চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘যদি কোনো পক্ষকেই আঘাত না করে, তাহলে আমার লেখার দরকার কী!’

মোজাফ্ফর হোসেন এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পকার। ‘অতীত একটা ভিনদেশ’ গল্পগ্রন্থের জন্য এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্য পুরস্কার এবং ‘স্বাধীন দেশের পরাধীন মানুষেরা’ গল্পগ্রন্থের জন্য আবুল হাসান সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ছোটগল্প নিয়ে তার ‘পাঠে বিশ্লেষণে বিশ্বগল্প’ বইটি বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০’এ প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম উপন্যাস ‘তিমিরযাত্রা’। নিজের উপন্যাস ও লেখালেখির অন্যান্য বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন এই আলাপচারিতায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিলু হাসান।

আপনি তো অনুবাদ করেন। অনুবাদ আপনার মৌলিক লেখায় সাহায্য করে?
করে নিশ্চয়। অন্যভাষার একজন লেখককে ভালোমতো বুঝতে সাহায্য করে। যেমন হেমিংওয়ের ভাষার সংক্ষিপ্তকরণ, জয়েসের ভাষার অন্তর্গত ক্ষমতা, ফকনারের ভাষার আঞ্চলিক বিস্তার— এগুলো অনুবাদের সময় গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। আমি মনে করি সাহিত্যের ইতিহাস শেষপর্যন্ত ভাষার ইতিহাস। নিজে মৌলিক লেখার ক্ষেত্রে সেটা মাথায় রাখি। ফলে আমি খুব নিয়মিত অনুবাদক না হলেও ভালোলাগা থেকে এবং আমার ভাষার চর্চা থেকে কাজটি করতে ভালোবাসি। অনুবাদ নিয়ে যদিও আমার বড় কোনো পরিকল্পনা নেই।

আপনি সরকারি চাকুরি করেন। পেশাগত বিষয় কি লেখালেখিতে আপনাকে বাধাগ্রস্ত করে?
সরকারি চাকরি না, লেখকের জন্য যেকোনো চাকরিই এক ধরনের বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। কোনো প্রতিষ্ঠান চায় না তার কর্মকর্তার ইমেজ রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়ুক। প্রকৃত লেখক ইমেজ রক্ষা করে লেখালেখি করেন না। সবসময় তাকে ঝুঁকি নিতে হয়। লেখককে মনে করা হয় সমাজের গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন। কিন্তু আমি মনে করি লেখক দিন শেষে কারো মুখপাত্র নন, সত্য-মিথ্যা কোনোকিছুর না, এমনকী লেখক সবসময় নিজেরও মুখপাত্র নন। আমি লেখার টেবিলে কোনো সময় মাথায় রাখতে চাই না কী ধরনের চাকরি করি। অধিকাংশ গল্প যেহেতু এলিগরিক্যাল, মোটামুটিভাবে অনেক কথা বলে ফেলতে পারি। বাস্তববাদী সাহিত্যে অনেককিছু বলা যায় না। কিন্তু জাদুবাস্তব বা পরাবাস্তব আবহ সৃষ্টি করে অনেক কথা বলে ফেলা যায়। আমার গল্পের চরিত্র যখন মৃত বা পুরো সেটিং অস্বাভাবিক, তখন আমাকে কেউ চাইলেও ধরতে পারবে না। আমি মনে করি, সরকার বা ক্ষমতার চেয়ে বড় বাধা আমাদের সমাজ। আমাদের পাঠক। যে পাঠকের জন্য লিখি, সেই পাঠক অনেককিছু গ্রহণ করার জন্য তৈরি না। তৈরি না বলেই যেন লেখার প্রয়োজন আরও বেশি।

একটা লেখা আপনার মাথায় কীভাবে আসে? কোন সময়টাতে লেখেন?
নানাভাবে আসতে পারে। খুব মোটাদাগে বলা চলে, আমি ঘটনা মাথায় নিয়ে লিখতে বসি না। প্রথমে আমার কাছে ভাষা আসে, পরে ঘটনা। মাথায় অনেক ঘটনা থাকে, কিন্তু ভাষা নির্ধারণ করে কখন কোন ঘটনা আমার গল্পের বিষয় হয়ে উঠবে। অনেক সময় ভাষা তাৎক্ষণিকভাবে গল্প নির্মাণ করে নেয়। অর্থাৎ, যে গল্প আমার ভেতরে আগে থেকে তৈরি ছিল না, সেটা লিখতে বসে চলে আসে। আর লেখার জন্য আমার কাছে রাত সবসময় প্রিয়।

