বাংলাদেশে নারী ধর্ষিত হয়। মাঠে, ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, ঘরে, বাইরে, সব সব জায়গায়। বাংলাদেশে নেতা ধর্ষণ করে, কর্মী ধর্ষণ করে, ছাত্র ধর্ষণ করে, শিক্ষক ধর্ষণ করে, শ্রমিক ধর্ষণ করে, মালিক ধর্ষণ করে, নিকটআত্মীয় ধর্ষণ করে, অনাত্মীয় ধর্ষণ করে, প্রতিবেশি ধর্ষণ করে, ইমাম ধর্ষণ করে, মুয়াজ্জিন ধর্ষণ করে, পুলিশ ধর্ষণ করে, চোর বাটপার ধর্ষণ করে, শিল্পী ধর্ষণ করে, লেখক ধর্ষণ করে, কবি ধর্ষণ করে, বাবা ধর্ষণ করে, ভাই করে ধর্ষণ করে, সহকর্মী ধর্ষণ করে, সহপাঠী ধর্ষণ করে। এইদেশে ধর্ষকের বয়স কিশোর থেকে ঘাটের মরা অব্দি। আর ধর্ষণের শিকার হয় কয়দিনের শিশু থেকে বৃদ্ধা অব্দি। তারপরও প্রতিবাদে মানুষের ঢল রাস্তায় নেমে আসে না। হাতে গোনা কিছু মানুষ দিনের পর দিন অনলাইনে, অফলাইনে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, রাস্তায় একা বা গুটিকয় সমমনা মিলে চিৎকার করে যাচ্ছেন, তবু হালে পানি পাচ্ছেন না তেমন।
সাম্প্রতিক কোটা বিরোধী মেধাবীদের আন্দোলন নিয়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত অনেকে আাশাবাদি হয়ে উঠেছেন। অনেকে ভেবে নিয়েছেন তরুণ প্রজন্ম জেগেছে এবার। কেউ কেউ বলছেন, এবার আমরা এই তারুণ্যের শক্তি কাজে লাগিয়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধেও দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। উনাদের আশার বাঁধ অচিরেই ভেঙ্গে পড়বে দেখে আমার দুঃখ হয় উনাদের জন্য।
কোটা সংস্কার আন্দোলন একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুবিধার আন্দোলন। শুধুমাত্র মধ্যবিত্তের সুবিধাভোগী অংশের আরো নিশ্চিন্ত অর্থনৈতিক অবস্থানে যাওয়ার আন্দোলন এবং মোটা দাগে একটি পুরুষতান্ত্রিক আন্দোলন। নারীবাদ ক্ষমতার যে কাঠামোর বিরোধীতা করে এই আন্দোলন সেই কাঠামোতে সমর্থন জুগিয়েছে। কোটা তুলে দেয়ায় মূলতঃ উপকৃত হবে সমাজে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা শিক্ষিত পুরুষ। প্রশাসনিক কাঠামোতে নারী পুরুষের সমতার যে বৈষম্য বিদ্যমান, সেটা আরো প্রসারিত হবে। আন্দোলনে থাকা নারীদের সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই। তাই তারা জোর গলায় বলছেন, বাংলাদেশে নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে গেছে। নারীর জন্য আলাদা কোটার দরকার নেই। সাথে গলা মিলিয়েছেন অনেক নারীবাদিরাও। যারা আমার কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে চান, তারা নারীর অর্থনৈতিক সমতার একটা আন্দোলন করে দেখান। বেশি না, শুধু সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার দেয়ার জন্য তরুন প্রজন্মকে মাঠে নামিয়ে দেখান। তবে বুঝবো দাবী আদায় হোক বা না হোক, সমানাধিকারের ঝান্ডাধারীরা অন্ততঃ সৎভাবে সমানাধিকার চান।
কোটা আন্দোলন দেখে একজন নারী অধিকার নিয়ে মাঠে থাকা নারী হতাশ হয়ে লিখেছেন, ধর্ষণের বিচার চাওয়ার সময় এমন আন্দোলন হয় না কেন? অবরোধ হয় না কেন? আরেকজন আরো হতাশা থেকে লিখেছেন, বাংলাদেশের প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে একটা করে ধর্ষিতার প্রয়োজন। তখন একটা কাঁপুনি দেবে গোটা বাংলাদেশ। পোশাক ট্যাবু, পর্দা ট্যাবু, ধর্ম ট্যাবু, পুরুষের চোখের পর্দা -নারীর পোশাকের পর্দা সব সব সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নামবে তখন।
এগুলো ক্ষোভের কথা হলেও আমি হলফ করে বলতে পারি, সমানাধিকারের জিকির তোলা কোটা বিরোধী এই আন্দোলনের সিকি ভাগও নারী পুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাস করে না, সিকি ভাগও সমতা আর সাম্যের পার্থক্য বোঝে না, সিকি ভাগেরও নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নাই। বরং নব্বই ভাগই নারীকে শালীনতা শেখাতে আগ্রহী, নব্বই ভাগই পোশাককে ধর্ষণের কারণ মনে করে, নব্বই ভাগই নারীর সম্মান বলতে বোঝে শুধু নিজের মা আর বোনের সম্মান।
ধর্ষণের কারণে মেধাবীরা (অবশ্যই পুরুষ) কোন সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় না, ধর্ষণের সুযোগ থেকেতো নয়ই। এবং সেটাই মূল সূত্র। স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা না থাকলে আবার আন্দোলন কিসের? ধর্ষণের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক থাকলেও রুটি রুজি বা চাকরীর কোন সম্পর্ক নেই। ধর্ষণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে যুক্ত নয়। তাই ধর্ষণ প্রতিরোধ মধ্যবিত্তের প্রাণের দাবীও নয়। ধর্ষণ কোন মেধাবী পুরুষের মাঝে বৈষম্যের অনুভূতি তৈরি করে না। এবং একারণেই এই দেশে আন্দোলনে টিয়ারশেল বা মিডিয়াকে নিয়ে অশ্রাব্য ভাষার লিফলেট নিয়ে দাড়ানোর পরেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী ছাত্রীরা ওই ভাষার প্রতিবাদ করে না। এরকম পোস্টার হাতে আন্দোলনকারীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আপাত অর্থনৈতিক সুবিধার সম্ভাবনা তাকে নারীর অসম্মানকে ভুলিয়ে দেয়।
আন্দোলনের মেধাবী নেত্রী ও সমর্থক নারীবাদিরা মনে করে নারীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থার দরকার নাই। তাদের গেলানো হয়, কোটা নারীর জন্য অপমান এবং তারা সেটা গেলে। কারণ তার অর্থনৈতিক গন্ডির বাইরে যে আরো নারী আছে, তাদের কথা তারা ভাবতে রাজী নয়। এই দেশের তরুণ প্রজন্ম এবং তাদের সমর্থকরা সমানাধিকার বলতে শুধু নিজের ভালো থাকা বোঝে এবং কেউ দ্বিমত করলে তার প্রতি তীব্র ঘৃণার চাষ করে।
যে দেশের আপামর জনসাধারণের সমানাধিকার নিয়ে মাইন্ড সেট এরকম ব্যক্তি স্বার্থ কেন্দ্রিক, সেই দেশে আর যাই হোক ধর্ষণ বিরোধী স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলন বা নারী পুরুষের সমতার আন্দোলন হবে না, হতে পারে না। এই তরুণ-তরুণীদের নিয়ে আশাবাদি নারীবাদিদের প্রতি আমার উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ রইলো। পারলে আন্দোলন করে দেখান।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)