কাওসার আহমেদ চৌধুরী আর নেই। মঙ্গলবার রাত ৯টা ৪০ মিনিটে প্রয়াত হন তিনি। যে নামটির সাথে মিশে রয়েছে অনেক গুণাবলী, খ্যাতি আর অনবদ্য জীবনের গল্প। তিনি একাধারে কবি, লেখক, গীতিকার, চিত্রশিল্পী, জ্যোতিষী এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন মুক্তিকামী এই মানুষটি। তাছাড়া, তিনি গোয়েন্দা হিসেবে তথ্য সংগ্রহের কাজও করতেন। পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ডেরার খবর নিয়ে আসতেন। ভালো ছবি আঁকতে পারতেন বলে সেসব জায়গার নকশা এঁকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।
কাওসার আহমেদ চৌধুরী ১৯৪৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মোশাহেদ উদ্দিন চৌধুরী, মায়ের নাম লতিফা খানম চৌধুরী। কোনো কিছু করতে কখনো কারো কাছে বাধার সম্মুখিন হননি। তাই ছোটবেলা থেকেই কেমন যেন খামখেয়ালিপনা আর বাউন্ডুলে স্বভাব পেয়ে বসেছিল তাকে। যখন যা মনে হয়েছে তা শিখেছেন, করেছেন।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কাওসার আহমেদ চৌধুরী চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি গান লেখা শুরু করেন। তিনি বেশ কিছু টিভি নাটকও রচনা করেছেন। বিটিভিতে প্রচারিত জনপ্রিয় হাসির নাটক ত্রিরত্নার চিত্রনাট্য লেখেন তিনি। সরকারি কিছু প্রকল্পের সাথেও যুক্ত ছিলেন।
পরিবার পরিকল্পনার ওপর বাংলা ও ইংরেজিতে বিভিন্ন তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তবে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে মূলত গীতিকবি হিসেবে। পাকিস্তান আমলে সিলেট বেতারে তার লেখা প্রথম গান প্রচারিত হয়। অসাধারণ অনেক গানের এ স্রষ্টা স্বাধীন বাংলাদেশের যেসব ব্যক্তি ও সংগীতশিল্পীর জন্য আধুনিক গান রচনা করেছেন তাদের মধ্যে এলআরবি, মাইলস, ফিডব্যাক, ফেরদৌসী রহমান, মাহমুদুন্নবী, নীলুফার ইয়াসমিন, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, লাকী আখন্দ, হ্যাপি আখন্দ, ফেরদৌস ওয়াহিদ, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, সামিনা চৌধুরী, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, সুবীর নন্দী, আবিদা সুলতানা, সুমনা হক, শুদ্র দেব, প্রবাল চৌধুরী অন্যতম।
তার লেখা জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া ‘যেখানে সীমান্ত তোমার সেখানে বসন্ত আমার’, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায়’, লাকী আখন্দের ‘আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না’, সামিনা চৌধুরীর কণ্ঠে ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’, ফিডব্যাকের ‘মৌসুমি কারে ভালোবাসো তুমি’, ‘কেন খুলেছো তোমার ও জানালা’, ‘এক ঝাঁক প্রজাপতি ছিলাম আমরা’, আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া ‘এই রুপালি গিটার ফেলে’, সৈয়দ আব্দুল হাদীর ‘যদি চলো, জলসাঘরে এবার যাই’, লাকী আখন্দ-হ্যাপি আখান্দ ও সহশিল্পীদের কণ্ঠে ‘স্বাধীনতা, তোমাকে নিয়ে গান তো লিখেছি’ এবং নাফিস কামালের গাওয়া ‘এই দেশে এক শহর ছিল’ (এলোমেলো)। গান লেখার পাশাপাশি চলতে থাকে ছবি আঁকাও। কবিবন্ধু নির্মলেন্দু গুণের অনুরোধে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশের রক্ত চাই’-এর প্রচ্ছদের নকশা করেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। এরপরে আরো অনেকগুলো বইয়ের প্রচ্ছদে কাজ করেন তিনি।
বহুগুণে গুণান্বিত কাওসার আহমেদ চৌধুরী মাত্র ১১ বছর বয়সে জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা শুরু করেন। তিনি সুপরিচিত একজন হস্তরেখাবিশারদ বা জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ। বই পড়ে পড়ে তিনি এ শাস্ত্র আয়ত্ব করেছেন। তাছাড়া, ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় কলকাতার জনপ্রিয় দেশ পত্রিকায় তার কবিতা প্রকাশিত হয়।
তাছাড়া ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কাওসার আহমেদ চৌধুরীর। দেশভাগের সময় বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে হয়েছিল বলে সেই ক্ষোভ আর দুঃখ কখনো ভুলতে পারেননি ঋত্বিক ঘটক। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ছিল ঋত্বিক ঘটকের অন্যরকম টান। বাংলাদেশে এলেই কাওসার আহমেদের সাথে ঘুরে বেড়াতেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ঋত্বিক ঘটকের কাছ থেকেই মূলত চিত্রনাট্য লেখার প্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি। ঋত্বিক ঘটক তার শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে একজন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য প্রস্তাব করেন গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে। কিন্তু সময়ের অভাবে ও চাকরির কারণে কাজ করা হয়ে ওঠেনি। তবে বাংলাদেশের একজন পরিচালকের বিশেষ অনুরোধে তিনি ‘নয় ছয়’ চলচ্চিত্রে বিশেষ অতিথি শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ঐক্যডটকমডটবিডি চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস্-এর ১৬তম আসরে বাংলাদেশে ৫০ জন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ এর একজন হিসেবে কিংবদন্তী গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে সম্মাননা প্রদান করে।