মাদক উৎপাদন এবং রপ্তানির দেশ না হলেও মাদকের আখড়া হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর কারণটা ভৌগলিক। যার পেছনে আছে ‘সোনালী অভিশাপ’। ভারত এবং মিয়ানমারের সীমান্তে ঘেরা বাংলাদেশ একদিকে মাদকের বড় বাজার, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও বলছে বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ নয়। তবুও দু’টি ‘সোনালী’ অভিশাপের জন্যই দেশ এখন মাদকের আখড়া।
এই দুই অভিশাপের বিভীষিকার কথা চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তুলে ধরেছেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন আহমেদ।
ভৌগলিক অবস্থানটি এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে তিনি বলেন: বাংলাদেশ মাদক উৎপাদন করে না, মাদক রপ্তানিও করে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ এবং ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ নামের দু’টি রুটের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। মিয়ানমার-থাইল্যান্ড এবং লাওসের মধ্যে মাদক চোরাচালানের রুটটিকে বলা হয় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের মধ্যে মাদক পাচারের রুটটি হচ্ছে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট।
তিনি বলেন: দুই মাদক চোরাচালান রুটের মধ্যখানে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় দেশ মাদকের শিকারে পরিণত হয়েছে। দু’দিক থেকে দেশ মাদকে ছেঁয়ে যাচ্ছে। গোল্ডেন ক্রিসেন্ট থেকে মাদক আসছে, গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল থেকে আসছে।
তবে সবচেয়ে বড় কারণ বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিস্তীর্ণ এবং দুর্গম-অরক্ষিত সীমান্ত। তিন দিক দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার।
এই দুই প্রতিবেশী দেশই দু’টি আন্তর্জাতিক মাদকপাচার রুটের মধ্যে থেকেই বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে জানিয়ে তিনি বলেন: বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে আছে ভারত। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকাগুলোর দুর্গম অঞ্চলে মাদক পাচারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব পাহাড় বনাঞ্চলে মাদক পাচারকারীরা অনেকটা দৃষ্টির আড়ালে থেকে মাদক চোরাচালান করছে। পশ্চিম এবং পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে হেরোইন, ফেন্সিডিল, ইঞ্জেক্টিং মাদক এবং গাঁজা ঢুকছে। অ্যাম্ফেটামাইন বা ইয়াবা প্রধানত আসছে মিয়ানমার থেকে। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সংলগ্ন এলাকা অর্থাৎ চট্টগ্রামের কক্সবাজার জেলার সীমান্ত এলাকা বিশেষ করে টেকনাফ দিয়ে প্রচুর ইয়াবা আসছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদকের অবাধ প্রবেশ বন্ধে বাংলাদেশের আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে ভারত। ডিএনসি’র সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে ভারতের এই ইতিবাচক সাড়া দেয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার পর দেশটি নিজের সীমান্তবর্তী এলাকায় ফেন্সিডিল তৈরির ল্যাবরেটরি বন্ধ করছে। সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ফেন্সিডিল এবং ফেন্সিডিল তৈরির উপাদান বহনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশীর এই উদ্যোগের সুফল পেতে শুরু করেছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১২ সালে ফেন্সিডিলের প্রাদুর্ভাব চরমে থাকলেও পরবর্তী ২০১৩-২০১৫ সাল পর্যন্ত ফেন্সিডিলের প্রাদুর্ভাব স্থিতিশীল ছিলো। এমনকি ২০১৬ সালে ফেন্সিডিলের প্রাদুর্ভাবে কিছুটা হ্রাসও লক্ষ্য করা গেছে।
কিন্তু বাংলাদেশকে ইয়াবা নামের সবচেয়ে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করালেও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একেবারেই পাশে দাঁড়াচ্ছে না মিয়ানমার।
দেশে ইয়াবা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমারের ভূমিকাকে কেবল মাদক পাচারের দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই বলে মনে করেন ডিএনসি’র অপারেশন্স এবং গোয়েন্দা শাখার পরিচালক সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: হেরোইন, ফেন্সিডিলের চেয়ে ইয়াবা বহন করা সহজ। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকেই এই মাদক হেরোইন, ফেন্সিডিলকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করে। আমাদের পাওয়া তথ্য মতে ইয়াবা আসক্তদের বেশির ভাগই কম বয়সী যুবক-যুবতী। আমাদের দেশে জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশই যুবক-যুবতী। জনসংখ্যার এই বিশাল অংশ রাষ্ট্রের জন্য নিঃসন্দেহে বিপুল সম্পদ। আর এই সম্পদ নষ্ট করার পায়তারা হিসেবে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশটি থেকে এটিএস বা ইয়াবা ঢোকানো হচ্ছে।
ডিএনসি’র সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বেশির ভাগ ইয়াবা তৈরি হয় মিয়ানমার-চীন সীমান্তের শান এবং কাচিন প্রদেশে। আস্তে আস্তে এই মাদক প্রবেশ করানো হয় বাংলাদেশে। ইয়াবা বহনের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হয়।
অথচ ইয়াবা তৈরি ও পাচার বন্ধে বাংলাদেশের আহ্বানে মিয়ানমার কোন ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, ইতিবাচক সাড়াই দিচ্ছে না বলে জানান ডিএনসি’র অপারেশন্স এবং গোয়েন্দা শাখার পরিচালক।
তিনি বলেন: ভারতের মতো মিয়ানমারের সঙ্গেও আমরা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসছি। প্রতিবছর এই বৈঠক হচ্ছে। দু’দিন ব্যাপী এসব বৈঠকের শেষের দিন ইয়াবা বন্ধে আমাদের প্রস্তাবনা থাকে। এই প্রস্তাবনার প্রতিটি শব্দ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সম্মতি নিয়ে লেখা হয়। কিন্তু যখন স্বাক্ষর দেয়ার সময় আসে, তখনই মিয়ানমার পিছিয়ে যায়। তারা বলে এই প্রস্তাবনা পুনর্বিবেচনা করে এরপর স্বাক্ষর করে পাঠাবে। কিন্তু কোন সময়ই তারা পাঠায় না। একবারও তারা স্বাক্ষর করেনি।
ভারতের ইতিবাচক সাড়া অন্যদিকে মিয়ানমারের কোন রকম সাড়া না পাওয়ায় হেরোইন-ফেন্সিডিলের মতো মাদক স্থিতিশীল থাকলেও বেড়েই চলেছে ইয়াবার আগ্রাসন।২০১৬ সালে যেখানে দেশে উদ্ধারকৃত ইয়াবার পরিমাণ ছিলো ২ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার পিসের বেশি সেখানে ২০১৭ সালে উদ্ধার করা ইয়াবার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ৭৯ হাজার পিসের কিছু বেশি।
আর ডিএনএস মহাপরিচালকের দেয়া তথ্য মতে ২০১৮ সালে প্রথম তিন মাসেই উদ্ধার করা ইয়াবার পরিমাণ ৩ কোটি পিস ছাঁড়িয়ে গেছে।