বেশকিছু দিন ধরেই চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে আছেন এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতা। কিছুটা অভিমানই যেনো লুকিয়ে রেখেছেন মনের কোণে। সম্প্রতি ভারতের ‘টেলি-সিনে অ্যাওয়ার্ড’-এ তাকে জানানো হবে আজীবন সম্মাননা, এমন ঘোষণায় সংবাদের শিরোনাম অশনি সংকেতের এই নায়িকা। অভিমান পুষেই চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। তবে কথায় কথায় আঁচ পাওয়া গেলো, এখনো বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য জিইয়ে রেখেছেন প্রচণ্ড ভালোবাসা। উপযুক্ত জায়গা পেলে এখনো ফিরতে চান চলচ্চিত্রে। অভিমান, সম্মাননা, বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্র। নিয়ে তার সাথে কথপোকথনের অংশ বিশেষ থাকলো চ্যানেল আই অনলাইন পাঠকদের জন্য:
ভারত থেকে আজীবন সম্মাননা পাচ্ছেন। এর আগেওতো ভারত থেকে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন…?
হ্যাঁ, ভারত থেকে এর আগেও আমি পুরস্কার, সম্মাননা পেয়েছি। সেটা সেই ১৯৭৩ সালের দিকের কথা। বিশ্বখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’-এর জন্য আমি পুরস্কৃত হয়েছিলাম।
দীর্ঘদিন পর সেই সত্যজিতের ভারত থেকে আজীবন সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন। অনুভূতিটা কেমন?
এবারের সম্মাননা প্রাপ্তি কিন্তু আমার একার গর্ব না। বাংলাদেশের একজন শিল্পী হয়ে আরেক দেশ থেকে আজীবন সম্মাননা বা যে পুরস্কারটি আমি পেতে যাচ্ছি এটা আমার জন্যতো বটেই, এটা বাংলাদেশের জন্যও বিরাট গর্বের। এবং আমাকে যে এতোদিন ইন্টারনেশনাল অভিনেত্রী বলা হতো সেটা যেনো এই পুরস্কারটি আরো প্রমাণ করে দিলো। (হাসতে হাসতে তিনি বললেন) ববিতা যে ইন্টারনেশনাল মানের অভিনেত্রী, এই পুরস্কারটি তার কিছুটা প্রমাণ দিলো। সেজন্য আমার খুব ভালো লাগছে। এরজন্য আমি বিশ্ব বরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ। তার ছবিতে কাজ করা, এবং আন্তর্জাতিকভাবে ববিতার নাম ছড়িয়ে যাওয়া সবকিছু মিলিয়ে সত্যি অসাধারণ অনুভূতি এই মুহূর্তে।
আজীবন সম্মাননা কবে হাতে তুলে দেয়া হবে?
এটা জুন মাসের ২ তারিখে। ১ তারিখ আমি বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাবো। ২ তারিখ হাতে নাতে পুরস্কারটি গ্রহণ করবো। ৩ তারিখে চলে আসবো।
সম্মাননা, পুরস্কারতো গেল। এবার একটু বর্তমান চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলি। এই সময়ের বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আমি আসলে সব সময় আশাবাদী। আমি একটু অভিমান করে দূরে সরে আসছি, কারণ আমরা যে সমস্ত কাজ করে আসছি এতো বছর ধরে। অভিনয় করে কী পেয়েছি না পেয়েছি এটা আমার বলা লাগবে না। আপনারাই ভালো জানেন। তো সেজন্যই আমাদের রেখে যাওয়া অবস্থা থেকে এখন যা হচ্ছে সেটা কতোটা ঠিক হচ্ছে! ভালো ছবি হচ্ছে না এমন না, কিছু ছবিতো হচ্ছেই। কিন্তু সব ধরনের ছবি ভালো হওয়া উচিত ছিলো। আরো ভালো আশা করেছিলাম। আমাদেরতো একদিন ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দিতে হবে, আমরাতো আর চিরকাল থাকবো না। আমরা যাবো, নতুনরা আসবে এটাই নিয়ম। কিন্তু চেয়েছিলাম আমাদের চেয়ে আরো ভালো ভালো ছবি হবে। কিন্তু সে জিনিষটাতো হচ্ছে না। এজন্য একটু খারাপ লাগে। তবে আমি চূড়ান্ত রকমের আশাবাদী, একদিন ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি।
কিন্তু আপনারাতো সিনিয়র। অভিমান করে দূরে সরে না থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত থাকলে কি আরো বেটার হতো না?
নিয়মিত থাকারতো সুযোগ নেই। কারণ যেনোতেনো চরিত্রে যদি অভিনয় করতে বলা হয়, তাহলে ববিতা কী তাই করবে! বা আমরা যারা সিনিয়র শিল্পীরা আছি তাদেরকে যে চরিত্রে বলবে তাই করতে পারি!? সিনিয়ররা কি যেনোতেনো চরিত্র করবেন? নিশ্চয় করা উচিত হবে না। বরং তার চাইতে আমি মনে করি, দূরে সরে থাকাই ভালো। আমরা যারা আছি, তারা যদি আমাদের মতো কাজ না পাই, সেরকম ছবি, সেরকম চরিত্র, সে রকম গল্প না পাই তাহলে কি কাজ করা সমিচিন হবে! বয়স কোনো ফেক্টর না। গল্পের নায়িকা মানেই যে শুধু নাচ গান করবে তা কিন্তু না। আপনি দেখেন, ক’দিন আগেই শ্রীদেবী করলো ‘মম’ ‘ইংলিশ ভিংলিশ’, তো এগুলোতে শ্রীদেবী কি কোনো নাচ করা নায়িকা? বা অমিতাভ বচ্চন, রেখা তারা যে এখনো নিয়মিত অভিনয় করে যাচ্ছেন তারা কি যেনোতেনো চরিত্রে অভিনয় করছেন! তো এরকম চরিত্র প্রধান গল্পতো আমাদের থাকতে হবে। না থাকলে সেটা তৈরি করতে হবে। এরকম না হলেতো আমাদের আশা করে কোনো লাভ নেই। এরকম চরিত্র তৈরি করলে আমরা অবশ্যই ছুটে আসবো। সেরকমতো হয় না, হচ্ছে না।
মানে আমরা এখনো ফর্মূলা ছবি বানানো থেকে বের হতে পারিনি?
