৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, আর ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখের মধ্যে পার্থক্য অনেক। চার বছর আগের এ দিনে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যে গণবিস্ফোরণের সূচনা হয়েছিল সেটা ছিল অভাবিত এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্যে প্রেরণাদায়ক।
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা সে গণজাগরণ ও ফাঁসির দাবি কেবল ঢাকার শাহবাগকেই উত্তাল করেনি, উত্তাল করেছিল সারাদেশকে, আর বাংলাদেশি বাঙালিরা যে যেখানে আছে তাদেরকে। ওই গণজাগরণ মানুষের অন্তর্গত এক শক্তি যা ঠিক সময়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল, দাবি আদায়ে নেমেছিল মাঠে; আর এর ফল নিয়েই ফিরেছে ঘরে।
সারা দেশ কাঁপানো গণজাগরণ আন্দোলন-২০১৩ শুরু হয়নি কোন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর হাত ধরে। কিন্তু এর মধ্যে ছিল এক প্রবল রাজনৈতিক চেতনা যা দেশকে ধারণ করে। অরাজনৈতিক মানুষের দেশপ্রেম, রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা দিয়ে এই আন্দোলন হুট করে রাস্তায় নেমে আসেনি। এর আগ থেকে বছরের পর বছর ধরে সাইবার বিশ্বে এ নিয়ে তুমুল আন্দোলন চলছে। অনলাইন বিশেষ করে ব্লগে এ নিয়ে অনেক আগে থেকেই লেখালেখি চলছে। অনেকেই করে চলছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা। এই লেখালেখি-গবেষণা করছে তারা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিন্তু অন্তরে ধারণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যার বীজ বপন করেছিলেন একজন জাহানারা ইমাম।
জাহানারা ইমাম নিজে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তিনি ছিলেন নির্দলীয় রাজনীতি সচেতন এক ব্যক্তিত্ব। ১৯৯২ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারি দল জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে তাদের আমীর নিয়োগ দেয় তখনই তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এক প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তুলেন। তাঁর এই আন্দোলনে যারা সহযাত্রী ছিলেন তাদের সবাই-ই ছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি গণআদালত গঠন করেন এবং এই গণআদালতের রায়ে গোলাম আযমসহ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির আদেশ দেন এবং প্রতীকী ফাঁসি দেওয়া হয় যুদ্ধাপরাধীদের। জাহানারা ইমামের এই গণআদালত এবং ফাঁসির রায় যদিও ছিল প্রতীকী এক আয়োজন তবুও এই আন্দোলন এবং রায় সাড়া পড়ে সমাজের সর্বত্র। প্রবল বিরূপ রাজনৈতিক পরিবেশ থাকায় সে আন্দোলন আর এগুতে পারেনি এবং বিচারের মুখোমুখি হয়নি যুদ্ধাপরাধীরা।
প্রজন্ম ২০১৩-র এই আন্দোলনের শুরু হয় কসাই কাদেরের রায়ের পর থেকে। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের ওরফে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনিত ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবার পরও তার শাস্তি দেওয়া হয় যাবজ্জীবন। এটা অবিশ্বাস্য এবং অকল্পনীয় ছিল দেশবাসীর কাছে। এই রায় হতাশার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়-কাদের মোল্লাকে যেখানে ‘কসাই’ নামে চিনতো একাত্তরের মিরপুর সেখানে তার শাস্তি কিভাবে হয় মাত্র যাবজ্জীবন? তাহলে কত লোককে হত্যা করলে ফাঁসির আদেশ হতে পারে? কত মা-বোনকে অসম্মান করলে শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড? নতুন প্রজন্ম মনে করেছে সুবিচার হয়নি এবং হয়ত ভিন্ন কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এগুচ্ছে কেউ রাজনৈতিকভাবে। সে থেকে শুরু! ঢাকার শাহবাগে রাস্তায় নেমে আসে কয়েকজন অনলাইন এক্টিভিস্ট ও ব্লগার। তারা হাতে হাত ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায় এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। আস্তে আস্তে এক সময়ে কয়েকজন মানুষের এই লাইন হয়ে যায় হাজার মানুষে। হাজার থেকে লক্ষ। ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র!
