নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে ডলারের দাম। চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছিল ৮০ টাকা ৫০ পয়সায়। যা এখন বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৮৬ টাকায়। সেই হিসাবে গত কয়েক মাসে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৫ টাকা। এতে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে টাকা। যে কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি ব্যয়ের চাপ বেড়ে যাওয়া, তুলনামূলক রপ্তানি ও রেমিটেন্স কমে যাওয়া, অসাধু ব্যবসায়িদের ডলার আটকে রাখা ও যুক্তরাষ্ট্রের ডলার সংগ্রহ বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে দাম বাড়ছে ডলারের।
তবে এতে রপ্তানিকারক ও রেমিটেন্স প্রেরণকারীরা লাভবান হলেও বাড়বে পণ্য উৎপাদন ব্যয়। যার ফলে বাড়তে পারে মুল্যস্ফীতি। আর এই মূল্যস্ফীতি বাড়লে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে বলে আশঙ্কা তাদের।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম বেড়েই চলছে। সর্বশেষ মার্কিন ডলারের মূল্য ৮৬ টাকায় উঠেছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো প্রতি ডলার নগদে বিক্রি করেছে ৮৬ টাকায়। আর আমদানি পর্যায়ে দায় মেটাতে নিয়েছে ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা। ডলারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্রিটিশ পাউন্ডের দামও। এই মুদ্রাটির দর উঠেছে ১২১ টাকায়।
ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার আমদানি দায় মেটাতে ব্যবসায়ীদের থেকে দেশি ও বিদেশি খাতের বেশিরভাগ ব্যাংক ডলার প্রতি নিয়েছে ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তঃব্যাংক গড় হিসেবে ওইদিন প্রতি ডলারের বিক্রয় মূল্য ছিল ৮২ টাকা ৯৮ পয়সা এবং পাউন্ডের মূল্য ১১৫ টাকা ৬১ পয়সা।
নগদ ডলারের মূল্য সবচেয়ে বেশি উঠেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে (এফএসআইবিএল)। ব্যাংকটিতে গত বৃহস্পতিবার প্রতি ডলারের দাম দাঁড়ায় ৮৬ টাকা। বিদেশি খাতের সিটিএনএ নগদ টাকায় ডলার বিক্রি করছে ৮৫ টাকা ৭৫ পয়সা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে ৮৫ টাকা ৭০ পয়সা, যমুনা ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৮৫ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া বেশিরভাগ ব্যাংকই ৮৫ টাকার ওপরে নগদ ডলার বিক্রি করছে। তবে সবচেয়ে কম দামে ৮৩ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার বিক্রি করছে ইস্টার্ন ব্যাংক।
একইভাবে ব্রিটিশ পাউন্ডের দামও বেড়েছে। ওইদিন মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংক প্রতি পাউন্ড বিক্রি করেছে ১২১ টাকায়।
জানা গেছে, বর্তমানে আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম। রেমিট্যান্স প্রবাহও নেতিবাচক। ফলে বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি; যার চাপ পড়ছে ডলারে। এছাড়া রমজান উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়াচ্ছেন। এ সুযোগে ব্যাংকগুলো প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডলার ধরে রেখে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে। খোলা বাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলারের লেনদেন বাড়াও একটি কারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী- আমদানির চেয়ে রপ্তানি কম হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মোট বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার বা ৯৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বড় বড় প্রকল্পগুলোর জন্য মূলধনী যন্ত্র ও চাল আমদানি বাড়ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ডলারের সংকট মেটাতে বিশ্ববাজার থেকে ডলার ক্রয় করছে। এসব কারণে দাম বাড়তে পারে। তবে এতে রপ্তানিকারকরা লাভবান হলেও উৎপাদন ব্যয় তথা পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা থাকে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রপ্তানি কম আমদানি বেশি, সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি, খোলা বাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলারের লেনদেন বেড়েছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ নেতিবাচক ধারায় ছিল। এসব কারণে ডলারের দাম বেড়েছে।
ডলারের দাম বাড়ায় সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়োজিত অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সর্তক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডলারের দর যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে বলা হয়। একই সঙ্গে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ডলার কিনতে নিষেধ করা হয়। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক এতে হস্তক্ষেপ করবে বলে ব্যাংকগুলোকে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র দেবাশীষ চক্রবর্তী চ্যানেল আই অনলাইনকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া দরে ব্যাংকগুলোর ডলার বিনিময় করা উচিত। তবে কোনো ব্যাংক যদি ডলার আটকিয়ে রেখে কারসাজি করে বাংলাদেশ ব্যাংক তা খতিয়ে দেখতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসানের বক্তব্যই যথার্থ। সম্প্রতি তিনি ডলার নিয়ে কথা বলেছেন।
ডলারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসান বলেছিলেন, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। এতে ডলারের ওপর চাপ রয়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডলার ধরে রাখছে। এসব কারণে ডলারের দাম বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।