জিহান করিম। শিল্পী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। কিউরেটর হিসেবে এর আগে ‘চেরাগী আর্ট শো ৪’-২০১৫ এবং ‘চেরাগী আর্ট শো ৬’-২০১৭ শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর দায়িত্বে ছিলেন। সম্প্রতি ‘অযান্ত্রিক’ শিরোনামের শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর কিউরেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ভারতের দিল্লিতে। এবারের ছবিমেলার দশম আসরেও পাঠশালার নির্মাণাধীন ভবনকে গ্যালারি হিসেবে ব্যবহার করে যে শিল্পকর্ম প্রদর্শনী চলছে তার কিউরেটরের দায়িত্বে আছেন জিহান করিম।
ছবিমেলার এই গ্যালারির শিল্পকর্ম প্রদর্শনের আগে-পরের চিন্তা-ভাবনা এই শিল্পী জানালেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে এক আড্ডায়:
আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংকে গ্যালারি হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা কী করে ভাবলেন?
ব্যাপারটা অনেকটুকু সময় এর দাবি। মানে বিভিন্ন কারণে ছবি মেলা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলো যে ৫ টা ভেন্যুতে প্রদর্শনীর আয়োজন করবে। আগের মত না। একটু ছোট্ট পরিসরে। পাঠশালার নির্মাণাধীন ভবনে করার সিদ্ধান্তও খুব হুট করে নেওয়া। আমাকে তানজিম ভাই ( কিউরেটর/ আয়োজক), আসিফ ভাই (কো-অর্ডিনেটর) যখন এই বিল্ডিংটা দেখাতে নিয়ে যান… বেসমেন্ট দু’টাও দেখান। খুব মনে ধরে। কারণ ডাউন টু আর্থ, লেভেল এর অনেক নিচে। স্ট্রং, ডমিনেটিং, বোল্ড ফর্ম…। মনে হলো চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য সঠিক জায়গা। ব্যাস!
শিল্প-কর্ম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এই জায়গাকে মাথায় রেখে আর্ট ওয়ার্ক নির্বাচন করেছেন নাকি বাছাইয়ের পর কী করে উপস্থাপন করবেন তা ভেবেছেন?
আমি প্রথমে কনসেপ্টটা ডেভেলপ করার চেষ্টা করেছি। তার পর শিল্পী বা শিল্প কর্ম নির্বাচন করেছি। একটা চলমান প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এগিয়েছি। আমার অনেক আগের একটা চিন্তা ছিলো। ‘মঙ্গল গ্রহ সংক্রান্ত কিছু ধারণা’ শিরোনামে একটা প্রদর্শনী করার কথা ভাবছিলাম। যেখানে শিল্পীরা সম্পূর্ণ অদেখা একটা গ্রহকে মাথায় রেখে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে নতুন ফর্মে কাজ করবে। পরে ভাবনাটা নানা কারণে বাতিল হয়।
ChobimelaX-এর এই প্রদর্শনী-স্থান দেখার পর আগের এই চিন্তা কিছুটা জেঁকে বসলো। ভাবলাম মঙ্গল গ্রহ না…! প্যারালাল কোনো জায়গা ভাবা যায় কিনা যেটা আমাদের বাস্তব ও কল্পনার মাঝামাঝি কোনো জায়গা। যেখানে বাস্তবতা/ কল্পনার নিত্য সহবাস। মানে এমন একটা জায়গা পেলে মানুষ আর কী কী ভাবতে পারে! নিজেদের ভাষা, চামড়া, কথা, ভূচিত্র, শব্দ, সংগীত, মানসিক সমস্যা.. সবকিছুকে কীভাবে দেখতে পারে… এই।
সম্পূর্ণ ভাবনাটা আর্টিস্টদের সাথে শেয়ার করলাম। অনেক ভাবে। তারা এক প্রকার এই জগতে ঢোকা শুরু করলো। সবাইকে বলতাম এই আন্ডারগ্রাউন্ডের তাপমাত্রা অনুভব করতে মাঝে মাঝে। চিন্তা, অনুভূতি মিলে হয়তো কিছু দাঁড়াবে। তারপর কাজ নিয়ে এগোতে থাকলাম। বেশির ভাগ কাজ এইখানে করা। স্থান নির্ভর বলা যায়।
এই বিল্ডিং তো ধ্বংসস্তুপের অনুভূতি তৈরি করে। মনে হয় একটা ধ্বংস্তুপের মধ্যে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্বের চিত্রগুলো ভেসে ভেসে উঠছে- মানুষকে সেই আবহের মধ্যেই কি রাখতে চেয়েছিলেন?
