চলছি? ‘আজ মাহফুজ আনামের দিকে তীর ছোঁড়া হচ্ছে। অথচ আমরা এখনো গণমাধ্যমে ওই ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ হতে দেখি। ‘সূত্র জানায়’ বলে বিভিন্ন সংবাদপত্রে নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। বিশেষ করে কাউকে আটক করা হলে রিমান্ডে তিনি কী কী বলছেন তার সবই ‘সূত্র জানায়’ বলে উল্লেখ করা হয়।’
তুলনামূলক আলোচনায় তিনি বলেন, এখনো টিএফআই সেলে কে কী বললেন না বললেন সেটি সূত্র জানায় বলে প্রচার করা হয়। তেমনি রাজনীতিবিদরা টিএফআই সেলে কে কী বলেছেন সেটির অডিও সিডি শুনে গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে। আমি বলছি না যে ডিজিএফআই’র দেওয়া তথ্য যাচাই না করে প্রকাশ করা সঠিক হয়েছে। সেটা সাংবাদিকতার নীতি বিরুদ্ধ কাজই হয়েছে। কোন পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিদরা ওই জবানবন্দি দিয়েছেন সেটাও সহজে অনুমেয়। এর মানে হচ্ছে, এদেশে এই চর্চা আগেও ছিলো, এখনও চলছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে উদাহরণ দিয়ে জায়েদুল আহসান বলেন: কিছুদিন আগে মাহমুদুর রহমান মান্না আর সাদেক হোসেন খোকার টেলিসংলাপ শুনে রিপোর্ট করা হয়েছে। টিভিগুলো ওই সংলাপ প্রচার করেছে, পত্রিকাগুলো পুরো বিবরণ ছেপেছে। ওই সংলাপ কোনো মিডিয়া কি গোপনে রেকর্ড করেছিলো? যারা ওইসব ট্রান্সক্রিপ্ট ছেপেছেন বা ভয়েস প্রচার করেছেন তারা কি সূত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন?
প্রশ্ন আরো অনেক
জায়েদুল আহসান বলেন, ডিজিএফআইয়ের দেওয়া সই ছাড়া লিখিত তথ্য বা অডিও সিডির ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশের কথা স্বীকার করার মধ্য দিয়ে আরও কিছু বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। যেমন: সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা তখন তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে, তখন রাজনীতিবিদের চরিত্র হননের চেষ্টা হয়েছে, তারা যেসব অডিও সিডি দিয়েছে তাতে রাজনীতিবিদদের স্বকন্ঠে দেওয়া জবানবন্দি ছিলো।
‘যারা আজ সংসদে মাহফুজ আনামের বিচার দাবি করছেন সেই রাজনীতিবিদরা জবানবন্দিতে হয় সত্য বলেছেন, নয় তারা টিএফআই সেলের চাপে মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সত্যটা হলো তারা বলেছেন। আর গণমাধ্যম সেটা শুনে রিপোর্ট করেছে,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন: ইউটিউবে এখনও সেসব অডিও পাওয়া যায়। কারা ইউটিউবে দিয়েছে? আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার ব্যবহার কোথায়?
কোনো কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে মাহফুজ আনামের বিচার চাওয়া প্রসঙ্গে জায়েদুল আহসান বলেন, রাজনীতিবিদরা এখনো বলেননি যে তারা টিএফআই সেলে জবানবন্দি দেননি অথবা তারা চাপ সইতে পারেননি। তাই যদি হয়, সাংবাদিকরা চাপ সইবেন এমনটি আশা করা হচ্ছে কেনো?
‘আট বছর পর মাহফুজ আনাম স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি কিছু রিপোর্ট প্রকাশ করে ভুল করেছেন। এখন সংসদে তাঁর বিচার দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু, আসল বিচার্য বিষয় হতে পারতো যে কারা রাজনীতিবিদদের বিনা মামলায় ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, জোর করে কেনো স্বীকারোক্তি আদায় করেছিলো আর সেই স্বীকারোক্তি ছাপতে সাংবাদিকরা কেনোই বা বাধ্য হয়েছিলো?,’ এমন অনেক প্রশ্ন রাখলেও তিনি হতাশার সঙ্গেই বলেন, সংসদে এ বিষয়ে বোধহয় কোনোদিনই আলোচনা হবে না।
‘যারা জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তারাই আজ সেটি প্রকাশকারীর বিচার চাইছেন। জোর করে জবানবন্দি আদায়কারির বিচার চাইছেন না।’
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: একজন এমপি সংসদে বলার চেষ্টা করেছিলেন। তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘মাহফুজ আনামকে নিয়ে আমি কথা বলবো না। কারণ, সেদিন ভয়ে অনেকে বিবেককে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। আজকে এই সংসদে সদর্পে বসে আছেন যারা তাদের অনেকেই সেদিন বাধ্য হয়ে বিবেককে জলাঞ্জলি দিয়ে সত্যের অপলাপ করেছিলেন।’ স্পিকার তাকে আর এগুতে দেননি। সেদিনই যদি স্পিকার তাকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে দিতেন তাহলে ইতিহাসের অনেক অন্ধকার দিক উম্মোচিত হতো।
সংসদে পুরো বিষয়টি আলোচনা না হওয়ায় হতাশ হলেও জায়েদুল আহসান আশাবাদী যে হয়তো কখনও সত্য প্রকাশ হবে। কারণ ইতিহাসের অন্ধকার দিক উন্মোচনে সময় কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।