কসাই কাদেরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হবার পর সবাই অনুধাবন করতে পারে এ নিছক এক মস্করা হয়েছে জনমানুষের সঙ্গে, প্রতারণা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এবং সম্ভ্রম হারানো আমাদের আত্মজদের সঙ্গে। তাই আমরা যারা অনলাইন এক্টিভিস্ট-ব্লগার এবং যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মনে-প্রাণে ধারণ করি তারা বসে থাকতে পারিনি। চেতনার ডাকে আমরাও সাড়া দিয়েছি স্ব স্ব অবস্থান থেকে। এখানে আমাদের কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং পরিচয় নেই-খুব সরল-সহজ অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নতুন প্রজন্ম। সিদ্ধান্ত নিই আমাদের কিছু একটা করতেই হবে।
কাদের মোল্লার রায়ের দিন সিলেটের প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মীদের আয়োজনে আমরা সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মিলিত হই। রাজাকারের ফাঁসিতে আনন্দ মিছিল হওয়ার কথাই ছিল যেমনটা আমরা করেছিলাম বাচ্চু রাজাকার ওরফে আবুল কালাম আযাদের রায়ের দিন। কিন্তু যখন রায় ঘোষণা করা হয় তখন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই। তৎক্ষণাৎ এক প্রতিবাদ সভা হয়। বরাবরের মত কিছু বক্তা ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাদের বক্তৃতার মাধ্যমে। কেউ কেউ আবার স্বাভাবিকভাবেই খেয়াল রাখছিলেন প্রতিবাদী কোন কর্মসূচি যেন সরকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু না হয়!
বিক্ষুব্ধ, হতবিহবল এই উপস্থিতির মধ্যে অনেকেই তাৎক্ষণিক মিছিলের প্রস্তাব করেন। আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি। তবে এই আলোচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক স্বরে হচ্ছিল না। আমাদের নিজেদের অনলাইন অবস্থান, পরিচিত গণ্ডি এবং বিগত কিছু ইস্যুতে রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছিলাম। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি বিক্ষিপ্তভাবে। উপস্থিতির অনেকেই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নিজ নিজ সার্কেলের সবার সঙ্গে আলোচনা করছিল। আমাদের বিক্ষুব্ধ একটা অংশ সিনিয়রদের সঙ্গে আলোচনা করতে যাই এবং প্রস্তাব করি প্রতিবাদী বিক্ষোভ মিছিলের। সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু জায়গা থেকে ”না, না” রব ওঠে। অনেকে আবার বলে ওঠেন মিছিল করে কী হবে? আমি, দেবু, বিনয়, একুশ, নাজিম, বাতিন, অসীম একমত হয়ে যাই মিছিল করতে। বিক্ষোভ সমাবেশের শেষ বক্তা যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন দেবু অসীমকে বলে বক্তব্য শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ যেন স্লোগান ধরে। আমাদের মধ্যকার কেউ স্লোগানে পারদর্শী কেউ ছিল না। অসীম-পাপলুকে গিয়ে বলে স্লোগান ধরতে। পাপলু বিক্ষোভ সমাবেশ শেষ হবার আগেই স্লোগান ধরে। শহীদ মিনারের ভেতরে থাকাদের কয়েকজন বাদে সবাই নেমে আসে রাস্তায়। সিলেটের রাজপথ কাঁপিয়ে মিছিলটি শহীদ মিনার থেকে শুরু করে কোর্ট পয়েন্ট হয়ে আবারও শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়। প্রাথমিক বিক্ষোভ আর প্রতিবাদ পর্বের সমাপ্তি টেনে সবাই চলে যায় স্ব-স্ব ঠিকানায়!
