হঠাৎ করেই কি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলছে বাংলাদেশ? উত্তরটা হচ্ছে, না। যুব বিশ্বকাপের প্রতি আসরেই প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ দল পাঠায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। প্রতিটা দলকে নিয়েই থাকে সমান আশা। সেই আশা পূরণ না হওয়ার পর কোথায় খামতি থেকে যায় সেটাই আর বের করা হয়ে ওঠে না।
আকবর আলীদের সৌভাগ্য তাদের দলটা অনেক প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে পেরেছে। পেরেছে সেমিফাইনাল টপকে যেতে, ফাইনালের মঞ্চে আসতে। যুবা টাইগারদের ঊর্ধ্বগামী ছুটে চলার সেই প্রস্তুতি-তপস্যার ধাপটা তুলে ধরেছে ক্রিকেটের জনপ্রিয় সাইট ক্রিকইনফো।
প্রস্তুতি: ২০১৮ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বকাপজয়ের মতো একটা যুব দল গড়ার পরিকল্পনায় হাত দেয় বিসিবি। সেই উদ্যোগের সামনে ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট কমিটির প্রধান খালেদ মাহমুদ সুজন। ২৪ মাস সময় মেপে দিয়ে প্রথম করণীয় হিসেবে দলকে আরও অভিজ্ঞ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয়ধাপে ছিল, একটা লম্বা সময় ধরে একই দলকে একসঙ্গে খেলানো যাতে একে অন্যের মানসিকতা নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয় ক্রিকেটারদের।
‘আসল রহস্য হল, আমরা গত দুই বছরে অনেক ক্রিকেট খেলেছি। বিসিবি অনেক সফরের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ডে খেলেছি। ৩০টার মতো ম্যাচ খেলেছি, ১৮টার মতো জিতেছি।’ ক্রিকইনফোর সঙ্গে আলাপচারিতায় এভাবেই বলেছেন খালেদ মাহমুদ।
‘গত দুই বছর আমরা দলটাকে নিয়ে বেশি খোঁচাখুঁচি করিনি। ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৭ দল থেকে ২০ খেলোয়াড় বাছাই করেছিলাম, সেখান থেকে ১৫ জন এসেছে বিশ্বকাপে। একসঙ্গে থাকার ফলে তারা অনেকটা পরিপক্ব হয়েছে, নিজেদের ভূমিকা আর দায়িত্ব সম্পর্কে জেনেছে।’
‘গত বিশ্বকাপে আমরা আমাদের আসল দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে টের পেলাম। শেষদিকের ওভারগুলোতে আমাদের ব্যাটিং-বোলিং কোনোটাই ভালো হতো না। পরে আমরা শ্রীলঙ্কার সাবেক ব্যাটসম্যান নাভিদ নেওয়াজকে কোচ করে আনলাম, বিদেশে সফরগুলোকে প্রাধান্য দিতে শুরু করলাম। বোর্ডকে বোঝাতে পেরেছি যে, আমরা বিশ্বকাপে ভালো করতে পারবো না যদি দেশের বাইরে খেলার অভিজ্ঞতা কম থাকে। একই জায়গায় আটকে থাকতে হবে। বোর্ড দায়িত্ব নিয়েছে, আমাদের পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে।’
পদ্ধতি: চার বছর আগে দেশের ৬৪ জেলা থেকে প্রতিভাবান কিশোর ক্রিকেটারদের তুলে আনার বিস্তর পরিকল্পনা শুরু করে বিসিবি। অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৮, এই তিন দলের জন্য সারাদেশ থেকে ৪৫ জন করে মোট ১৩৫ জন খেলোয়াড় তুলে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে বোর্ড। ওই ১৩৫ জনকে তিন ভাগ করে বছরব্যাপী তিন দলের টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়। যে টুর্নামেন্ট থেকে সেরা ১৫ জনকে নিয়ে শুরু হয় বিসিবির নিবিড় চর্চা।
