চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

যেভাবে স্মৃতিসৌধের ধারণা, যেভাবে জাতীয় স্মৃতিসৌধ

কোনো ধরণের স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিফলক নেই, এমন স্বাধীন দেশ পৃথিবীতে খুব কম। ভারতের অনেক মানুষ প্রথমে স্বাধীনতা অর্জনে এবং পরে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রাণ দিলেও দেশটির কোনো জাতীয় স্মৃতিসৌধ নেই। তবে দেশজুড়ে স্থানীয়ভাবে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ আছে অনেক।

সাধারণ অর্থে স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ হলো এমন একটি বস্তু যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাকে স্মরণ করা হয়। নামফলক, সমাধিক্ষেত্র, কবরফলক, ভাস্কর্য, গণকবর, বধ্যভূমি থেকে শুরু করে দেয়াল, ভবন, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা, পার্ক যে কোনো কিছুই স্মৃতিচিহ্ন বা স্মৃতিসৌধ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে।

জার্মানির স্যাক্সনিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ

যুদ্ধের স্মৃতিসৌধও মূলত একই জিনিস। তবে এটি এমন একটি স্থাপনা, যা কোনো যুদ্ধে জয়ের প্রতীক হিসেবে বা যুদ্ধে হতাহতদের স্মরণ করার জন্য নির্মিত হয়।

ফ্রান্সের বার্নেনেজে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০০ সালের সমাধিসৌধ

বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও পুরাণে স্মৃতিস্তম্ভ বা এ ধরণের স্মারক নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে ভবিষ্যতের মানুষদের জানানো এবং তাদের স্মরণ করার উপায় হিসেবেই স্মৃতিফলকের ধারণা এসেছে বলে মনে করে যুক্তরাজ্যের ওয়ার মেমোরিয়াল ট্রাস্ট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের স্মরণে ব্রাজিলে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ

একেকটি স্মৃতিসৌধ ইতিহাসের দেয়ালের একেকটি ইট। এছাড়াও ঘটনা ঘটার স্থান চিহ্নিত করাও এর একটি উদ্দেশ্য বলে মনে করেন ইতিহাসবিদেরা।

যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ
শুধু যুদ্ধের কারণে নির্মিত স্মৃতিফলকের কথা বলা হলে, বিশ্বজুড়ে এ ধরণের অসংখ্য স্থাপনা রয়েছে। সবগুলো নির্মাণের সঠিক সময়কাল এবং নিখুঁত ইতিহাসও নথিবদ্ধ করা হয়নি এখনো। তবে সবগুলোই যে কোনো না কোনো যুদ্ধ বা যুদ্ধে প্রাণ হারানো যোদ্ধাদের স্মরণে তৈরি, সে কাহিনী স্থানীয় লোকজন তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ঠিকই সংরক্ষণ করে আসছে।

বেলজিয়ামে স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ব্যবহৃত যুদ্ধের এম৪ শারম্যান ট্যাংক

বিশ্বজুড়ে যেসব যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ সম্পর্কে তথ্য এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা গেছে সেগুলো অনুসারে, বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো স্মৃতিস্তম্ভ হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অল সোউলস কলেজ’। অর্থাৎ পুরো কলেজই একটা স্মৃতিচিহ্ন। এর ফেলোরা তৎকালীন ফ্রান্স সাম্রাজ্যের সঙ্গে ইংল্যান্ড সাম্রাজ্যের শতবর্ষ ধরে চলে আসা যুদ্ধে নিহত ইংলিশ যোদ্ধাদের জন্য প্রার্থনা করবেন, এই আশায় ১৪৩৮ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৩৩৭ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধটি কলেজ প্রতিষ্ঠার আরও প্রায় ১৬ বছর পর, অর্থাৎ ১৪৫৩ সালে শেষ হয়।

অক্সফোর্ডের অল সোউলস কলেজ

আরও একটি স্থাপনা অতীতের আরেক যুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে। আর সেটি হচ্ছে ইংল্যান্ডের মিডলটনে অবস্থিত চার্চ অব সেইন্ট লিওনার্ড। স্কটল্যান্ডের রাজা চতুর্থ জেমস ইংল্যান্ডে হামলা চালালে ১৫১৩ সালে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য স্যার টমাস অ্যাশটন তার সশস্ত্র সেনাদল নিয়ে প্রথমে মিডলটন হলের বাইরে জমায়েত হন এবং যুদ্ধে যাওয়ার আগে চার্চ অব সেইন্ট লিওনার্ডে গিয়ে প্রার্থনা করেন।

চার্চ অব সেইন্ট লিওনার্ডের বিখ্যাত স্মারক জানালা

ওই যুদ্ধে জিতে নাইট উপাধি পান স্যার রিচার্ড। পরে চার্চটিতে ফিরে সেটিকে পুনর্নিমাণ করে ১৫২৪ সালে একে সেই ওয়ার অব ফ্লডেন-এর স্মারক ঘোষণা করেন তিনি। মূল চার্চটি অল সোউলস কলেজের অনেক আগে, ১৪১২ সালে নির্মিত হয়েছিল। তবে যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ঘোষিত হয় পরে। যুদ্ধ জয়ে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকেই চার্চটিকে স্মৃতিস্তম্ভে রূপান্তরের ধারণা আসে স্যার রিচার্ডের মনে।

ইরাকের আল-শহীদ স্মৃতিসৌধ

যুদ্ধের স্মৃতি সবসময়ই ভয়াবহ। আর যুদ্ধের স্মরণে নির্মিত যে কোনো কিছু সেই ভয়াবহতাকেই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু তারপরও স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয় কেন?