শহীদ মিনার থেকে ফিরে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ রাতে আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করি। ফেসবুক চ্যাটে একে অন্যের সঙ্গে নিজেদের ক্ষোভের কথা জানাই। ব্যক্তিগত স্ট্যাটাসে আমাদের অনেকেই তাদের প্রতিবাদী লেখনি অব্যাহত রাখে। টিভি চ্যানেল মাধ্যমে জানা যায় শাহবাগে লোক জড়ো হচ্ছে রায়ের প্রতিবাদে। আমাদের কেউ কেউ সে রাতেই সিলেট শহীদ মিনারে অবস্থান নেওয়ার প্রস্তাব দেয় কিন্তু সে পথে রাতেই পা বাড়াই না।
ব্যক্তিগত আলাপচারিতা শেষে অনলাইনে বিস্তর আলোচনা করি। আমি, দেবাশীষ দেবু, বিনয় ভদ্র, রাজীব রাসেল, একুশ তাপাদার, আবদুল বাতিন, অসীম দাস, শুভ, পাপলু বাঙালি, ন. নাজিম, সৈয়দ রাসেল নিজেদের মধ্যে। আমাদের মধ্যকার গ্রুপ আলোচনা অব্যাহত ছিল বেশ কয়েকদিন ধরেই কারণ পাকিস্তানে ক্রিকেট দল পাঠাবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদসহ বেশ কয়েকটি কর্মসূচি আমরা নিয়েছিলাম এভাবে ফেসবুকে আলোচনার মাধ্যমেই। এই গ্রুপ আলোচনা শুধু এই কর্মসূচির জন্যে কয়েকজনকে সংযুক্ত করেছিলাম যাতে করে বিভিন্ন মহলে এই কর্মসূচিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আমাদের ক্ষুব্ধ তারুণ্যদীপ্ত মন কোনক্রমেই মেনে নিতে পারছিল না এই রায়। সিদ্ধান্ত নিই কিছু একটা করতেই হবে। সে হিসেবে সিদ্ধান্ত হলো রাস্তায় অবস্থান নেব। এমন কর্মসূচি সবাইকে জানাতে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ফেসবুকে ইভেন্ট। বিনয় ভদ্র সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকে ইভেন্ট প্রস্তুত করে ফেলেন। শুরু হলো ইনভাইট এবং একই সঙ্গে নিজেদের ক্ষোভের প্রকাশ। মানুষদের জড়ো করতে এবং ফেসবুকের বাইরের লোকদের জানাতে বিশেষ করে সিলেটের নাট্য, সংস্কৃতিকর্মী, সাহিত্যকর্মী এবং সর্বস্তরের ছাত্র-শিক্ষক-জনতাকে এই কর্মসূচি সম্পর্কে অবগত করতে। ফোনে, মোবাইল মেসেজে এ বার্তাটি পৌঁছে দিই শহীদ মিনারে আমরা প্রতিবাদী অবস্থান নেব। মুহূর্তেই সংবাদটি ছড়িয়ে যায়। সবাই যার যার অবস্থান থেকে স্ব স্ব উদ্যোগে একে অন্যকে জানাতে থাকে। আমি নিজেও একাধিক মেসেজ পেয়েছিলাম একাধিকজনের কাছ থেকেও।
রাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ি পরের সকালে আমাদের একটি টিম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) যায়। সেখানে আমরা কথা বলি অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শাবি শিক্ষক সমিতি, চোখ ফিল্ম সোসাইটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট শাবি শাখা এবং শাবির সর্বস্তরের শিক্ষক এবং ছাত্রদের সঙ্গে। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শাবির ছাত্র-শিক্ষকেরা তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচির (শাবিতে রায়ের প্রতিবাদে কর্মসূচি ছিল) পরিবর্তন করে আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। আমরা যখন শাবিতে যাই তখন সেখানে দেখি জাফর স্যারের নেতৃত্বে অগুনতি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে স্লোগান আর জাগরণের গানের মাধ্যমে। জাফর স্যারকে যখন আমাদের অবস্থান কর্মসূচির কথা জানাই তখন তিনি বলেছিলেন- তোমরা ইয়াংম্যান তোমরাই বলো কী করতে হবে। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি এবং যেভাবে বলবে সেভাবেই কাজ করবো। শাবিতে অবস্থান নেওয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আমাদের পক্ষে বক্তব্য রাখে একুশ তপাদার। আমরা শাবি পরিবারের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম ভাস্কর্য নির্মাণের স্বপক্ষে কাজ করার সুবাদে এবং তারা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছিল রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাওয়া আর পূর্ববর্তী কিছু কর্মসূচির কারণেও।