‘আমাদের বেশিরভাগ ক্রিকেটারই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা, যেমন মোস্তাফিজুর রহমান। বর্তমান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের মাত্র দুইজন ক্রিকেটার এসেছে ঢাকা থেকে। কারণ যেভাবে আমরা বয়সভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টটা আয়োজন করেছি তাতে সবারই সমান সুযোগ ছিল অংশগ্রহণের।’ বলছিলেন মাহমুদ।
‘অভিভাবকদের এখন আর বোঝাতে হয় না। সবাই চায় তাদের ছেলে-মেয়েরা ক্রিকেট খেলুক, এমনকি গ্রামের বাবা-মা, তারাও চায়। তারা এখন চিন্তা করেন তাদের সন্তানরা ক্রিকেটার হতে পারলে তাদের জন্যই ভালো, কেবল ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেই অনেক অর্থ উপার্জন করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তো আরও অবশ্যই। সাকিব-তামিমদের দেখে অভিভাবকেরা বুঝতে পেরেছেন ক্রিকেটে ভবিষ্যৎ আছে। এর কারণে আমরা এখন অনেক কম ক্রিকেটার হারাচ্ছি।’
গত কয়েকবছর ধরেই বড় আসরগুলোতে গিয়ে খুব অল্প ব্যবধানে ভালো কিছু ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে হেরেছে তিনটি ফাইনাল। যার দুটি ভারতের বিপক্ষে, দুবাইয়ে এশিয়া কাপের ফাইনাল ও নিধাস ট্রফিতে। ২০১৬ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে মাত্র ১ রানে হার আছে ভারতের বিপক্ষে। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটেও ভারতের কাছে বাংলাদেশের তিক্ত হারের অভিজ্ঞতা আছে। পাঁচ মাস আগে এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতকে ১০৬ রানে অলআউট করেও ১৭ ওভার আগে ১০১ রানে অলআউট হয়েছিল ছেলেরা।
সেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বিশ্বকাপের আগে কাজ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাহমুদ, ‘গত দুই বছরের ক্রমান্বয় অনুশীলন, এতে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হয়েছে। যদি আমাদের ব্যাটিংয়ের দিকে লক্ষ্য করা হয়, বোঝা যাবে আমাদের ব্যাটসম্যানরা এখন আর তাড়াহুড়ো করে না। একবার উইকেটে থিতু হয়ে গেলে হাতে উইকেট থাকলে কীভাবে খেলতে হয় সেটা তাদের জানা। এই ছেলেরা যদিও অনেক ম্যাচ জিতেছে, কিন্তু হার থেকে কীভাবে শিক্ষা নিতে হয় সেটাও তারা শিখেছে।’
‘টপঅর্ডারের পাঁচ ব্যাটসম্যানের প্রত্যেকেই রানের মাঝে আছে। একদিন তামিম যদি রান পায় তো আরেকদিন তৌহিদ হৃদয় রান করছে। মাহমুদুল হাসান জয় রানের দিক থেকে খানিকটা পিছিয়ে ছিল, তবে তাকে আমরা সবসময়ই পূর্ণ সমর্থন দিয়ে এসেছি। এর ফলে সেমিতে সে আমাদের দারুণ এক সেঞ্চুরি উপহার দিয়েছে।’
‘বোলিংয়ের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্যটা এক কেন্দ্রিক রাখতে চাইনি। পেসার, স্পিনাররা আমাদের চাবিকাঠি এতদূর আসার। প্রতিটি বড় দলে বোলিংয়ে একাধিক বৈচিত্র্য থাকে। বোলাররা জানে নতুন-পুরনো বলে কীভাবে বল করতে হয়। পেসাররা চম্পকা রামানায়েকের অধীনে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আশা করছি আগামী চার-পাঁচ বছর পর পেস বোলিংয়ে একটা বিপ্লব দেখা যাবে।’
