ক্যাথেরিন ল হয়তো কিছু্ই জানতে পারতো না যদি তার সন্তান তাকে সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার পর না বলতো, রাতে ঘুমের মধ্যে যেন সে শ্বাস নেওয়ার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে উঠছিলো বারবার। রাতে ঠিক কী ঘটেছিলো সেটা টের না পেলেও, এর পেছনের কারণটা কি সেটা ঠিকই বুঝতে পারছিলো ক্যাথেরিন। কেননা এর আগে এক ভাইকে এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে দেখেছেন সে।
এরপর দেরি না করে পরীক্ষা কেন্দ্রে যান ওই কানাডিয়ান নারী। ‘সারাদিন আপনি প্রচন্ড কষ্ট করলেন। দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে যেই না ঘুমুতে গেলেন তখন যদি আপনার শরীর বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যায় তাহলে শরীর বিশ্রাম নেবে কি করে বলুন? আর পর্যাপ্ত ঘুমই বা হবে কি করে?’ এমনটাই বলেন ৬৭ বছরের ক্যাথেরিন। সেদিন স্লিপ অ্যাপনোয়েয়ার শিকার হয়েছিলেন তিনি।
মূলত কি কারণে স্লিপ অ্যাপনোয়েয়া হয় সেটার ব্যাখ্যা দেন ড. এফ জেভিয়ার পুয়ের্তাস। তিনি আলজিরার লা রিবেরা ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের স্লিপ মেডিসিন সেন্টারের প্রধান। জানান,‘যাদের স্লিপ অ্যাপনোয়েয়া আছে তাদের উপরের শ্বাসনালীটা খুবই সরু অথবা সেটা পুরোটাই জমাটবাঁধা। তাই ঘুমানোর সময় শরীরে প্রয়োজনীয় বাতাস ঢুকতে পারে না। ফলে প্রথমে হয়তো খানিকটা নাক ডাকার মতো সমস্যা দেখা দেয় তারপর একসময় আক্রান্ত ব্যক্তি হা করে শ্বাস নেওয়া শুরু করে। শেষ পর্যায়ে গিয়ে তার ঘুম ভেঙে যায় ভালো করে শ্বাস নেওয়ার জন্য।’
সমস্যাটি কিন্তু মোটেও ছোট নয়, কারণ ডাক্তার আরো জানান, ‘কখনো কখনো ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরিমাণ সারারাতে ১০০ বারও হয়। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার কি জানেন? আক্রান্ত কখনোই বুঝতে পারে না যে তার এতবার ঘুম ভেঙে গেছে। কারণ পুরো ঘটনাটির স্থায়িত্ব হয় মাত্র তিন থেকে পাঁচ সেকেন্ড। লক্ষণ বলতে পরদিন ঘুম থেকে উঠেও তিনি ঘুম ঘুম এমনকি সারাদিনই ঘুম ঘুম এবং ক্লান্ত বোধ করতে পারেন।’
তাহলে কি নাক ডাকাটাই স্লিপ অ্যাপনোয়েয়া? জবাব মিললো পুয়ের্তাসের কাছেই, ‘সব নাক ডাকাকেই স্লিপ অ্যাপনোয়েয়া বলা ঠিক হবে না। তবে খুব জোড়ে জোড়ে নাক ডাকলে এবং শ্বাস বাধাগ্রস্থ হলে এই সমস্যার কারণেই হতে পারে। এছাড়া এই রোগের আরো কিছু লক্ষণ থাকে যেমন, দিনের বেলা প্রচন্ড ঘুম পাওয়া, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মাথাব্যথা, উচ্চরক্তচাপ বা অন্যরা যখন টের পায় যে আপনি ঘুমের মধ্যে শ্বাস নিতে পারছেন না।’
মাত্র ১০ বছরে এই সমস্যা চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। আগে মাত্র ৪ শতাংশ পুরুষ এবং ২ শতাংশ নারীরা এই সমস্যার মুখোমুখি হতো কিন্তু এখন সমস্যাটা আরো বাড়ছে। এর কারণগুলোও বেড়ে চলেছে। অনেক মানুষেই স্থুলতা নিয়ে ভোগেন। সেটা স্লিপ অ্যাপনোয়েয়ার একটি বড় কারণ।
কেবল যে ঘুমের সময় এই সমস্যাটা আপনাকে ভোগায় তা নয় কিন্তু মোটেও। শরীরে গ্লুকোজের মাত্রার সাথেও এর সম্পর্ক আছে যার কারণে হতে পারে ডায়াবেটিস। রক্তচাপ বাড়তে পারে এর কারণে, ফলে হতে পারে হৃদযন্ত্রের সমস্যা। এমনকি সারারাত না ঘুমানোর ফলে ক্লান্ত শরীরতো বটেই এমনকি আরো নানা দূর্ঘটনাই ঘটতে পারে সারাদিনে। তাই অবহেলা করা চলবে না মোটেও।
এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন কিনা সেটা জানতে সারারাত আক্রান্তকে ল্যাবে থাকতে হয়। অনেকেই এটাকে খুব অদ্ভূত একটা পরিবেশ হিসেবে বিবেচনা করে। অনেক রোগীই বলেন, আমি মনে করেছিলাম খুব কঠিন সময়ের ভিতর দিয়ে যাবো কিন্তু আসলে ল্যাবে গিয়েই আমি খুব ঘুম ঘুম অনুভব করছিলাম।
তবে এখন এই সমস্যার সমাধান নিয়ে এসেছেন বিজ্ঞানীরা। সমাধানটার নাম সিপাপ। কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার। ছোট্ট জিনিস কিন্তু বেশ কার্যকর। পুরো সিস্টেমটার মধ্যে একটা ছোট্ট এয়ার পাম্প থাকে, টিউব থাকে আর একটি মাস্ক থাকে যেটা কিনা নাকটিকে ঢেকে রাখে। এতে করে উপরের শ্বাসনালীতে সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে। ওই মাস্কটা কেবল নাকে লাগিয়ে ঘুমালেই মিলবে সমস্যার সমাধান।
ছোট্ট একটা জিনিস যদি আপনাকে এতটা শান্তি দিতে পারেন তাহলে আপনার জন্য পুয়ের্তাসের বক্তব্য, ‘সিপাপকে একটা চশমা হিসেবে দেখুন। আপনি ঘুম থেকে উঠেই যেমন চশমার জন্য হাত বাড়ান তাহলে কেন নয় ঘুমাতে যাওয়ার আগেই হাত বাড়িয়ে সিপাপ নিন। অনেকে হয়তো এটা দেখে বলবেন ‘আমি কিছুতেই এই সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘুমাতে পারবো না।’ কিন্তু কয়েকদিন ব্যবহার করলে কি চশমায় আমরা অভ্যস্থ হয়ে যায়না? নিজের সুবিধার জন্য এটুকুতো নিশ্চয়ই করতে পারবেন।