আমাদের অন্যান্য টিমগুলো এম.সি কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কলেজ, মদনমোহন কলেজ, নর্থ-ইস্ট মেডিকেল কলেজ, রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, লিডিং ইউনিভার্সিটি, ওসমানী মেডিকেল কলেজসহ সিলেটের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করতে থাকে। সবাই একাত্ম হয় যে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেওয়া রায় হতাশাজনক এবং মেনে নেবার মত না। তাই তারা সবাই নিজেদের মধ্যে সংঘটিত হয়ে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণে সাড়া দেয় এবং মিছিল সহকারে উপস্থিত হবার নিশ্চয়তাও দেয়।
আমরা সিলেটের সর্বস্তরের নাট্য এবং সংস্কৃতিকর্মী ও গ্রুপদের আমন্ত্রণ জানাই যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের ওরফে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে রাস্তায় নামতে। তারাও প্রস্তুত ছিলো। আমন্ত্রণে সবাই নিজ উদ্যোগে নেমে পড়ে প্রচার-প্রচারণায়।
ফোনে-ফেসবুকে-মেসেজের মাধ্যমে একে অন্যকে জানাতে থাকে প্রতিবাদী অবস্থানের কথা। সিদ্ধান্ত নিই আমাদের এই কর্মসূচি যেহেতু জনমানুষের কথা বলছে, মানুষের মনের দাবিকে প্রতিনিধিত্ব করছে তাই এখানে কোনও ধরণের ব্যানার যা কোনও-না কোন সংগঠনকে প্রতিনিধিত্ব করে তা থাকবে না। এই আয়োজন হবে সর্বস্তরের জনসাধারণ যেখানে আছেন ছাত্র-শিক্ষক, পেশাজীবী, সংস্কৃতি- নাট্যকর্মী এবং সাধারণ মানুষ। তাই খুব প্রথম থেকেই সচেতন থাকা যাতে করে জনসাধারণ নিজেদের প্রতিবাদটুকু জানাতে পারে অবলীলায়।
রায় ঘোষণার পরের দিন আমরা সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদী অবস্থানের আয়োজন করি। সময় নির্ধারণ করি বিকেল তিনটা। কিন্তু ঘড়িতে তিন বাজার আগেই লোকে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় পুরো শহীদ মিনার এবং তার আশপাশকার রাস্তাগুলো। মনে হচ্ছিল যেন সিলেটের সবগুলো রাস্তা এসে শেষ হচ্ছে শহীদমিনারে। এই প্রতিবাদী অবস্থান এবং প্রতিবাদের গানের সঙ্গে চলে মুহুর্মুহু স্লোগান যা কসাই কাদের ওরফে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নয়, ফাঁসির দাবিতে। সেই সঙ্গে বাকিসব যুদ্ধাপরাধী যাদের রায় এখনও আসেনি তাদের ফাঁসির দাবিতে।
সিলেটের সবগুলো সামাজিক-সাংস্কৃতিক, নাট্য সংগঠন ছাত্র-শিক্ষক-জনতা নিজেরা নেমে আসে পথে। মুহুর্মুহু স্লোগান আর প্রতিবাদী সংগীত-স্লোগানে কাঁপতে থাকে সিলেটের শহীদমিনার এলাকা। প্রতিবাদী গণসংগীতে নেতৃত্ব দেয় প্রগতিশীল নাট্য-সংগঠন নগরনাট। একই দিন এবং পরে অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠন অংশ নেয়।
সিলেটের ইতিহাসে একটানা এমন দীর্ঘদিনের আন্দোলন কখনোই হয়নি। এটা সম্ভব হয়েছে সিলেটবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতার কারণে। এটা সম্ভব হয়েছে সর্বস্তরের ছাত্র-শিক্ষক, সংস্কৃতি ও নাট্যকর্মীদের কারণেই। এই আন্দোলনে কেউ নেতা হতে আসেনি। কাউকে নেতা বানানো হয়নি বলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। তাই একটানা আন্দোলনে কেউ বিরক্ত হয়নি বরং দ্বিগুণ উৎসাহে আবারো রাস্তায় নেমে স্লোগান, গণসংগীতে মাতিয়ে রেখেছিল পরিবেশ।
গণজাগরণের চার বছর পূর্তিতে জাগরণের অংশীদাররা কেউ ব্যক্তিগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে চলে গেছে। তারুণ্যের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সে আন্দোলনে ভাটা পড়েছে ঠিক কিন্তু চেতনা রয়ে গেছে অবিনশ্বর হয়ে। এখন হয়ত কেউ আর সেভাবে মাঠে দাঁড়াচ্ছে না, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি মানুষের যে ক্ষোভ আর বিচারের দাবি সেটা রয়ে গেছে।
শীর্ষ অনেক যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে, আরও অনেকের চূড়ান্ত বিচারের পথে। গণজাগরণ আন্দোলন যে দাবিতে শুরু হয়েছে, সেটা সফল হয়েছে। সে হিসেবে আন্দোলনকারীরা প্রকৃতই ফিরেছে ঘরে। কারণ মাঠের আন্দোলন ছাড়া এদের সুপ্ত ও পাহারাদার হিসেবে টিকে থাকা দরকার। এ আন্দোলনকারীদের যেখানে নেতানেত্রী হওয়ার বাসনা নেই, কিংবা ছিল না সেক্ষেত্রে মাঠে থাকার প্রয়োজনীয়তাও নেই মোটেও। যখনই দরকার তখনই নেমে আসবে পথে এমন অবস্থায় রাখা দরকার এ শক্তিকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)