তেমন একটা না। তবে আমার উদ্দ্যেশ্য ছিল একটা প্ল্যানেট মাথায় রাখা যেটা আন্ডার-কনস্ট্রাকশন পর্যায়ে আছে। মানে মনে হতে পারে এখনও ডেভেলপড না কিংবা বিনির্মাণ এর পর্যায়ে আছে। সবাই ভাবছিলো একটা অদেখা জায়গায় পৌঁছালে এর ভাষা, রাজনীতি, সমাজ, ল্যান্ডস্কেপ কেমন হতে পারে। খুব প্রিমিটিভ কিছু হবার কথা বা মিনিমাল। একেবারে ব্লাঙ্ক অবস্থা থেকেও কিছু ভাবা যাচ্ছিল না কারণ আমরা মানুষ। আমাদের আসলে একটা প্রাক ধারণা আছেই। তো সবমিলিয়ে কনস্ট্রাকশন, রিকনস্ট্রাকশন এর একটা বিশাল প্যারামিটারের মধ্যে ছিলাম।
এই রকম একটা ব্যাপার ছিল পুরো কাজে। যেটা কিছুটা এই সময়কে রিপ্রেজেন্ট করে কিছু অর্থে। হ্যাঁ.. সুনির্দিষ্ট কিছু কাজে তো তা ছিল।
বিল্ডিং এর আন্ডার-গ্রাউন্ডের অংশে শিল্পীদের নাম ও শিল্পকর্মের বিবরণী ছিল না। যে কাগজ সরবরাহ করা হল ম্যাপের তাও বেশ জটিল মনে হল। অথচ উপরের অংশ বেশ গোছানো- এটা কেন?
আসলে আমি চেয়েছিলাম সবটা মিলিয়ে একটা কিছু দাঁড়াক। মানে টাইপেস্ট্রিটা অনেক সুষম হোক। মানে কেউ এ প্যারালাল স্পেস এর স্কিন নিয়ে ভেবেছে, কেউ স্মৃতি নিয়ে, কেউ চাকা নিয়ে… তো সবাই ঘুরে ফিরে ওই অজানা বিস্তৃতিকে কন্ট্রিবিউট করেছে। কালেকটিভ ভাবে। আলাদা করে তাই খুব বেশি দেখাতে চাই নি। আর আমি চাইছিলাম দর্শক আসলে আবিষ্কার করার চেষ্টা করুক কাজগুলো। আর্টিস্টদের আলাদা করে না।
মাঝে মাঝে আর্টিস্টদের আইডেন্টিটি একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায় প্রদর্শনীতে। অনেকে খুব তাড়াতাড়ি জাজমেন্টাল হয়ে পড়েন। এই চিকন লাইনটাকে একটু ঝাপসা করতে চেয়েছি। আমার মনে হয়েছিল এই ওয়ে-তে কাজটা আরেকটু মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে। তারপরেও আমি ম্যাপে কিছুটা রেফারেন্স রেখেছি।
কিছু কাজ ছিল বেশ স্পর্শকাতর, যা বিবরণীতে লিখে বোঝানো সম্ভব ছিল না। আরেকটি ব্যাপার শিল্পের বিবরণের ব্যাপারে আমি চেয়েছিলাম আর্টিস্ট কিংবা ভলেন্টিয়াররা অনেকটুকু সাহায্য করবে মানুষকে বুঝতে। দর্শক চিন্তার পাশাপাশি প্রশ্ন করুক… এটা চাইছিলাম।
হ্যাঁ, ভলেন্টিয়াররা যথেষ্ট একটিভ ছিলেন। এটা ঠিক। নিজেরাই যেচে এসে জিজ্ঞেস করছিলেন, ম্যাপ দিচ্ছিলেন। আচ্ছা কিউরেটিং এর ক্ষেত্রে কোন কোন জিনিসের দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন সবচেয়ে বেশি?
