২২ নভেম্বর রবিবার রাত ১২:৫৫ মিনিটে দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে যুদ্ধাপরাধও সম্পৃক্ত। ফলে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারিক আদালত থেকে, আপিল বিভাগ হয়ে রিভিউ আবেদন ও সর্বশেষ পর্যায় অপরাধের স্বীকার করতঃ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পেয়েছে তারা। এবং সব পর্যায়ে ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এত দীর্ঘ ধাপ পৃথিবীর কোন আদালতের মধ্যে নেই। বিচারিক কার্যক্রমের এত লম্বা সিঁড়ি অতিক্রমের কারণ এটা স্রেফ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নয়। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের এ বিচার ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার। কিন্তু পরবর্তীকালে এর আওতা বাড়িয়ে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে অপরাধীদের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন প্রমাণের সুযোগ বেড়ে গেছে এবং একই সঙ্গে কারও প্রতি অবিচার হচ্ছে না সে নিশ্চয়তার সুযোগও তৈরি হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এ সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করার কারণে মুক্তিযুদ্ধকালীন সব ধরনের অপরাধকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। নুরেমবার্গ কিংবা রুয়ান্ডা ট্রায়ালের দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে অভিযুক্তরা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের জন্যে এত বেশি সুযোগ পায়নি, পায় না- কারণ সেখানে যুদ্ধাপরাধের মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। নুরেমাবার্গ ট্রায়াল বিশ্বের দেশে দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্যে অন্যতম এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। রুয়ান্ডা ট্রায়ালের দিকে তাকালে দেখা যায় অপরাধী যেখানে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে খুব বেশি সুযোগ পাচ্ছে না সেখানে বাংলাদেশে সব ধরনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে পুরো বিচার প্রক্রিয়াকে শতভাগ নির্ভূল ও স্বচ্ছ করার চেষ্টা হচ্ছে।
এ রকম অবস্থায় সর্বশেষ দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের শাস্তি কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ক্ষেত্রে এটা ষষ্ঠতম শাস্তি কার্যকরের উদাহরণ। এর আগে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে এবং যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম ও আবদুল আলিম শাস্তি ভোগ অবস্থায় মারা গেছেন।
আগের শাস্তি কার্যকর এবং এ সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের মধ্যে একটা পার্থক্য দৃশ্যমান। এরা দুজনই প্রথমবারের মতো নিজেদের অপরাধের স্বীকার করেছেন, যা আগে কেউ করেনি। এর বাইরে সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি একই দিন একই সময় কার্যকর হয়েছে। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের শাস্তি কার্যকরের হিসেবে নতুন এক উদাহরণ হলেও বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে নজিরবিহীন কোন ঘটনা নয়। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড একই সময়ে একই দিনে কার্যকর করা হয়েছিল।
যদি ভুল না করি তাহলে বলতে পারি সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর পরিবার যতখানি মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছে নিকট অতীতে কেউ এতখানি পায়নি। তাদের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য, বসে থাকার দৃশ্যসহ বিভিন্ন দৃশ্য বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে যেভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে তাতে করে তাদের আসল পরিচয় সম্পর্কে যে কেউই ভুল বুঝতে পারে, অথবা ভুল বুঝে কেউ প্রশ্নও করতে পারে এটা কোন দেশের মিডিয়া? তারা কি বিচারিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচার প্রচারের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করতে চায়?
