অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলার দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পর বহুল আলোচিত প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি গ্রুপের শীর্ষ কয়েক ব্যক্তিসহ ৪৬ আসামীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ড-ও দিয়েছেন আদালত।
কার কত সাজা
বৃহস্পতিবার যারা সাজা পেয়েছেন তাদের রয়েছেন ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন, কোম্পানির প্রেসিডেন্ট এম হারুন-অর-রশীদ ও ডেসটিনির চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম ১২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন রফিকুল আমীনকে। পাশাপাশি তাকে ২০০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। আরেক আসামী এম হারুন-অর-রশীদের ৪ বছরের কারাদণ্ড এবং সাড়ে ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ড হয়েছে। আর মোহাম্মদ হোসেনকে দেয়া হয়েছে ১০ বছর কারাদণ্ড ও দেড় কোটি টাকা অর্থদণ্ড।
এই তিনজনের বাইরে বাকি আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ ৫ বছর আবার কেউ ৯ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন। এসব আসামীর প্রত্যেকেই অর্থদণ্ড দেয়া হয়।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারী
রফিকুল আমিনসহ এসব আসামীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছিল ২০১২ সালের ৩১ জুলাই। রাজধানীর কলাবাগান থানায় দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলায় মূল অভিযোগ ছিল ‘ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ এবং ‘ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেড’ এর নামে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৪ হাজার ১১৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন।
আসামী যারা
এই দুই মামলায় রফিকুল আমীন, এম হারুন-অর-রশীদ এবং মোহাম্মদ হোসেনসহ মোট আসামী হন ৫৩ জন। যাদের মধ্যে ৪৬ জন দুই মামলাতেই আসামী। তারা হলেন; মোহাম্মদ গোফরানুল হক, মোহাম্মদ সাঈদ-উর-রহমান, মেজবাহ উদ্দিন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ইরফান আহমেদ, ফারাহ দিবা, জামসেদ আরা চৌধুরী, শেখ তৈয়েবুর রহমান, নেপাল চন্দ্র বিশ্বাস, জাকির হোসেন, আজাদ রহমান, আকবর হোসেন, মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, সাইদুল ইসলাম খান, সুমন আলী খান, শিরীন আকতার, রফিকুল ইসলাম সরকার, মজিবুর রহমান, দিদারুল আলম, এম হায়দার উজ্জামান, জয়নাল আবেদীন, কাজী মো. ফজলুল করিম, মোল্লা আল আমীন, শফিউল ইসলাম, জিয়াউল হক মোল্লা, সিকদার কবিরুল ইসলাম, ফিরোজ আলম, ওমর ফারুক, সুনীল বরণ কর্মকার, ফরিদ আকতার, এস সহিদুজ্জামান চয়ন, আবদুর রহমান, সাকিবুজ্জামান, এস এম আহসানুল কবির, এ এইচ এম আতাউর রহমান, জি এম গোলাম কিবরিয়া, আতিকুর রহমান, খন্দকার বেনজীর আহমদ, এ কে এম সফিউল্লাহ, শাহ আলম, দেলোয়ার হোসেন, জেসমিন আক্তার ও শফিকুল হক।
অভিযোগপত্রে যা উঠে আসে
প্রায় দুই বছর অনুসন্ধানের পর ২০১৪ সালের ৪ মে দুদক এই মামলা দুটির অভিযোগপত্র দেয়। তার একটির অভিযোগপত্রে বলা হয়, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে ১ হাজার ৮৬১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এই অর্থ আত্মসাতের কারণে সাড়ে আট লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন।
আরেক মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০০৮ সাল থেকে ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাড়ে ১৭ লাখ বিনিয়োগকারী।
বিতর্কিত এক কোম্পানি ডেসটিনি-২০০০ লি.
একটি বাণিজ্য গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি পেলেও তাদের উত্থান ছিল বিতর্কিত পদ্ধতিতে। ডেসটিনি-২০০০ লি. সরাসরি বিক্রয়ের নামে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) এবং পনজি স্কিম পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করত। এক পর্যায়ে ধরা পরে তাদের প্রতারণা। নিষিদ্ধ করা হয় এমএলএম ব্যবসা। কিন্তু ততদিনে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করে ডেসটিনি। যাতে সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হন প্রায় ২৪ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী।
ডেসটিনি-২০০০ লি. দিয়ে শুরু হলেও মিডিয়াসহ গ্রুপের মোট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫টি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪৫ লাখ ক্রেতা-পরিবেশক-সহ প্রায় ২ কোটি মানুষ সরাসরি যুক্ত ছিল। ডেসটিনি গ্রুপে দাবি, এসব প্রতিষ্ঠানে তাদের বিনিয়োগে সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
নিম্নমানের পণ্য সরবরাহের অভিযোগ
ডেসটিনি-২০০০ লি. যেসব পণ্য মানুষকে সরবরাহ করতো, তার বেশিরভাগই ছিল নিম্নমানের। আর দামও ছিল অস্বাভাবিক বেশি। সেইসব পণ্য কিনে ক্ষতিগ্রস্থ হয় লাখ লাখ মানুষ। ডেসটিনির কাজই ছিল ছাত্র, যুবক, গৃহিণী, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ও কলেজশিক্ষদের কাছে সেইসব মানহীন পণ্য সরবরাহ করা।
সাধারণ মানুষের টাকা কোথায় গেল?
অনেকেরই প্রশ্ন এত বিপুল পরিমাণে অর্থ কোথায় গেল? যেসব মানুষ ডেসটিনিকে টাকা দিয়েছিল,তারা কি সেই টাকা ফেরত পাবেন? গত ১০ বছরে বিভিন্নভাবে আদালত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা আদায়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের টাকা ফেরানো সম্ভব হয়নি। যার মধ্যে আছে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের (ডিএমসিএসএল) প্রায় ১৯০০ কোটি টাকা। সেই অর্থের প্রায় পুরোটাই আত্মসাত করে ফেলা হয়েছে। তাদের খপ্পরে পড়ে সব হারিয়ে পথে বসেছে লাখ লাখ পরিবার। এখন প্রশ্ন তাদের সেই টাকা কে ফেরত দেবে?