দুনিয়াজুড়ে সর্বত্রই তাদের বিজ্ঞাপনে ভরা বিলবোর্ড দেখতে পাওয়া যায়। ফুটবলের তিন মহারথী- লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও নেইমার আলো ছড়িয়েছেন রাশিয়া বিশ্বকাপেও। চিপসের প্যাকেট থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক কার্ড, কোমল পানীয়ের বোতল, মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন; কোথায় ছিলেন না এ তিনজন!
কিন্তু ১৫ জুলাই লুঝনিকিতে যখন বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচটা হয়ে গেল তখন এই তিনজনই হাজার হাজার মাইল দূরে যে যার কাজে ব্যস্ত। তখনই তিনজনের পার্থক্যটা প্রকট হয়েছে, রোনালদোর কাছে ২০১৬ ইউরো কাপ জয়টা কেমন ছিল; আর মেসি কিংবা নেইমারের কাছে চার বছর আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জয়টা কত জরুরি ছিল।
এখানেই ফুটবলের আসল কেরামতি। খেলাটা যেন এক নাটক। দর্শকরা আগ্রহ নিয়ে প্রতিটি পর্ব দেখতে বসেন। এক পর্ব দেখেই যেন আগ্রহ না হারায় তাই পরের পর্ব পর্যন্ত কাহিনী ঝুলিয়ে রাখা হয়। নাটকের অভিনেতারাও তাদের সর্বোচ্চটা দিয়েই লড়াই করে যান।
আর এই কারণেই এখন যেকোনো ট্রফির থেকে ব্যালন ডি’অর জেতাটা বেশি জরুরি। প্রতি বছরের মে’তে একটা নির্ধারিত শিরোপা জয় আপনাকে এই নিশ্চয়তা দেবে যে, সাত মাসে বাদে প্যারিসে সোনালী রঙের বলটাও আপনার হাতেই উঠতে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বকাপ জিতে সে নিশ্চয়তা কই!
বিশ্বকাপে এসব ব্যক্তিগত প্রাপ্তিকে পেছনে ফেলেই রেখে আসতে হয়। ইতিহাস লিখতে হলে শুরুতে না জ্বললেও একটা সময় জ্বলে উঠতেই হয়। কিন্তু উরুগুয়ের বিপক্ষে রোনালদো ছিলেন ছন্নছাড়া, তাই পর্তুগাল বাদ। মেসি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন তার আর্জেন্টিনাকে কীভাবে মাঠে ছিন্নভিন্ন করেছে ফ্রান্স। নেইমার মেক্সিকোর বিপক্ষে অসাধারণ খেললেও বেলজিয়ামের বিপক্ষে তার সেরাটা দিতে পারেনি, তাই তার দলেরও বিদায়।
অথচ এই খেলোয়াড়রাই ক্লাব ফুটবলে কত জটিল জটিল ম্যাচ একক নৈপুণ্যে বের করে নিয়ে এসেছেন!
তাহলে বিশ্বকাপে কেন এমন বৈষম্য! ‘গ্রেটেস্ট শো অব দ্যা আর্থ’ কেন তার সেরা ফুটবলারদের আলো থেকে বঞ্চিত হবে, মাঠে নামলে কেনই বা তারা খেলা ভুলে যান! কাইলিয়ান এমবাপে ও লুকা মদ্রিচের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলতে হচ্ছে, কতজন ভক্ত বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন যে, তারা এমন বিশ্বকাপ আশা করেছিলেন!
এখানেই ক্লাব ফুটবলের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফুটবলের মূল পার্থক্য! ক্লাবের সেরা খেলোয়াড়টিকে তার দলের শক্তি বিবেচনা করে খেলতে হয়। দলগুলো বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে তাদের দলকে গোছায়।
আর আন্তর্জাতিক ফুটবলে ক্লাবের সেই ধারাটা ধরে খেলা হয় না। আর্জেন্টিনা বছরের পর বছর মেসির সেরাটা বের করে আনার চেষ্টা করেছে যা কিনা কোনো দিনই কাজ করেনি। গত গ্রীষ্মেও যে হোর্হে সাম্পাওলি ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে, তিনিই কিনা মেসির ছায়ায় এসে পথ হারালেন, নখদন্তহীন হয়ে পড়লেন। সবাই মেসিকে দোষারোপ করলো। অথচ মাঠে একজন যোগ্য সঙ্গীর যে বড্ড অভাব মেসির সেটা কেউ বুঝতে চাইলো না। বছরের পর বছর ক্লাবগুলো যে যত্ন নিয়ে একটা দল গড়ে তোলে অল্প সময়ে তেমন একটা দল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গড়ে তোলা যে একথায় অসম্ভব।
একদম মনমত আক্রমণ ভাগ গড়ে তোলা হয়তো খুব কঠিন, কিন্তু তাহলে একটা শক্তিশালী রক্ষণ গড়ে তোলা কী খুব কঠিন! শেষ কয়েকটি ফুটবল আসর দেখলেই তো বোঝা সম্ভব যে, রক্ষণশীল ফুটবলই আসলে শিরোপা জেতায়, আক্রমনাত্নক ফুটবল খুব কম। এই উদাহরণটা প্রথম দেখা মিলেছিল ২০০৪ ইউরোতে, যেবার গ্রিস শিরোপা জিতল। তখন থেকেই এ ঘরানার ফুটবলের দারুণ কদর।
যাই হোক, বিশ্বকাপ শেষে বিজয়ের পরের গল্প বলতে গেলে দিদিয়ের দেশমের কথাই বলতে হয়। ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জেতানো এই কোচ যেমন বলেছেন, এমন উদ্ভুতুরে বিশ্বকাপ তিনি আগে কখনোই দেখেননি। রাশিয়া বিশ্বকাপে একক নৈপুণ্য দেখানো ছিল খুবই কঠিন একটা কাজ। লুকা মদ্রিচ-কেভিন ডি ব্রুইনরা তেমনই একটা দল পেয়েছিলেন বলে তারা শেষ চারে উঠেছিলেন। মেসি-নেইমার-রোনালদোরা কী তেমন দল পেয়েছিলেন? ভবিষ্যতে পাবেন?
‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে জ্যাক পিট-ব্রুকের লেখার অবলম্বনে ’