‘২০১৮, ২০১৯ সালে আমরা কোনো সাউথ আফ্রিকা সফরের ব্যবস্থা করতে পারিনি বলে বিশ্বকাপের একমাস আগেই এখানে চলে এসেছি। এখানকার উইকেটগুলো খুব বেশি বাউন্সে ভরা ছিল, আমরা তাতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করেছি। বিশ্বকাপের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি ম্যাচের আগে খেলেছি বাড়তি চারটি ম্যাচ।’
কর্মী: বাংলাদেশের যুবাদের শারীরিকভাবে শক্তিশালী করার পেছনে আছেন রিচার্ড স্টয়েনিয়ার, যিনি এর আগে কাজ করেছেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বোর্ডের সঙ্গে। যুবাদের ফিটনেস নিয়ে বলতে গিয়ে এই ব্রিটিশ কোচ জানালেন, ‘ছেলেদের জীবনধারাটাই পাল্টে গেছে। ক্রিকেটের বাইরে থাকলেও তারা আরও ঘাম ঝরাতে চায়। গতি বাড়াতে আমরা এক ধরনের অনুশীলন শুরু করেছি। যেটা ফুটবল ও আমেরিকান ফুটবলে ব্যবহার করা হয়। ওজন কমিয়ে তারা বেশ দ্রুতই ছুটতে পারে। পশ্চিমা মানের অ্যাথলেট হয়ে ওঠার খুব কাছে চলে এসেছে তারা। তারা যেমন অনুশীলন করে তেমনি বিশ্রামের পেছনে যথেষ্ট সময়ও ব্যয় করে।’
খালেদ মাহমুদের মতে সাউথ আফ্রিকায় যে সাফল্য পাচ্ছে বাংলাদেশ, পেছনে মাত্র ৫০ শতাংশ অবদান ক্রিকেটারদের। খেলার বাইরে ক্রিকেটারদের ভালোই যত্ন নেন সাউথ আফ্রিকায় থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীরা। সবকিছু মিলিয়ে সেখানে সময়টা ভালোই কাটছে আকবর আলীদের।
‘ধন্যবাদটা টিম ম্যানেজমেন্টের প্রাপ্য- আমাদের টিম ম্যানেজারদের। ছেলেরা প্রতিদিন স্টেক খেতে চায় না। তখন তারা বাইরে থেকে ঠিকই পছন্দের খাবারের ব্যবস্থা করেছে। যদি আপনি পছন্দমতো খাবার না খান তাহলে ঠিকমতো চিন্তাও করতে পারবেন না। আমাদের কেউ কেউ ভাত-তরকারী খেতে পছন্দ করে, তাই আমরা এ ধরনের খাবারের ব্যবস্থা করেছি যাতে ছেলেরা খুশি থাকে।’
‘মাঠে ভালো খেলা জরুরী, আবার একইসঙ্গে মাঠের বাইরে পরিবেশের সঙ্গেও মানিয়ে চলা শিখতে হবে। এখানের মানুষদের কাছে এই ছেলেরা নিজেদের সন্তানের মতো। তারা এদের সন্তানের মতো আদর করেছে। যখন আপনি দেশের বাইরে থাকবেন তখন পরিবার-স্বজনের জন্য মন পুড়বে। আমাদের আকবর এখানে আসার পর দেশে তার স্বজন হারিয়েছে, কিন্তু এই দর্শকরাই তাকে সাহস দিয়েছে।’
লম্বা পথের সমাপ্তি: এতদিনের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি শেষ হতে এখন এক ম্যাচের অপেক্ষা। রোববার ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ফাইনালে নামবে বাংলাদেশ। যুবাদের সাহস যোগাতে এরইমধ্যে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন সিনিয়র ক্রিকেটাররা।
‘এতদিন জেনে এসেছি বড়দের ক্রিকেটের চেয়ে আমরাও কোনো অংশে কম নই। আজ আমরা সেটাও প্রমাণ করে দিয়েছি। বিসিবিও বুঝতে পারবে, খেলোয়াড়দের যা দরকার তা দিতে পারলেও তারাও জন্ম দিতে পারে বিস্ময়ের।’
‘এই কাঠামো দিয়েই আমরা ভবিষ্যতের দলকে সাজাতে পারি। মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৯ দলটাকেও এভাবে সাজানো যেতে পারে। ফাইনালে হারি কিংবা জিতি, এক ম্যাচের ফল কিছুতেই আমাদের সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারবে না।’