অনলাইন বিশ্বকোষ এনসাইক্লোপিডিয়া ডট কম-এ বলা হয়েছে, একটি যুদ্ধের স্মৃতিসৌধ কেমনভাবে যুদ্ধটিকে উপস্থাপন করবে তা নির্ভর করে দু’টি বিষয়ের ওপর: ১. যুদ্ধের ফলাফল জয় না পরাজয়, এবং ২. যুদ্ধটিকে প্রয়োজনীয় না অপ্রয়োজনীয়, নৈতিকভাবে সঠিক না ভুল – কোন দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে সেই দৃষ্টিভঙ্গি।

চীনের ‘মনুমেন্ট অব দ্য পিপলস হিরোজ’

অর্থাৎ, যুদ্ধ যতই ত্যাগ আর কষ্টের কারণ হোক, যুদ্ধের পর বিজয় এলে তা মনে রাখা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয়ার মধ্যে যেমন গর্ব আছে; তেমনি হারজিত যা-ই হোক, যুদ্ধে প্রাণ হারানো বীরদের মনে রাখা ও শ্রদ্ধা জানানোটাকেও সমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করে। কবরে কবরফলক থেকে শুরু করে মিশরের পিরামিড – এর সবকিছুর মধ্যেই মৃতকে শ্রদ্ধা জানানো ও তার স্মৃতি ধরে রাখার বিষয়টি রয়েছে। যুদ্ধ স্মৃতিসৌধ তারই একটি বিবর্তিত রূপ।

কুমিল্লার ময়নামতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত যোদ্ধাদের সমাধিক্ষেত্র

আমেরিকান বৈপ্লবিক যুদ্ধে (১৭৭৫-৮৩) আমেরিকার জয় এবং অবশেষে স্বাধীনতা এলেও এর যোদ্ধাদের মধ্যে যুদ্ধকে মনে করা বা তা নিয়ে আলোচনা করার খুব একটা প্রবণতা ছিল না। এর ফলে ১৮ ও ১৯ শতকে যে স্মৃতিফলকগুলো নির্মিত হয়েছিল তার বেশিরভাগেরই অবয়ব ছিল যুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে অস্পষ্ট। এমনকি এই যুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্মৃতিসৌধ বাঙ্কার হিল অবিলিস্ক যেমন সাদামাটা, তেমনই তার আকার আকৃতি বা চেহারার সঙ্গে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের কোনো মিলই নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের বাঙ্কার হিল অবিলিস্ক

কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ দু’টিতে বিজয়ী এবং পরাজিত দু’পক্ষই যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুভব করেছে। তাই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেশ দ্রুতই বিভিন্ন দেশে বিশ্বযুদ্ধের স্মরণে অর্থপূর্ণ স্মৃতিসৌধ ও নিহতদের জন্য বিশেষ সমাধিক্ষেত্রসহ আরও অনেক কিছু গড়ে ওঠে। বিজয়ী পক্ষগুলোর স্থাপনাগুলোতে বেশি নিজেদের মহিমান্বিতভাবে প্রকাশের ছাপ। হেরে যাওয়া দেশগুলোর স্মৃতিস্তম্ভে নিজেদের ত্যাগের মহিমার পাশাপাশি হারানোর বেদনা ফুটে উঠেছে।

মিশরে ৭৩-এর যুদ্ধে নিহত মিশরীয় এবং আরবদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ

বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একই সঙ্গে ত্যাগ এবং বিজয়ের সুতোয় গাঁথা। বাঙ্গালি জাতি সবসময়ই তাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরব প্রকাশে আগ্রহী। তাই বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ও বিজয় প্রকাশের উপযুক্ত প্রতীক হিসেবে।

সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ

মুক্তিযুদ্ধে জীবন দেয়া লাখো শহীদের স্মরণে নির্মিত বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্যের মধ্যে প্রধান এবং প্রথম হলো সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সময় তোলা ছবি

দেড়শ’ ফুট বা ৪৫ মিটার উঁচু এই স্মৃতিসৌধে রয়েছে ৭টি ফলক। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ৭টি পর্যায়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। পর্যায়গুলোর প্রথমটি হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। এরপর চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছাপ্পান্নর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুথানের পর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় আর স্বাধীনতা। অর্থাৎ প্রতিটি বড় পরিসরের ঘটনা, আন্দোলন ও বিজয়ের ধারণা এক করে জাতীয় স্মৃতিসৌধের রূপ দেয়া হয়েছে।

ওপর থেকে স্মৃতিসৌধের সামনের দৃশ্য
ওপর থেকে স্মৃতিসৌধের পেছনের দৃশ্য

স্মৃতিসৌধটি বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন রকম দেখা যায়। স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের নকশা অনুসারে এর মূল কাঠামো কংক্রিটের এবং কমপ্লেক্সের অন্যান্য স্থাপনা লাল ইটে তৈরি করা হয়। মূল সৌধের গাম্ভীর্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য এই রঙ ও উপকরণের পার্থক্য। এর মধ্য দিয়ে রক্তের লাল জমিনে স্বাধীনতার স্বতন্ত্র জেগে ওঠাকে বোঝানো হয়েছে।

একপাশ থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এমন দেখা যায়