এখনতো আমাদের এখানে নাচ গান আর মারপিটের ছবি ছাড়া কিছু দেখি না। দেখা গেলো নায়কের মায়ের চরিত্রে ছোট্ট একটা রোলে আমাকে অভিনয় করতে বলা হলো, বা আলমগীর সাহেব, ফারুক সাহেবকেও এমন চরিত্রে অভিনয় করতে বলা হলো। তো আমি বা আমরা কেনো করবো এগুলো! এমন সব চরিত্রে অভিনয় করা কি ঠিক হবে! মোটেও ঠিক হবে না। এজন্যই আমরা দূরে সরে আছি। কারণ এখনতো সব চেঞ্জ হয়েছে, সেই পরিবর্তনে যারা যা বানাচ্ছেন তাদের মতো করেই বানাচ্ছেন। সেখানে হয়তো আমাদের করণীয় কোনো চরিত্র নাই। কি আর করার! সে রকম ইম্পোর্টেন্ট চরিত্র যদি না থাকে তাহলে আমরা কি করবো। চ্যালেঞ্জিং রোল না থাকে তাহলে কাজ করার আর প্রয়োজন নেই।
যেনোতেনো চরিত্রে অভিনয় করার জন্যই আপনারা অভিনয়ে নিয়মিত নন। কিন্তু আপনাদের মনের মতো চিত্রনাট্য নিয়ে যদি কেউ আসে তাহলে কী এখন ফের অভিনয় শুরু করবেন?
অবশ্যই, অবশ্যই। কেনো নয়! আমিতো অভিনয় চালিয়েই যেতে চাই। শুধু তাই নয়, আমার কিন্তু একটা গুণ ছিলো। আজকে আমি যা অর্জন করেছি আমি সেগুলো কিন্তু ভালো ছবি করার জন্যই করতে পেরেছি। ভালো ছবি গুলোতে অভিনয় করে আমি অনেক সময় কোনো পারিশ্রমিক পর্যন্ত নেইনি। বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছি। কারণ, চলচ্চিত্রের জন্য আমার প্রচণ্ড রকম ভালোবাসা কাজ করে। আমি চাই চলচ্চিত্রে আমাদের সামাজিকতা, আমাদের দেশের কৃষ্টি কালচার উঠে আসুক। বক্তব্য ধর্মী ছবি হোক। এরকম ছবিতে কাজ করার জন্য আমি বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছি। তো আগে যখন বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছি, এই সময়ে এমন চরিত্র পেলে এখনো আমি সেই মন মানসিকতা রাখি। ভালো চরিত্র পেলে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে আমার আপত্তি নেই। তার আগে সেরকম লিখতে হবে, সেরকম চিত্রনাট্য আমার কাছে আসতে হবে। না আসলেতো আমি শুধু বললেই হবে না।
এফডিসির বাইরে থেকে যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন, তাদের ছবি প্রায় সময় প্রশংসিত হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফেস্টিভালে অংশ নিয়ে পুরস্কারও নিয়ে আসছে। তাদের নির্মাণ নিয়ে আপনার কী ভাবনা?
মেধা সম্পন্ন লোকতো সব জায়গাতেই আছে। যারা বাইরে থেকে চেষ্টা করছে, ভালো করছে এটাতো আমাদের জন্যই ভালো।
বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্র বিনিময় প্রথা, সাফটা বা যৌথ প্রযোজনা নিয়ে নানা সময়ে কথা উঠে। আন্দোলন হয়। তর্ক বিতর্ক হয়। এগুলা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
এগুলোর যা নিয়ম নীতি আছে সে নিয়ম নীতি অনুযায়িই তো চলা উচিত। সব কিছু মেনেই হওয়া উচিত। সরকার যে নিয়ম কানুন করে দিয়েছেন, হয়তো অনেকেই নিয়ম কানুন গুলো না মেনে অন্যভাবে ছবি আমদানি রপ্তানি করার চেষ্টা করছি এটা অন্যায়। এটা হতে পারে না। সবকিছু রীতিনীতি মেনেই হওয়া উচিত। চলচ্চিত্র নিয়ে জোর জবরদস্তি বা কায়দা করাতো আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্যই ক্ষতি।
ধন্যবাদ আপনাকে। আর কলকাতার ‘টেলি-সিনে অ্যাওয়ার্ড’-এ আজীবন সম্মাননা প্রাপ্তির খবরে আপনাকে অভিনন্দন…
ধন্যবাদ আপনাকে ও চ্যানেল আই অনলাইনকে। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন…
ছবি: তানভীর আশিক