আমাদের এখানে সমালোচনা সাহিত্য উন্নত করতে আমরা কী করতে পারি?
সাহিত্যের একাডেমিক ও তাত্ত্বিক পাঠ প্রয়োজন। সমালোচনা বা সাহিত্যতত্ত্ব মৌলিক সৃষ্টির কোনো উৎকর্ষ এনে দেয় না, এই বিশ্বাস থেকে আমরা সাহিত্যের ক্ষতিই করে চলেছি। সাহিত্যের সঙ্গে কেবল লেখক জড়িত নন, জড়িত পাঠকও। ফলে সাহিত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়লে ভালো সাহিত্য কী সেটা পাঠক এবং লেখক বুঝতে পারবেন। শিল্পসাহিত্যে রসাস্বাদনে শিল্পবোধের প্রয়োজন আছে। শিল্পরসিক মানুষ তৈরি করতে হলে শিল্প সমালোচনার উন্নয়ন জরুরি।

এবারের বইমেলায় আপনার কি কি বই প্রকাশিত হয়েছে?
‘তিমিরযাত্রা’, আমার লেখা প্রথম উপন্যাস। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। একই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য’ বইটি। আর ‘অতীত একটা ভিনদেশ’ গল্পগ্রন্থের পাঞ্জেরী সংস্করণ।

আপনার নতুন উপন্যাস কোন জনরাতে পড়বে?
লেখক হিসেবে আমি কোনোকিছু বেঁধে দিতে চাই না। একজন পাঠকের দিক থেকে বলতে পারি, উপন্যাসটি বাংলাদেশের ডেসটোপিয়ান ধারার। এখানে পাঠক কোনো আশার আলো পাবেন না। শুরু হয়েছে ব্লগার হত্যার সময়, এরপর গল্প না এগিয়ে পিছিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। এটা একটা পশ্চাৎমুখী পরিভ্রমণ, ভ্রমণটা সুখকর না। বিকৃত যৌনতা, বিকৃত ধর্মাচার, বিকৃত রাজনীতি, সবকিছু পাঠককে ডিস্টার্ব করতে পারে। অস্বস্তিতে ফেলতে পারে।

উপন্যাসটির জন্য কতদিন সময় নিয়েছেন? বা কীরকম প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
লিখেছি, সম্পাদনা করেছি, মোটের উপর এক বছরে। উপন্যাসটা আসলে আমার জীবনেরই অভিজ্ঞতা, আমাদের সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা বলা চলে। কিন্তু আমি গল্পটা বলেছি কতগুলো বিস্মৃত মানুষের বয়ানে। যারা ভুলে গেছে, তাদের দিয়ে আমি স্মরণ করাতে চাচ্ছি ইতিহাসকে। ইতিহাসের কোনো বিশ্বস্ত কথক আমি হতে চাইনি। ফলে আমাকে সেই সকল মানুষের আশ্রয় নিতে হয়েছে যারা আর কোনোকিছু মনে করতে পারছে না।

বলছেন বিকৃত যৌনাচার আছে। বিষয়টি প্রকাশে কী ধরনের ভাষা ব্যবহার করেছেন?
আমি একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ফেসবুকে। এই উপন্যাসে যৌনতার দৃশ্য প্রকাশ করতে গিয়ে দেখলাম, আমাদের সাহিত্যের ভাষা যৌনতার ক্ষেত্রে এখনো সাবালকত্ব অর্জন করতে পারেনি। নাবালক অবস্থায় ফেলে রেখেছেন আমাদের অগ্রজ কথাসাহিত্যিকেরা। ষাট এবং সত্তরের দশক থেকে সাহিত্যের ভাষা আরও আধুনিক ও চলতি ভাষার দিকে যাত্রা করেছে। কিন্তু যৌনতা কিংবা নারীপুরুষের শরীরের বিবরণ দিতে গিয়ে লেখকরা সেই সংস্কৃত শব্দে বা পুরানো সুশীলরীতিতে ফিরে গেছেন। ক’দিন আগে দেশের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিকের একটা উপন্যাসে পড়লাম, পাড়ার বখাটে ছেলেরা হেঁটে যাওয়া একটা মেয়েকে দেখে বলছে, ‘আইফোনটা বের কর তো, ছবি তুলি, মেয়েটার নিতম্বটা জোস!’ ষাটের দশকের লেখক ভাষায় ‘আইফোন’ নিয়ে আসলেন, ‘জোস’ শব্দটা নিয়ে আসলেন, কিন্তু ‘নিতম্বে’ এসে ঠিকই বখাটেদের ‘সুশীল’ বানিয়ে দিলেন। আমাদের অগ্রজ লেখকরা আমাদের মেইনস্ট্রিমের সাহিত্যে দশকের পর দশক এই কাজটি করে এসেছেন বলে পাঠকের চোখ/কান তৈরি হয়নি। সাহিত্যে যৌনতার (বাংলা) ভাষায় আমাদের লেখকরা যেমন নাবালক অবস্থায় আছেন, পাঠকও তেমন এক্ষেত্রে সাবালক হননি। কিন্তু কে আগে সাবালক হবেন— পাঠক না লেখক? আমি যেহেতু পাঠকের রুচির কথা ভাবি না, আমার গল্প/উপন্যাসের চরিত্রের ভাষাগত কাঠামোর কথা ভাবি, সুতরাং আমার ‘ঝুঁকি’টা নিতে পারি।

