এক রমজান মাসে তাঁকে প্রথম দেখা, আরেক রমজানেই তার চিরবিদায়। হুমায়ূন আহমেদের লেখার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৮৪ সালের রমজান মাসে। চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম আপার বাসায়। শেলফ ভর্তি বই তাদের। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ পরিষদ (এখন যেটা গণগ্রন্থাগার)-কে বইয়ের ঠিকানা করা এই কিশোর আমি কোনো বাড়িতে এর আগে এতো বই একসঙ্গে দেখিনি। প্রথমেই পরিচিত সব লেখকের বই শেষ করে ফেললাম। এরপর অজানা লেখকদের বই। একদিন হাতে উঠে আসলো ‘সবাই গেছে বনে’।
গল্প বলার নতুন এক ধরণের কারণেই বোধহয় এক বসায় ওই বই পড়া শেষ। এরপর শেলফ তন্ন তন্ন করে এই লেখকের আর কোনো বই পেলাম না। ময়মনসিংহে ফিরে পাবলিক লাইব্রেরি খুঁজেও তাঁর আর কোনো বই পাই নি। এরপর একসময় হয়তো ভুলেই গিয়েছিলাম তাঁর নাম।
আমার কাছে হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় আবির্ভাব ১৯৮৬ সালে এসএসসি পাস করার পর। ভালো রেজাল্টের কারণে রিমা আন্টি উপহার দিলেন দুটি বই। তার একটি ‘আমার আছে জল’। চোখের জল আর নাকের পানি এক করে আবারও সেই এক বসায় পড়া। এবং সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত আরো বই পড়তে হবে তাঁর। ততোদিনে একটু বড় হয়েছি, জেনে গেছি কোথায় গেলে তাঁর বই পাওয়া যাবে। আর এতোদিন বই কেনার জন্য টাকা যে একটা বড় সমস্যা সেটা কিছুটা কেটেছে। নিম্নবিত্ত পরিবার হলেও একটু আধটু পকেট মানি আছে। সঞ্চয় যা ছিলো নিয়ে চলে গেলাম গাঙ্গিনারপাড় মোড়ে। পারুল লাইব্রেরি আর কবির লাইব্রেরি থেকে কিনে ফেললাম হুমায়ূন আহমেদের বেশ কয়েকটি বই।
‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এ এবার অন্য এক হুমায়ূনের সঙ্গে পরিচয়। তার লেখা পড়তে পড়তে অবাক বিষয় যে নিজেও কিছু কিছু লেখা শুরু করে দিলাম। এখন ভাবলে বেশ অবাক লাগে যে ময়মনসিংহের ‘আজকের বাংলাদেশ’ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আমার ধারাবাহিক উপন্যাস ‘রোদন ভরা বসন্ত’ প্রকাশ হলো। বুক পোস্টে পাঠানো লেখাগুলো প্রকাশ হতে শুরু করলো ঢাকার পত্রিকার সাহিত্য পাতা আর ছোটদের পাতাগুলোতে।
এর মধ্যেই আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটে গেছে। দেখা হয়ে গেলো স্বপ্নের নায়ক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। তবে সেটা হঠাৎ নয়। বেশ ঘটা করে বেশকিছু আয়োজনের ফল হিসেবে।
এখন যেমন হুটহাট লেখকদের বই বের হয়ে যায়, তখন সেরকম ছিলো না। ময়মনসিংহের অনেক কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গেই পরিচয়। কিন্তু বই প্রকাশ হয়েছে, এমন লেখক বা কবির সংখ্যা খুব কম। সে বছর প্রকাশ হলো সালিম হাসানের ‘পরীবানু সংবাদ’। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তার প্রকাশনা অনুষ্ঠান, যেখানে প্রধান অতিথি হুমায়ূন আহমেদ।
তিনি আমাদের শহরে আসছেন, সামনাসামনি তাঁকে দেখবো, তাঁর কথা সামনাসামনি শুনবো, এমন উত্তেজনায় কাটলো কয়েকদিন। সঙ্গে পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলো হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে হুমায়ূন আহমেদের নিজের হাতে লেখা আর সই নিয়ে রাখতে হবে।
