দেশের উত্তরজনপদ-মধ্যাঞ্চল ডুবেছে বন্যায়,বাঁধ ভেঙে,রাস্তার ওপর দিয়ে বইছে ঘোলা পানির স্রোত। ভেসে গেছে বাড়ি-ঘর,চুলা আর ভাতের চাল। স্রোতে ভাসা সম্বলহারা মানুষদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে একটি সাদা বাক্স হাতে হাঁটছেন লীনা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রীর হাতে থাকা বাক্সটিতে লেখা হয়েছে ‘বাড়িয়ে দাও তোমার হাত’। রাজধানীর তরুণদের স্রোতের মোহনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র টিএসসিতে লীনার সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন তরুণ।
বন্যার্ত মানুষের জন্য খাবার এবং জরুরি ওষুধ কেনার টাকা সংগ্রহ করতে পথে নেমেছেন তারা, অবলীলায় হাত পাতছেন নিজের বয়সী অন্য তরুণসহ সবার কাছে।
বন্যার্ত মানুষের জন্য বাক্সে হাতে দাঁড়িয়ে তিক্ত এবং তাক লাগানো দু’টি অভিজ্ঞতার কথা লীনা জানান চ্যানেল আই অনলাইনকে।
তিনি বলেন,“আমরা ‘বিহঙ্গ’ নামের একটি ভ্রমণ সংগঠন চালাই। নিজেদের মানবিক দায়িত্ব থেকেই বসে থাকতে পারলাম না। বাক্স হাতে টাকা তুলছি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে। আজ সকালে এক ভদ্র মহিলার কাছে সাহায্য চাইলাম। কিন্তু একটি টাকাও না দিয়ে উল্টো এমন বিরক্তি নিয়ে তাকালেন যে মনে হলো আমরা নিছক মজা করতে রাস্তায় নেমেছি! অথচ একটু পরেই মনটা ভরে গেলো, চোখে পানি চলে এলো। যখন বর্ষার কদমফুল বিক্রি করে পাওয়া টাকা থেকে দুইজন ফুল বিক্রেতা শিশু আমাদের দুই টাকা করে দিয়ে দিলো হাসিমুখে। নিজেদের সাধ্যমত সহায়তা করেছেন টিএসসির চা বিক্রেতা রুবেল ভাই, শাহবুদ্দিন ভাই।”
টিএসসির মতো একই দৃশ্য দেখা গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনের সামনে। একটি টেবিল আর তিনটি বাক্স হাতে সেখানে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণের টাকা সংগ্রহ করছে একটি ছাত্র সংগঠন। তবে সংগঠনের নামের ব্যানারে নয় বরং ‘বন্যার্তদের সহযোগিতা কেন্দ্র’ নামে অর্থ সংগ্রহ করছেন তারা।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় রাজধানীর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও বাক্স হাতে টাকা সংগ্রহ করছে তাদের সঙ্গীরা। আজ ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি থেকে ভালো সাড়া পাওয়ার কথা জানালেন এই বন্যার্ত সহযোগিতা কেন্দ্রের সাদিক রেজা।
শিক্ষার্থীদের ডেকে বন্যা দুর্গতদের জন্য সাহায্য সংগ্রহে ব্যস্ত সাদিক বলেন,‘গত বছরও উত্তরাঞ্চলের বন্যার্তদের পাশে ছিলাম আমরা। গতবার সব মিলিয়ে আমরা ৭ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। তবে এবারের বন্যার বিস্তৃতি আগের সময়ের তুলনায় বহুগুণ। এবার তাই ত্রাণের প্রয়োজন অনেক বেশি। দরকার চাল-ডালের মতো প্রয়োজনীয় খাবার,শুকনো খাবার, স্যালাইন এবং ওষুধ। গত কয়েকদিনে আমরা ভালো সাড়া পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধ্যমত সহায়তা দিচ্ছে। অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে টাকা পাঠাচ্ছে। বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত বলে জানাচ্ছে।’
লীনার দিকে ভ্রুকুচকে তাকানো ভদ্র মহিলার মতো অনেকেই হয়তো ভাবছে ‘ঘরের খেয়ে মোষ তাড়াচ্ছে’ এরা। কিন্তু এরকম ভাবনাকে পাত্তা না দিয়ে দেশের বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে শিক্ষার্থী-পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ।