এত আদিখ্যেতা কিংবা বালখিল্যমূলক অতি প্রচার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি) বাড়ানোর একটা উপলক্ষ্ হতে পারে। এটা নেহায়েত এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা হিসেবে জ্ঞান করছি। কারণ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো খুব সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছানোর কারণে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করলে কি চলে? যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি কার্যকরের আগ মুহুর্ত থেকে টেলিভিশন চ্যানেলে সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। মানুষের আগ্রহ ছিল খুব।
একাত্তর থেকে দুই হাজার পনেরো- মাঝখানে কেটে গেছে চুয়াল্লিশ বছর। এই চুয়াল্লিশ বছরের বেশিরভাগ সময় এই দেশের মানুষ প্রচার আর অপপ্রচারের মধ্যকার ব্যবধান ভুলে অপপ্রচার ও মিথ্যা প্রচারণাকে সত্য ভেবে বসে আছে। এখনও অগণন মানুষ ভাবে বাংলাদেশ না, পাকিস্তান থাকলেই হয়ত ভাল হতো। এ মানুষগুলো পাকিস্তানের হিংসা, সন্ত্রাসকে আমলে না নিয়ে ধর্মভিত্তিক অদ্ভূত এক আকর্ষণে এখনও আসক্ত। এর কারণ হতে পারে দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানপ্রেমে আসক্ত কিছু রাজনৈতিক দলের জনগণের সঙ্গে মিশে যাওয়া, অথবা একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহযোগিতা করেছিল বলে ভারতের প্রতি বিদ্বেষ পাকিস্তানপ্রেমের নিয়ামক শক্তি। তাছাড়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, অতি ধর্মাসক্তির নামে মুসলমান-মুসলমান ভাই শিক্ষাপ্রবণতা।
এ পরিস্থিতিতে কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী, মুজাহিদ যখন ‘ইসলামী আন্দোলনের নেতা’ তখন অনেক মানুষের কাছে তাদের একাত্তরের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের মত কোন অপরাধ ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। তারা এতখানি আচ্ছন্ন যে সত্য-মিথ্যার ভেদ ভুলে যেতেও রাজি যখন ধর্ষণের মাঝেও থাকে ধর্মের প্রলেপ। এদের কাছে একাত্তর সে তো চুয়াল্লিশ বছর আগের ইতিহাস!
এমন অবস্থায় যখন দেশ তখন যুদ্ধাপরাধী পরিবারের মিথ্যা বক্তব্যগুলো খুব সহজেই মানুষের কাছে যাচ্ছে, বিভ্রান্ত হচ্ছে, প্রভাবিত হচ্ছে। তাছাড়া এ বিচার প্রক্রিয়ার প্রথম থেকেই জামায়াত-বিএনপি এর বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে ছিল এবং তারা দলীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করে পাকিস্তানের হয়ে সারাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল। তারা স্বাভাবিকভাবে এসব অতি প্রচারের কারণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপি একাত্তরে ছিল না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পাকিস্তানপন্থী অধিকাংশ মানুষেরই সমাবেশ ঘটেছে দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই, যে ধারা এখনও বহমান।
একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর রায় পুনঃবিবেচনার আবেদনের (রিভিউ) সময়ে সাকা চৌধুরীর আইনজীবী নজিরবিহীনভাবে পাঁচ পাকিস্তানি সাক্ষী সহ আট সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার আবেদন করেছিলেন। মামলার সে পর্যায়ে গিয়ে এ ধরনের আবেদন নজিরবিহীন এবং আইন সমর্থন করে না। এটা জেনেশুনেই তারা করেছেন। তারাও জানেন আদালত এটাকে বিবেচনায় নেবেন না, তবু করেছেন কারণ এর মাধ্যমে আদালতের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণার জন্ম দেওয়ার একটা উপলক্ষ্ তৈরি হবে।
সাধারণ মানুষজন কিংবা বিভ্রান্ত প্রজন্ম এতকিছু বুঝার ক্ষমতা রাখে না। তারা আইন, রীতি, আদালতের নজির এসব না দেখে কেবল দেখেছে আদালত সাফাই সাক্ষীর আবেদন গ্রহণ করেননি। ফলে যুদ্ধাপরাধী এ পরিবার ও তাদের দলের অপপ্রচারের আরও বেশি জ্বালানি যুগিয়েছে। আমাদের মিডিয়া জোর দিয়ে প্রচার করেনি আদালতের রীতি, আইনের বিষয়টি। তাদের প্রচারের বিষয়টি ছিল সিদ্ধান্ত, এবং একে খুব সহজেই লুফে নিয়েছে অপপ্রচারকারীরা।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের মিডিয়াকে যেখানে আরও বেশি সচেতনতা দেখানোর কথা ছিল সেখানে খুব সহজেই অপপ্রচারকারীদের হাতিয়ার হয়ে গেছে। এটা সচেতনভাবে হয়নি বলে বিশ্বাস করতে চাই, কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মিডিয়াগুলো বাংলাদেশে শক্তিশালি বলেই ধারণা করি।
যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের পরিবারকে অতি হাইলাইট করার বাইরে এবারই প্রথম অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেলে সাকা-মুজাহিদকে যুদ্ধাপরাধী বলেই সম্বোধন করা হয়েছে। আগের দুই দণ্ড কার্যকরের সময় থেকে এটা একটা বিশাল উন্নয়ন কিংবা উত্তরণ বলেই মনে হয়। কারণ কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের আগে-পরে মিডিয়াগুলো তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কেই হাইলাইট করেছে, যেখানে যুদ্ধাপরাধী শব্দটা জোর দিয়ে উচ্চারণ করা হয়নি। এবারই প্রথম মিডিয়ার চোখে তাদের প্রথম পরিচয় ছিল যুদ্ধাপরাধী। এটাকে এত নেতিবাচক খবর ও কার্যকলাপের ভিড়ে ইতিবাচক বিষয় হিসেবেই দেখতে চাই।
যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের আগে-পরে বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোর বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোর অস্থিরতা ছিল লক্ষণীয়। অনেকগুলো টিভি চ্যানেল দেখে আসলে বোঝার উপায় ছিল না সত্যি তারা কাকে এবং কী বক্তব্য উপস্থাপন করতে চাইছে? যুদ্ধাপরাধী পরিবারের পেছনে যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল তাতে করে যে কেউ ভুল বুঝে ভাবতে পারে “জাতীয় বীর”-দের উপস্থাপন চলছে। অথচ উদ্দিষ্ট করে অনবরত কাভারেজ দেওয়া হয়েছিল তারা সেই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের স্ত্রী-সন্তান যাদের স্বামী-পিতার হাতে রক্তাক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। অথচ তারাই পেয়েছে সর্বোচ্চ কাভারেজ।
যুদ্ধাপরাধী সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি সময়ে যুদ্ধাপরাধী পরিবারগুলোকে আমাদের মিডিয়া যতখানি কাভারেজ দিয়েছে তার সিকিভাগও দেওয়া হয়নি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবার, এসব মামলার সাক্ষীদের এবং এ দুই যুদ্ধাপরাধীদের কৃত অপরাধের বর্ণনায়। মিডিয়া হয়ত ভেবেছে এখানে মানুষজনের আকর্ষণের কিছু থাকবে না। টিআরপি দৃষ্টিতে দেখলে হয়ত নাই, কিন্তু তাই বলে কি এভাবে এত অবহেলায় দেখা হবে বিষয়টি?
যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের রায় কার্যকরের আগ মুহুর্ত থেকে এ দুই পরিবার প্রাণভিক্ষা ইস্যুতে অনেক জল ঘোলা করেছে। তারা দাবি করেছে সাকা-মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা চাননি। আবার একই সময়ে তারা আলাদা সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। মুজাহিদের স্ত্রী-পুত্র সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রপতিকে ‘অভিভাবক’ আখ্যা দিয়ে ফাঁসি স্থগিত করার আবেদন জানিয়েছিল। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হিসেবে মুজাহিদের কিছু বলার আছে বলে দাবি করে তারা বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। যার জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, এক মামলার শাস্তি কার্যকর হয়ে গেলে অন্য মামলা আর চলে না।
একইভাবে সাকা চৌধুরী পরিবার রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করে অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি সাকাপুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী বঙ্গভবন পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিল। আইনত রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষা আবেদনের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে এধরনের অনুরোধ গ্রহণের সুযোগ ছিল না বলে হুম্মাম কাদের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেনি। সাকা-মুজাহিদ আইনগতভাবে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার পর তাদের পরিবারের এ ব্যক্তিগত দৌড়ঝাঁপ ছিল, তবু তারা অস্বীকার করে বলে সাকা-মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা চাননি। অবাক করা ব্যাপার হলো, তাদের এ মিথ্যাচারগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচার হয়েছে মিডিয়াগুলোতে। কিন্তু তাদের সে দৌড়ঝাঁপের বিষয়গুলো বিশ্লেষণি দৃষ্টিতে প্রকাশ কিংবা প্রচার হয়নি। ফলে মিথ্যাচার করেও তারা মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের বক্তব্যগুলো মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। এতে অনেকেই যে বিভ্রান্ত হবে না- সে কথা কেউ বলতে পারে না।
মানবতাবিরোধী এ ধরনের অপরাধের সব পর্যায়ের নিষ্পত্তির পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা অপরাধীরা চাইতে পারে, আবার নাও চাইতে পারে। সাকা-মুজাহিদ সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে এ সুযোগ নিয়েছিলেন। প্রাণভিক্ষার আবেদনের পর রাষ্ট্রপতির সীমাবদ্ধতাকে ইঙ্গিত করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ পরিস্কার করেই বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রপতির নাই। সে হিসেবে সাকা-মুজাহিদের প্রাণভিক্ষার আবেদন এবং এটা নিয়ে তাদের পরিবারের অস্বীকার, আবার ব্যক্তিগত যোগাযোগ প্রচেষ্টা সবই করা হয়েছে আদতে এ বিচারকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা হিসেবেই। দুই যুদ্ধাপরাধী পরিবার এ সুযোগ নিয়েছে, এবং আমাদের মিডিয়াগুলো নিজের অলক্ষ্যেই এ প্রচারণায় পা দিয়েছে। হতে পারে কেউ সজ্ঞানে, আর কেউ কেউ অজ্ঞানে!
