প্রযুক্তির বিচিত্র আঙ্গিনাকে উদ্যান ধরে নিলে ২০০৪ সালে কলেজ পড়ুয়াদের জন্য চালু হওয়া ফেসবুক ছিল একটি চারাগাছ। সেই চারাগাছটি ১৪ বছরে ডালপালা এবং বিস্তৃত শেকড়ের এক বিশাল বৃক্ষে রূপ নিয়েছে। তাই ব্যবহারকারীর তথ্য ফাঁস, ফেইক নিউজ, নির্বাচন প্রভাবিত করার অভিযোগে মার্কিন ও ইউরোপীয় সমালোচনার ঝড়ে আপাতত কয়েকটি ডালপালা ভাঙলেও ফেসবুক নামের মহীরুহ উপড়ে পড়বে না বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এই মহীরুহের শেকড়কে মজবুত ভিত্তি দিতে প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ সিলিকন ভ্যালির সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে নিয়েছিলেন। তাই ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে ফেসবুক। আশে-পাশের বাড়ন্ত হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোকে এনেছে নিজের ছায়াতলে।
সব মিলিয়ে সর্বশেষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে ফেসবুক পৌঁছাচ্ছে বিকাশের নতুন শিখড়ে। যদিও ফেসবুকের জন্য মার্ক জাকারবার্গকে মার্কিন কংগ্রেস এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে, তবু সত্য হচ্ছে ইন্টারনেট দুনিয়ায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক। বিশেষজ্ঞরা বাস্তবতা বিবেচনা করে নির্দ্বিধায় বলছেন: অনেকের কাছে ইন্টারনেট মানেই ফেসবুক।
ডিলিট ফেসবুকসহ নানা নেতিবাচক প্রচারণার পরও থামছে না ফেসবুকের অগ্রযাত্রা। এই সামাজিক যোগাযোগের বিশাল বলয় থেকে বের হয়ে গিয়েও আবার ফিরতে হচ্ছে।
বিষয়টি তুলে ধরে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বিজ্ঞানের অধ্যাপক কাতালিনা তমা বলেন: ফেসবুক থেকে বের হয়ে যাওয়া বেশিরভাগকেই ফিরতে হয়।
ফেরার কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন: ফেসবুকে মানুষ আবেগ-সহানুভূতির চাহিদাপূরণের উপায় পাচ্ছে, পরামর্শ পাচ্ছে। চাকরি-রোজগারের খবর পাচ্ছে, নিজের জন্য কোনটি ভালো-খারাপ হবে তাও জানতে চাইছে ফেসবুকে।
তিনি বলেন, নেতিবাচক হলেও আরেকটি বিষয় মানুষকে ফেসবুকে আটকে রাখছে: অন্যের জীবনের সঙ্গে ব্যক্তির নিজের জীবনের তুলনা করার একটি অনিচ্ছাকৃত-ইচ্ছাকৃত প্রতিযোগিতা, তুলনার মঞ্চ যেন ফেসবুক।
ফেসবুক এতোই প্রভাব বিস্তার করেছে যে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, সমালোচনাকারী থেকে ব্যবসায়ে দৃষ্টি আকর্ষণকারী সব পক্ষকে ফেসবুকের দরজায় আসতেই হচ্ছে।
এই বাস্তবতা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বার্নি হোগান।
তিনি বলেন: সাধারণত আমি ফেসবুক ব্যবহার করি না। কিন্তু অনলাইনে কনসার্টের টিকেট কিনতে গিয়ে ফেসবুকে লগইন করতে হলো। আসলে ফেসবুক একজন ব্যক্তির ভার্চুয়াল পরিচিতি হয়ে গেছে।
সম্প্রতি কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে ৮৭ মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারীর তথ্য ফাঁসের খবরের পর ক্ষমা চান জাকারবার্গ। এটাকে ফেসবুকের দৌড়ে নিছক গতিরোধকের মতো বলে মনে করেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক স্কট গ্যালোওয়ে।
গ্যালোওয়ে তাঁর ‘বিগ ফোর’ বইতে লিখেছেন: ব্যবহারকারীরা ফেসবুকের নেতিবাচক দিক নিয়ে বেশ বড় গলায় কথা বললেও শেষমেশ তাদের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুককেই বেছে নিচ্ছে।
‘পরিসংখ্যান বলছে প্রতি মাসে ফেসবুক এবং ফেসবুকের আওতাধীন ইনস্টাগ্রামের ২ দশমিক ২ বিলিয়ন কার্যকর ব্যবহারকারী আছে। তাই বিজ্ঞাপনদাতাদের তো ফেসবুকে বিজ্ঞাপন না দিলে চলছে না।’
সব মিলিয়ে ফেসবুকের জন্য ‘রেস্ট ইন পিস’ বা শান্তিতে ঘুমাও লেখার সময় এখনো আসেনি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।কিন্তু ফেসবুকে অভ্যস্তদের পরবর্তী প্রজন্ম যাদের বয়স ১৬-২০ এর মধ্যে তাদের কাছে ফেসবুক আবেদন হারাচ্ছে এটাও সত্য।
ইমার্কেটার নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দেয়া পূর্বাভাস মতে, ফেসবুকে কম বয়সীদের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বেশির ভাগ কম বয়সীর কাছে এখন বাবা-মায়েদের ফেসবুকের চেয়ে নিজের স্ন্যাপচ্যাটই বেশি পছন্দের। কারণ তারা বাবা-মায়েদের নজরে নিজেদের অনলাইন কাজকর্ম আনতে চায় না।
স্ন্যাপচ্যাটে পোস্ট কিছুক্ষণ পর নিজেই মুছে যায়। তবে এই প্রবণতাও ফেসবুকের জন্য বড় কোন হুমকি নয়। কারণ পরিণত বয়সের সবার জন্য নিছক বিনোদনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মাধ্যম হয়ে গেছে ফেসবুক।
আর হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টার মতো বিষয়গুলোকে মোকাবেলার অভিজ্ঞতা তো ফেসবুকের আছেই।