রমজান মাস শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে, আমি পঁয়ষট্টি ডলারের একটি বড় খেজুরের বাক্স অর্ডার করি। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, “সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এগুলো শতভাগ প্রাকৃতিক” আর “সবচেয়ে ভালো মানসম্পন্ন।” আমি মনে মনে ভাবলাম, “এতো দামে যখন নিচ্ছি তখন সেটা অবশ্যই প্রাকৃতিক হতে হবে।” আমার তালিকা থেকে আরেকটি জিনিসে টিক দিলাম।
এই রমজান মাসে আরো যে সব খাবার-দাবার আমি কিনেছি তার মধ্যে রয়েছে হালাল মুরগী, অ্যামিশ নামে পরিচিত রক্ষণশীল খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায় যেগুলো লালন-পালন করে থাকে এবং যা মুসলমানদের দ্বারা জবাই করা থাকে, শুকনো আপ্রিকট, মিষ্টি তৈরির জন্য ফিলো ডো এবং আরো হাজার হাজার জিনিসপত্র। কারণ পবিত্র এই রোজার মাসে যে কোন মুসলমান পরিবারে যারা রান্নার কাজে নিবেদিত থাকেন তাদের অনেক খাবার মজুদ করে রাখতে হয়।
যখন আপনি সারাদিনে একবেলা ভালো করে খাবেন, তখন তা খুব ভালোমত খাওয়া উচিত। রমজান আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও আত্ম-সংযমের মাস হতে পারে, তবে রাতের বেলা সবার সাথে ভোজের সময়ে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের যে কোন জায়গায় রমজান মাস পালনের একটি প্রথা হচ্ছে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে মৌসুমি খাবারগুলো উপভোগ করা।
সিয়াটলে আমাদের স্থানীয় গোষ্ঠী খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ, আর তাই আমরা সবাই যখন একত্রিত হই তখন সেটা হয়ে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির একটা মিলনমেলা। তিউনিশিয়ান বন্ধুরা নিয়ে আসে ফ্লাস্ক ভর্তি গ্রিন টি, মিশরীয় বন্ধুরা আনে ডেজার্টের জন্য পেস্ট্রি, আর সাথে থাকে আমেরিকান বন্ধুদের বাড়ি থেকে আসা রান্না করা মুরগী ভাজা ও বিস্কুট। আইফোন থেকে যখন আযানের ধ্বনি ভেসে আসে (যার জন্য একটি অ্যাপ আছে), তখন সেই চমৎকার সুন্দর মুহূর্তে বিশেষ কিছু ঘটে আর সবাই মিলে খেতে শুরু করে ভালোবেসে তৈরি করে আনা দারুণ সব ঐতিহ্যবাহী খাবার ।
হ্যাঁ, রমজান মাস আধ্যাত্মিক চেতনার সময়, এমন একটা মাস যখন সারা বিশ্বের মুসলমানরা রোজা, কুরআন তেলাওয়াত এবং দানের মাধ্যমে নিজেদের ধর্ম চর্চা আরো দৃঢ় করে। আর যখনই কেউ এক মুহূর্তের জন্য খাবারের চিন্তা করে তখনই কেউ না কেউ বলে ওঠে, “রোজা রাখার সময় খাবারের কথা ভাবা ঠিক নয়।” ঠিক আছে! কিন্তু সূর্যাস্তের সময় আপনি যে বিরিয়ানী খাচ্ছেন তা কে রান্না করেছে? এটাতো নিজে নিজে রান্না হয়নি।
আমার জন্য, বিকালের এই খাবার তৈরি করা একধরনের ইবাদাত –- এক ধরনের প্রার্থনা এবং সৃষ্টিকর্তাকে সন্ধানের চেষ্টা করা। যে খাবারটি আপনি আগে শতবার রান্না করেছেন সেটাও এই সময় রান্না করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে কারণ রান্না করার সময় আপনি এর কোনো স্বাদ নিতে পারবেন না এবং কোনো গড়বড় হলে উপকরণের পরিমাণ ঠিকঠাক করে দিতে পারবেন না। লবণ কি বেশি হয়ে গেছে? রসুনের পরিমাণ কি কম হয়ে গেল? সূর্যাস্তের আগে আপনি তা জানতে পারবেন না। যখন আপনি আর আপনার অতিথিরা খাবার খাবেন তখনই বুঝতে পারবেন আপনার ধারণা ঠিকভাবে কাজ করেছে কিনা।
রোজা রেখে রান্না করা এক অনন্য অভিজ্ঞতা, খুবই অসুবিধা কারণ আপনি খাবারের ঘ্রাণ পাচ্ছেন কিন্তু খেতে পারছেন না। শুরু থেকেই আমি আবিষ্কার করি যে রান্না করার সময় একবারও কোন কিছু খাওয়ার জন্য আমি প্রলুব্ধ হই না। যা ঘটে তা হচ্ছে ইফতারের জন্য খাবার রান্না করা আমার সংযম সাধনাকে আরো অর্থবহ করে তোলে। ঈশ্বর এবং যারা আমার রান্না করা খাবার খেয়ে রোজা ভাঙবে তাদের প্রতি আমার সেবাকেই আরো উৎকৃষ্টরূপে তুলে ধরে।
যাদেরকে আপনি ভালোবাসেন তাদের সাথে ভালো ভালো খাবার খাওয়া ধর্মীয় চর্চার একটি অপরিহার্য বিষয় যা বয়ে আনে আনন্দ অথচ যা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। সারা দিনের কঠিন সংযমের পর একই টেবিলে (অথবা প্রথাগত পরিবারগুলোতে মেঝেতে) বসে আপনার প্রিয় বন্ধুদের সাথে খাবার উপভোগ করতে পারলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষই আছে যারা এতটা সৌভাগ্যবান নয়।
রমজান মাসের আরেকটি দিক হচ্ছে নিজেকে মনে করিয়ে দেয়া যে আপনি কতটা ভাগ্যবান এবং সেইসব মানুষের জন্য কোন কিছু করার উদ্যোগ নেয়া যাদের কম আছে। যদিও সন্ধ্যাবেলায় আমরা আমাদের ইফতার করি কিন্তু আমাদের প্রার্থনা ও দান যেন ঘিরে থাকে সেইসব মানুষের উদ্দেশ্যে যাদের সূর্যাস্ত হয় যুদ্ধে, দুর্ভিক্ষে এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। আমরা আমাদের গৃহ ও খাবার টেবিল যেমন উন্মুক্ত করে দেই বন্ধুদের জন্য তেমনি আমাদের হৃদয়ও উন্মুক্ত করে দিই আপনাদের জন্য।
(ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী জি উইলো উইলসন একজন লেখক। তার “দি বাটারফ্লাই মস্ক” আইজেন পুরস্কারের জন্য মনোনীত।)