অনুষ্ঠানের বিকেলে একটু আগেই বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। প্রথমে পারুল লাইব্রেরি থেকে কিনলাম ঈদ সংখ্যা বিচিত্রায় পড়া হুমায়ূনের উপন্যাস ‘অপরাহ্ন’। এরপর ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে বসে তাঁর জন্য অপেক্ষা। এর মধ্যে অবশ্য ‘পরীবানু সংবাদ’ কিনে সালিম হাসানের অটোগ্রাফ নিয়ে রেখেছি। আমার কাছে তিনিই প্রথম লেখক যার বই প্রকাশ হয়েছে, কিন্তু আমার মতো কৈশোর পার হওয়া একটা ছেলেকে চেনেন। কিন্তু হুমায়ূনকে দেখতে যাচ্ছি বলে ভেতরে যে উত্তেজনা, তার কাছে এটা কোনো বিষয়ই না।
অবশেষে সেই অপরাহ্নে আমাদের অপেক্ষা শেষে তিনি আসলেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁকে মিলনায়তনে ঢুকতে দেখলাম, মঞ্চে আসন গ্রহণ করতে দেখলাম। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন আরো কয়েকজন। তাঁরাও খুব নামকরা মানুষ। কিন্তু হুমায়ূনের কাছে তাঁদের উপস্থিতি খুবই নগণ্য। তারা জ্ঞানগর্ভ অনেক কথা বললেন। কিন্তু আমার চোখ মঞ্চে হুমায়ূনের দিকে। তাঁর চোখের প্রতিটি নড়াচড়া, চেয়ার একটু সামনে বা পেছনে নেওয়া, বলপয়েন্টে আঁকিবুঁকি; সবই দেখছিলাম অপার মুগ্ধতা নিয়ে। অবশেষে বক্তা হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করলেন সম্ভবত: আমজাদ দোলন।
তিনি শুরুতেই সেই গল্পটা বললেন। ওই যে মার্কিন মুল্লুকে তাঁর কন্যা সন্তানের জন্মের পর আযান দেওয়ার ঘটনা। এরপর বললেন: আমাদের দেশে এখন একটা চল হয়েছে। কারো বই প্রকাশ হলে আযান দেওয়া হয়। আদর করে আমরা এর নাম দিয়েছি প্রকাশনা উৎসব।
মিলনায়তন ভর্তি শ্রোতাকে এভাবে আনন্দে ভাসাতে ভাসাতে সেদিন সূক্ষভাবে অনেক সত্য কথা তুলে ধরেছিলেন যেটা ছিলো হুমায়ূন আহমেদের স্টাইল। পনেরো থেকে বিশ মিনিট কথা বলেছিলেন তিনি। আমার কাছে এখনও সেটা আমার শোনা সেরা বক্তৃতাগুলোর একটি।
অনুষ্ঠান শেষে যথারীতি তাঁর সামনে দীর্ঘ লাইন। কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছেন, কেউ শুভেচ্ছা বিনিময়। লাইনে দাঁড়িয়ে আমার পালা আসার পর আমি তাঁর সামনে তুলে ধরলাম তাঁর লেখা উপন্যাস ‘অপরাহ্ন’। তিনি আমার দিকে তাকালেন। কি পড়ি জানতে চাইলেন। বইটা পড়েছি কি না সেটাও। আমি তখন যেনো এক আলোকরশ্মির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো যে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন। এই উপন্যাসটা পড়েছি জানিয়ে তাঁর অন্য বইগুলো নিয়ে নাতিদীর্ঘ একটা বক্তৃতাই করে ফেললাম। তিনি মিটিমিটি হাসিতে শুনলেন। এরপর বললেন, এই বইটা আমার খুব প্রিয়।
লেখক হিসেবে নিজের কাছে তাঁর সব বই-ই প্রিয় হওয়ার কথা। কিন্তু এমন লেখক খুব কমই আছেন যার সব লেখাই পাঠকদের কাছে খুব প্রিয়।
সেই প্রিয় লেখকের সঙ্গে দ্বিতীয় দেখা হওয়ার কথা ছিলো ১৯৯০ সালের রমজান মাসে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও ‘এখনই সময়’ পত্রিকায় কাজ করি। সামনে ঈদ। ঈদ সংখ্যার জন্য হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রয়োজন। কিন্তু একে তো ছোট পত্রিকার বাজেট কম, তার ওপর শেষ সময়ে অতো বড় লেখকের লেখা চাওয়া অন্যায়। তারপরও হুমায়ূনের লেখা ছাড়া ঈদ সংখ্যা হয় নাকি!