প্রাণভিক্ষার আবেদন বা মার্সি পিটিশন নিয়ে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ পরিবার যে নাটকের জন্ম দিয়েছে তাতে মিডিয়া উল্লেখযোগ্য রকমের রসদ যুগিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তাদের অতি প্রচারের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেছেন এটা দেখাতে হলে রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগবে।
এখানে বুঝি না কেন এটা দেখাতে হবে? এরকম বিষয়কে রাষ্ট্রের অতি গোপনীয় বিষয় হিসেবেই মনে হয়। কিছু ব্যাপারে যদি গোপনীয়তা না থাকে তাহলে কীভাবে হয়? বালকসুলভ এ ধরনের আবদারকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রের অতি গোপনীয় যা কিছু তা প্রকাশ করা হলে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। পরবর্তীকালের জন্যে এটা নজির হিসেবে উপস্থাপন হতেই থাকবে। ফলে ভবিষ্যতে যে কোন ধরনের মার্সি পিটিশন কিংবা এ জাতীয় সব কিছু প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রাষ্ট্রের ওপর বর্তাবে।
এ প্রসঙ্গে একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, সাকা চৌধুরীর এ মামলার সব পর্যায়েই এ পরিবারটি বিচারিক প্রক্রিয়া, ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট সব কিছুকে বিতর্কিত করতে সব ধরনের অপচেষ্টা চালিয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট সব জায়গায় ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে আদালতকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে। রিভিউ শুনানির সময়ে জাল সার্টিফিকেট দাখিল, পাকিস্তানি সাফাই সাক্ষী- কী করেনি তারা? এরপর দেশে-বিদেশে অপপ্রচার তো আছেই। এসব আমরা কীভাবে ভুলে যাই, রাষ্ট্র-সরকার এসব কেন ভুলবে, কিংবা বিভ্রান্ত হবে?
এ পরিবার বিশ্বাস করে না সাকা চৌধুরী মার্সি চেয়েছে। তারা এখন মার্সি পিটিশন দেখতে চায়। তারা অবিশ্বাস থেকে বলছে দৃশ্যমান হলেও এটা আদতে তারা প্রচার করছে বিচারিক প্রক্রিয়াকে বিভ্রান্ত করতে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যখন জানি এসব তাদের ইচ্ছাকৃত, তাহলে আমরা কেন বিভ্রান্ত হবো? মিডিয়া কেন তাদেরকে গুরত্ব দেবে?
দেশবাসী জানে, সাকা-মুজাহিদ পরিবার বিশ্বাস করে না এ দুজন যুদ্ধাপরাধী ছিল। সাকা-মুজাহিদ পরিবার বিশ্বাস করে না এরা একাত্তরে গণহত্যা চালিয়েছিল। সাকা-মুজাহিদ পরিবার বিশ্বাস করে না তারা একাত্তরে লুণ্ঠন করেছিল। সাকা-মুজাহিদ পরিবার বিশ্বাস করে না এ দুই যুদ্ধাপরাধী একাত্তরের কৃত অপরাধের জন্যে ক্ষমা চেয়েছিল। যদি তারা স্বীকার করত মানবতাবিরোধী অপরাধে সাকা চৌধুরী-মুজাহিদের সম্পৃক্ততা তাহলে প্রশ্ন আসত পরের অধ্যায়ের। যখন আমরা সন্দেহাতীতভাবে জানি এবং বিচারিক পর্যায়ের সব ধাপে তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে তখন কীভাবে তাদের বিশ্বাস করি, কীভাবে সন্দেহমুক্ত হবো তাদের কথার সত্যতা বিষয়ে।
যখন মিডিয়াও জানে তাদের মিথ্যাচারের ইতিবৃত্ত তখন কেন তাহলে কথাগুলোকে এভাবে প্রচার করবে? মিডিয়া যদি হয় স্রেফ ব্যবসা তবে হয়ত এটাও ব্যবসায়িক এক উপকরণ। তবে ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে যদি সামাজিক দায়বদ্ধতা আর রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য থাকে তাহলে যুদ্ধাপরাধী পরিবারগুলোর প্রতি এমন উদার, উতলা হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)