ত্রাণের জন্য সাংস্কৃতিক আয়োজন
বন্যার্ত মানুষের জন্য ত্রাণের টাকা যোগাড় করতে ১৭ আগস্ট থেকে টিএসসিতে প্রতিদিন মূকাভিনয়, রম্য ও আঞ্চলিক বিতর্ক, ফিল্ম শো, ছবি প্রদর্শনী, কনসার্ট ইত্যাদি কোনো না কোন সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকবে।
টিএসসির সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন: ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফিল্ম সোসাইটি, ঢাকা ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ট্যুরিস্ট সোসাইটি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি সায়েন্স সোসাইটি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যারিয়ার ক্লাব, প্রভাতফেরী, ঢাকা ইউনিভার্সিিিট এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি আইটি সোসাইটি, স্লোগান একাত্তর,ঢাকা ইউনিভার্সিটি কুইজ সোসাইট, ঢাকা ইউনিভার্সিটি কালচারাল সোসাইটি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ব্যান্ড সোসাইটি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি রিসার্চ সোসাইটি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি লিটারেচার সোসাইটি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি মডেল ইউনাইটেড নেশন্স এসোসিয়েশন (ডিইউমুনা), ঢাকা ইউনিভার্সিটি নাট্য সংসদ সহ প্রায় প্রত্যেকটি সংগঠন এই কাযক্রমে অংশ নিচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমে সহায়তার আহ্বান
রাস্তায়-জনপরিসর থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হচ্ছে। সরাসরি যারা দুর্গত মানুষের হাতে চাল-ডাল,স্যালাইন-ওষুধ পৌঁছাতে পারছে না তাদের জন্য ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে এবং মোবাইল নম্বর দিয়ে প্ল্যাটফর্ম গড়া হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং এবং বিকাশের মতো ডিজিটাল লেনদেন মাধ্যমে দেশের ও দেশের বাইরে থাকা প্রবাসীদের কাছ থেকেও সহায়তার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
‘ব্যানার নেই, টিভি ক্যামেরা নেই’
সাংবাদিক ও সমাজকর্মী রাজিব হাসান ফেসবুকে লিখেছেন,“ ব্যানার নেই, টিভি ক্যামেরা নেই। ব্যানার বানাতে ৩০০ টাকাও যদি লাগে, সেই টাকায় তিনজন বানভাসি মানুষকে দুই বেলা হয়তো খাওয়ানো সম্ভব। আমার স্কুলের বড় ভাইয়েরা বৃহত্তর রংপুরের বানভাসি মানুষদের জন্য কাজ করছে। তাদের কোনো ব্যানার নেই।
আমি অনুরোধ করছি আপনাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করতে। ২০ টাকা হলেও বিকাশ করবেন দয়া করে। এই টাকায় একজনকে একবেলা চিড়া অন্তত দেওয়া সম্ভব। অল্প টাকা দিচ্ছেন বলে সংকোচ করবেন না।
উত্তরবঙ্গের মাটির মানুষগুলো তিন বেলা না খেয়ে থাকলেও এদের বেশির ভাগই কাউকে গিয়ে বলবেও না, ‘না খায়া আছি বাহে। মোক কিছু দ্যান।’
ত্রাণ সহায়তার জন্য টাকা দিয়ে সাহায্য করতে আগ্রহীদের জন্য তিনি লিখেছেন,“ আমি এই মানুষগুলোকে চিনি বলেই তাদের হয়ে কাতর আবেদন করছি। প্লিজ সাহায্য করুন।
ডাচ বাংলা ব্যাংক,রংপুর শাখা। অ্যাকাউন্টের নাম: মো.শারাফুল হোসাইন। অ্যাকাউন্ট নম্বর: ১৬২.১০১.২৯১৯৪। ব্যক্তিগত বিকাশ অ্যাকাউন্ট নম্বর: ০১৭১৩৩৭৬৮৬৮। আরও কিছু জানতে বিকাশ নম্বরটিতেই কল দিতে পারেন।’