আপনি ফেসবুকে লিখেছেন যে, সবকিছুতেই অনুভূতিপ্রবণদের জন্য আপনার এই উপন্যাস না। কেন?
আপাতভাবে মজা করে বলা হলেও বিষয়টির ভেতর মৃদু শ্লেষ আছে। আজকাল দেখি মানুষ সবকিছুতেই অনুভূতিপ্রবণ। ধর্ম-রাজনীতি-যৌনতা কোনো বিষয়েই কিছু বলা যাবে না। অথচ সমাজে এত এত অপরাধ তাতে কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে না। যে লোক রাতদিন ঘুষের উপর থাকে তারও নাকি ধর্মানুভূতি খুব প্রখর। ফলে অনেক লেখক ধর্ম-রাজনীতি-যৌনতা এগুলোকে পাশ কাটিয়ে লেখালেখি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি মনে করি, আমার লেখা যদি কোনো পক্ষকেই আঘাত না করে— ক্ষমতাসীন দলকে না, বিরোধীদলকে না, প্রতিক্রিয়াশীলদের না, ধর্মানুভূতিশীল কিংবা যৌনানুভূতিশীলদের না, যেকোনো ধরনের মৌলবাদীদের না, আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের না, কথিত ভদ্রসমাজকে না— তাহলে আমার লেখার দরকার কী! চারিদিক থেকে গা বাঁচিয়ে লেখার কোনো মানে হয় না। দিনশেষে আমি আমার লেখাটাই লিখতে এসেছি। আমার প্রতি মুহূর্তের সরল অনুভূতিকে নিয়ত আঘাত করে যাচ্ছে যে রাজনীতি, ধর্ম, সামাজিক আচার, সুশীল সমাজের ভণ্ডামি, বৈশ্বিক নোংরামি, জনমানুষের ইতরামি, তার অনুভূতিতে আঘাত দেব না? আমি বিশ্বাস করি, শিল্পসাহিত্য টিকে আছে কেবল ক্ল্যাসিক আর্ট সৃষ্টির জন্য নয়। আর্টের যা মহান তার বেসিক শতশত বছর আগেই সৃষ্টি হয়ে গেছে। শিল্পসাহিত্য নিয়ত সৃষ্টিশীল আছে সময়ের প্রয়োজনে। সমকালীন মানুষ এবং সভ্যতার ভণ্ডামি ও অসঙ্গতিকে অ্যাড্রেস করতে। যারা নিজের সময়কে এড়িয়ে অন্যের সময়ের অসঙ্গতি নিয়ে লেখেন, আর নিজের সময় নিয়ে লিখতে গিয়ে সুখ-সমৃদ্ধি, প্রেমপ্রীতি ছাড়া আরকিছু চোখে পড়ে না, তাদের প্রতি করুণা ছাড়া আর কী থাকে! সমাজে যা কিছু ভালো তা নিয়ে লেখকরা নিশ্চয় লিখবেন, কিন্তু শিল্পীদের দৃষ্টি থাকবে অসঙ্গতির দিকে। সমাজ ও মানুষের মনে যে চিরকালীন রোগ বাসা বেঁধে আছে, সেদিকেই তিনি ক্লান্তিহীন খোঁচাতে থাকবেন।