কিউরেটিং এর ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল ব্যাপার ছাড়া বাকি যা দেখার চেষ্টা করেছি তা হলো কতোটুকু স্বাভাবিক ভাবে কনসেপ্ট আর কাজ এগুচ্ছে এটা দেখা। একটু অর্গানিক। কনসেপ্টটা পানির মত ছিল। ছেড়ে দিয়ে দেখছিলাম কেমন আকার ধারণ করে। ভিন্ন ভিন্ন আর্টিস্ট ভেদে তল ভিন্ন ভিন্ন ছিল। ভিন্ন আকারও নিয়েছে।
আর্টিস্ট কাজগুলো সঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় কিনা ভেবেছিলাম। আর স্পেসটা কীভাবে ম্যানেজ করব খুব ভেবেছিলাম। কারণ আগে বলেছিলাম জায়গাটা অনেক ডমিনেটিং ছিল। আর আর্টিস্টদের সাথে অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছি। আসলে একটা প্রোডাক্টিভ কনভারসেশনে অনেক কিছু আপনা আপনি দাঁড়ায়। অনেক জনের ক্ষেত্রে ঘটেছে।
এই যে যেকোন বিল্ডিং-রাস্তা-ঘাট-আবর্জনার পাশের দেয়াল হয়ে যেতে পারে শিল্পকর্ম প্রদর্শনের স্থান- এ বিষয়ে অধিকাংশ কিউরেটর বা যারা এসব কাজ করেন তারা কতোটা সচেতন বলে মনে করেন আপনি ?
যে কোনো জায়গা ই আসলে প্লাটফর্ম। আসলে আমাদের আসে পাশে অনেক প্রদর্শনী আছে। আমাদের বাজার, কেএফসি থেকে শুরু করে চশমার দোকান…. সব। তাদের ভাষা আর উদ্দ্যেশ্য ভিন্ন। আর কিছু না। এক এক জায়গার ভিন্ন ভিন্ন শক্তি। অনেকে অনেকভাবেই সেই সম্ভাবনাকে ব্যাবহার করে। যে যার সীমাবদ্ধতা থেকে যে কোন জায়গার শক্তিকে নিজের মতো কাজে লাগাতে পারে বলেই আশা করি।
গ্যালারির একটি দেয়ালে লেখা ‘কি খোকা? শিল্প খুঁজতেছ?’- এই যে শিল্প নিজেকেই নিজে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে অবলীলায় এ ব্যাপারে আপনার কী মত ?
সম্ভবত এটা একটা কাউন্টার ডায়ালগ বলতে পারি বা দর্শক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তাও বলতে পারি। কারণ লাইনটা আমি আজকে দেখেছি। এর আগে ছিল না।
একটা অলীক কথোপকথন চলছে। হা হা হা। মনে হয় রাজীব (শিল্পী রাজীব দত্ত) এর কাজের প্রভাব। আমি গুলশান লেক এর ধারে একটা গ্রাফিতি দেখেছিলাম। একটা বুদ্ধা এর পোট্রেট পাশে লেখা ‘I want to die’। কিছু দিন পর দেখলাম তার পাশে আরো একটা গ্রাফিতি। ব্যাটম্যান এর পোট্রেট পাশে লেখা ‘NO NO’। হাহাহা।
যাই হোক। ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া বা অভিকর্ষের টানে নিচে নেমে যাওয়ার চেয়ে বড় কথা হল কতোটুকু মস্তিষ্কে অনুরণন সৃষ্টি করেছে।
কিউরেটর হিসেবে নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা আছে সামনে বা কী করছেন ইদানীং?
নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। কোনো ইন্টারেস্টিং কিছু মাথায় আসলে করবো। ‘অযান্ত্রিক’ নামে একটা শো কিউরেট করেছিলাম দিল্লিতে। ওটা ঢাকায় শো করার পরিকল্পনা আছে বেঙ্গল-এ। এ ছাড়া নিজের কিছু অডিও- ভিডিও ইনস্টলেশন কাজ শুরু করবো।