কাল্পনিক চরিত্রও যে কখনো কখনো বাস্তবের চেয়ে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যেন অভিনেতা আবদুল কাদের। পরিবারের দেয়া নিজের নামটি পর্যন্ত ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো তার। কৌতুহলী পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কোন নামের আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন আবদুল কাদের?
হ্যাঁ, আলোচিত সেই ‘বদি’ নামটিই! ‘কোথাও কেউ নেই’ এর বদি। কিংবদন্তী চরিত্র বাকের ভাইয়ের সার্বক্ষণিক সঙ্গী বদি! ফিকশনাল এই নামটি আবদুল কাদের নামটিকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলো!
শনিবার যখন এই অভিনেতার মৃত্যু সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখনও তিন দশক আগের সেই বদি ফিরে আসেন বাঙালি দর্শকের মননে। তাকে স্মরণ করতে অভিনয় জগতের চেনা পরিচিত সহকর্মী থেকে গণ্ডির বাইরের সাধারণ দর্শক, ভক্ত- সবার কল্পনায় আবদুল কাদেরকে হারানোর পাশাপাশি প্রিয় চরিত্র বদিকে হারানোর সুপ্ত বেদনাও যেন চাউরে উঠে! তাইতো আবদুল কাদেরের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজ সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নাম বোধহয় ‘বদি’!
অথচ এই নামের কারণে তার বিরুদ্ধে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের হয়, স্লোগানে প্রকম্পিত হয় চারপাশ, ফোনের ওপাশ থেকে আসে হুমকি, গর্জন! চরিত্রের কী এক নিদারুণ শক্তি! একইসঙ্গে অভিনয় জীবনের সফলতার প্রতীকও এগুলো! চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বছর দুয়েক আগে ট্রেডমার্ক ‘বদি’ চরিত্রটি নিয়ে মুখ খুলেছিলেন কাদের।
এমন ঘটনা সবারই জানা যে, হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকাতে রাস্তায় নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ। রমনা থানায় নিরাপত্তা চাইতে হয়েছিল নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ এবং এর প্রযোজককেও। কিন্তু এমন ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন বাকের ভাইয়ের প্রধান সঙ্গী বদি ভাই? কারণ তিনিইতো বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছিলেন, হোক সেটা পরিস্থিতির মারপ্যাঁচে পড়ে!
বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ার অপরাধে নিজের বিরুদ্ধেও জনতার স্লোগান শুনতে হয়েছিল জানিয়ে কাদের সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,আমিতো সাক্ষী ছিলাম। তো আদালতে সাক্ষী দেয়ার আগে আমার নামেও মিছিল বের হয়। অবশ্য আমাকে মিছিলে রীতিমত হুমকিই দেয়া হতো। আমাকে উদ্দেশ্য করে এরকম স্লোগান দিত,‘বদি তুমি সাক্ষি দিলে ভাসবে তুমি খালে বিলে।’ এমনকি আমার বাসার সামনেও পোস্টার ছাপা হয়।
বাকের ভাইয়ের ফাঁসির দিনে দেশের অবস্থার কথা বর্ণনা করে কাদের ওরফে বদি সেদিন আরো বলেন, চারদিকে যখন বাকের ভাইয়ের পক্ষে মিছিল স্লোগান,তখন আমরা সবাই একসঙ্গে বসে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। আমরা হুমায়ূন ভাইকে বলতাম যেন ফাঁসি না হয়। কিন্তু হুমায়ূন ভাই দুষ্টুমি করতেন। তিনি ভাষণের মত বলতেন, বাকেরের ফাঁসি কেউ আটকাতে পারবে না। বিশ্বাস করবেন না, যেদিন বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়, সেদিন সন্ধ্যার পর থেকেই সারা শহর রীতিমত শ্মশান হয়ে যায়। সবাই টিভির সামনে বসে যায় এদিন। দেশে একেবারে কারফিউয়ের মতো অবস্থা ছিলো।
বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হওয়ার পরের অবস্থা জানিয়ে অভিনেতা সেদিন বলেছিলেন, যেদিন বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলো সেদিন হুমায়ূন ভাই নিজের বাসায় থাকলেন না। অন্য কোথাও ছিলেন। তার বাসা ঘিরে ফেলেছিলো মানুষ। আমি সাক্ষী দিয়েও বিপদে পড়লাম। বাকের ভাইয়ের ফাঁসির পর আমার বাসায় ফোন আসতে থাকলো। হুমকি দিলো আমাকে। বললো রাস্তায় বেরুলে আমার গাড়ি ভেঙে ফেলবে। একটা নাটক নিয়ে এমন উন্মাদনা ছিলো মানুষের মধ্যে।
বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে অন্যতম কালজয়ী একটি নাম ‘কোথাও কেউ নেই’। নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ধারাবাহিক প্রচার হয় নাটকটি। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত নাটকটি পরিচালনা করেন বরকত উল্লাহ। নাটকে প্রধান চরিত্রগুলো বাকের ভাই, মুনা, বদি, মজনু ও মতি চরিত্রে যথাক্রমে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফা, আবদুল কাদের, লুৎফর রহমান জর্জ ও মাহফুজ আহমেদ।