একটি বিশেষ সূত্রে যোগাযোগ করা হলো। উনি লিখতে রাজি হলেন। কিন্তু অবশ্যই কোনো উপন্যাস না, একটা ছোট গল্প। সেই লেখা যখন আনার সময় আসলো, আমারই যাওয়ার কথা নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু আমি গেলাম না। খুব বাস্তবসঙ্গত বিষয় হলেও প্রিয় লেখককে সম্মানীর টাকার খাম দেওয়াটা আমার জন্য অস্বস্তির বিষয় হবে তাই অন্য একজনকে পাঠালাম।
তবে তার সেই স্ক্রিপ্ট ছিলো বিশেষ কিছু, বিশেষ করে তাঁর লেখার প্রথম বা দ্বিতীয় পাঠক হওয়া অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। অনেক জায়গায় কাটাকুটির বদলে অন্য কাগজে লিখে আঁঠা দিয়ে লাগানো। দ্রুত সেই লেখা কম্পোজ করা হলো। আমি নিজে অভিধান ঘেঁটে ঘেঁটে প্রুফ দেখলাম যাতে ছোট একটা ভুলও না থাকে। গল্পটা পরে বিটিভিতে নাটক হিসেবে প্রচার হয়েছিলো।
এরপর হুমায়ূন আহমেদকে মাঝেমধ্যে দেখেছি বইমেলায়। তাঁর সামনে বিশাল পাঠকের সারি। সবাই তাঁর অটোগ্রাফ চান। অতো ভিড় ঠেলে কখনও যাওয়া হয় নি। আর তাঁর কোনো বইয়ে তাঁর সই তো আমার কাছে অনেক বছর ধরেই আছে। অন্য কোনো অনুষ্ঠানেও তাঁর সঙ্গে আর দেখা হওয়ার সুযোগ হয় নি।
সেই সুযোগ যখন আসলো তখন সাধারণে খবর না হলেও আমরা জেনে গেছি ক্যান্সারে আক্রান্ত তিনি। নিউ ইয়র্কে চিকিৎসার জন্য যাবার কিছুদিন আগে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি চ্যানেল আই ছাদ বারান্দায় এসেছিলেন। সেদিন শুক্রবার ছিলো। অফিসে লোকজন একেবারেই কম। ছাদ বারান্দার শপের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, শুভ্র শাদা মখমলে কাপড়ের সজ্জায় বিশেষ ওই আয়োজনে চারজন মানুষ। হুমায়ূন আহমেদ, তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং নিনিত ও নিষাদ। শুধু ওই পরিবারের জন্যই ছিলো ওই আয়োজন। তাই চাইলেও কথা বলতে যাওয়া হয় নি। তবে নক্ষত্রের রাতে দূর থেকে চারজন মানুষের সুখের পরশটা বোঝা যাচ্ছিলো। চারজনই যেনো শিশু, নিজেদের মধ্যে অপার মমতার এক টুকরো স্বর্গ।
সেই শেষ। এরপর তিনি নিউ ইয়র্কে গেলেন, আসলেন, আবার গেলেন এবং আবার যেভাবে আসলেন কেউ দূরতম কল্পনাতেও ভাবেন নি এতো তাড়াতাড়ি তিনি ছেড়ে যাবেন। কিন্তু চাইলেই কি তিনি অাকাশের ওপারে থাকতে পারেন! হয়তো আয়োজনের ঘনঘটা কম। কিন্তু লাখো কোটি মানুষের কাছে তাঁর লেখার মধ্যেই যে বেঁচে আছেন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ।