ভাস্কর্যশিল্পী মৃণাল হকের প্রতি ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক তার নামটি মৃণাল ঘোষ লিখলাম একটা বিশেষ কারণে। সেই কারণ ব্যাখ্যার আগে বলি, এই শিল্পীর সাথে আমার পরিচয় প্রায় একযুগের। ঢাকা শহরের বিভিন্ন ভাস্কর্য নিয়ে ধারাবাহিক রিপোর্ট করার ইচ্ছে নিয়ে তার সাথে প্রথম আলাপ করি। তখন তার কাজ সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানাবোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে বিতর্কিত ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার ইস্যুতে এই ভাস্কর্যের শিল্পী মৃণাল হককে নিয়েও যেহেতু বেশ বিতর্ক আর আলোচনা হচ্ছে, সেই আলোকে কিছু কথা বলার প্রয়োজনবোধ করছি।
ঢাকা শহরে এখন আমরা যেসব ভাস্কর্য দেখি, তার অধিকাংশেরই শিল্পী মৃণাল হক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রূপসী বাংলা হোটেল চত্বরে ঘোড়ার ভাস্কর্য যেটির নাম ‘রাজসিক বিহার’, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে ‘রত্নদ্বীপ’, নৌবাহিনীর সদরদপ্তরের সামনে ‘অতলান্তিক’, মতিঝিলের ‘বক’, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গোল্ডেন জুবিলী টাওয়ার’ ইত্যাদি। এর মধ্যে অনেক কাজই ফরমায়েসি। তবে মৃণাল হকের ভিন্নধর্মী কাজের মধ্যে রয়েছে নাবিস্কো বিস্কুট কারখানার পাশে সাইকেলের পুরানো চেইন দিয়ে তৈরি ভাস্কর্য ‘জাঙ্কইয়ার্ড ফ্যামিলি’। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর মোড়েও এরকম একটি ভাস্কর্য রয়েছে। তবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে পরিবাগে তিনি যে ভাস্কর্যটি বানিয়েছেন, সেটি অত্যন্ত নিম্নমানের। এত দুর্বল আইডিয়া এবং নির্মাণশৈলির ভাস্কর্য রাজধানীর ব্যস্ততম একটি সড়কের পাশে কী করে নির্মিত হলো এবং এটি সরিয়ে নেয়ার জন্য কেন দাবি উঠছে না, সেটাই বরং বিস্ময়ের।
তবে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হলো সুপ্রিম কোর্টের সামনে একজন নারী বিচারকের ভাস্কর্যটি। একজন গ্রিক দেবির আদলে এটি তৈরি করা হলেও তাকে শাড়ি পরিয়ে শিল্পী একে বাঙালি নারীর রূপ দিতে চেয়েছেন। মৃণাল হক নিজেও দাবি করেছেন যে, এটা গ্রিক দেবির মূর্তি নয়, বরং বাঙালি নারী। কিন্তু বাঙালি নারীর হাতে তলোয়ার ধরিয়ে দিয়ে শিল্পী এখানে কী বোঝাতে চেয়েছেন এবং বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় তলোয়ার কী অর্থ বহন করে, তা পরিষ্কার নয়। শিল্পী আসলে গ্রিক দেবির আদলেই ভাস্কর্যটি বানিয়েছেন কিন্তু সেটিকে বাঙালির নারীর আদল দিতে গিয়ে পুরো জিনিসটাকে হাস্যকর বানিয়ে ফেলেছেন। আবার তিনি যদি স্বীকার করেন যে এটা গ্রিক দেবির আদলে তৈরি, তাহলে গ্রিস সরকার তাদের একজন দেবিকে বিকৃত করার অভিযোগ আনতে পারে। সম্ভবত এই ভয় থেকেই মৃণাল হক এখন এটা স্বীকার করতে চাইছেন না যে, এটি গ্রিক দেবির আদলে তৈরি।
কিন্তু তর্কটা অন্য জায়গায়। তা হলো, এই ভাস্কর্যটি অপসারণ ইস্যুতে মৃণাল হককে নিয়ে নানাবিধ ব্যক্তিগত আক্রমণ হচ্ছে। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে হেফাজতে ইসলামের একজন শীর্ষ নেতা মৃণাল হক সম্পর্কে যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, তা শোভন নয়। ফেসবুকেও মৃণাল হককে নিয়ে নানাবিধ ব্যক্তিগত আক্রমণ হচ্ছে। তাতে মনে হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্যটি মৃণাল হকের একক সিদ্ধান্তে বসানো হয়ছে। তার কাজ নিয়ে, তার নির্মিত ভাস্কর্যের শিল্প মান নিয়ে তর্ক হতেই পারে। যদি কোনো ভাস্কর্য শিল্প মানে উত্তীর্ণ না হয়, তাহলে সিটি করপোরেশন চাইলে নিশ্চয়ই সেটি সড়কের পাশ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য দেয়া যৌক্তিক নয়।
আমরা স্মরণ করতে পারি, রাজধানীর সাতরাস্তার মোড়ে ‘বর্ষারানী’ নামে মৃণাল হক একটি নান্দনিক এবং বেশ বড়সড় ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রয়োজনে সেটি সরিয়ে ফেলতে হয়েছে। এই ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার সময় এর বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলেননি। কোনো প্রতিবাদ হয়নি। কেননা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য এটি সবাই মেনে নিয়েছেন। তাহলে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে নারী বিচারকের ভাস্কর্য সরানো নিয়ে কেন এত প্রতিবাদ এবং এর শিল্পীকে নিয়ে কেন এত বিতর্ক?
এর কারণ অত্যন্ত পরিষ্কার। তা হলো, এই ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলতে জোরালো দাবি তুলেছিল হেফাজতে ইসলাম। যেহেতু হেফাজতে ইসলামের এই দাবির পরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এই ভাস্কর্যের নান্দনিক ও শৈল্পিক মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং অবশেষে এটা সরিয়েও ফেলা হয়েছে, অতএব এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি পক্ষ আন্দোলনে নেমেছে। অথচ যখন এই হাস্যকর ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টের মতো স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থাপন করা হয়, তখন প্রথম প্রতিবাদটি আসা উচিত ছিল দেশের শিল্পী সমাজের মধ্য থেকে, বিশেষ করে যারা ভাস্কর্য বোঝেন। কিন্তু সেরকম কোনো প্রতিবাদ হয়নি। কিন্তু যখন হেফাজতে ইসলাম এটি সরিয়ে নেয়ার দাবি তুললো তখন অনেকেরই এটা ভালো লাগেনি। অবশ্য হেফাজতে ইসলামের এই দাবির পেছনে কোনো শৈল্পিক বা নান্দনিকবোধ ছিল না। তাদের যুক্তি ধর্মীয়। এই ভাস্কর্যটি শহরের অন্য যেকোনো স্থানে স্থাপন করা হলে হেফাজতে ইসলাম নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করত না। কিন্তু এখানে তারা প্রতিবাদ করলো কারণ এই এলাকায় জাতীয় ঈদগাহ যেখানে দুই ঈদের নামাজে লাখো মানুষ অংশ নেন। হেফাজতের দাবি, নামাজের সময় এই ভাস্কর্যটি (তাদের ভাষায় মূর্তি) মুসল্লিদের চোখে পড়বে।
হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে ভাস্কর্যটি সরানোয় এত বিতর্ক। যদি এটি স্থাপনের পরপরই দেশের নাগরিক সমাজ বা কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনের দাবির মুখে এটি সরিয়ে নেয়া হতো, তাহলে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হতো না। ফলে দেখা যাচ্ছে, তর্কটা ভাস্কর্যের শিল্প মান নিয়ে নয়, বরং ঘুরপাক খাচ্ছে ধর্মীয় এবং সঙ্গত কারণেই রাজনীতির বৃত্তে।
এই ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার অব্যাবহিত পূর্বেই হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে সরকার মাস্টার্সের সমমান বলে ঘোষণা দেয়। ফলে অনেকেই এই ভেবে আতঙ্কিত বোধ করছেন যে, এভাবে একের পর এক হেফাজতের দাবি মানতে থাকলে দেশটা শেষমেষ ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ হয়ে যাবে কি না?
যদিও এটা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে, সরকার আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হেফাজতের মতো একটি বড় ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যেতে চায় না। তাদের তুষ্ট রাখা এবং যাতে কোনোভাবেই হেফাজত ২০১৩ সালের মতো রাজধানীতে আর কোনো বড়ধরনের সমাবেশ করতে না পারে সেজন্য তাদের সাথে একটা সমঝোতামূলক সম্পর্ক যে বজায় রাখছে, তা বেশ পরিষ্কার।
আমরা আবারও মৃণাল হক প্রসঙ্গে ফিরি। সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্যটি অপসারণ ইস্যুতে যখন নানাবিধ বিতর্ক চলমান, তখন আমরা মৃণাল হকের অন্যান্য ভাস্কর্যের শিল্পমান এবং মূল সড়কের পাশে তিনি কী করে এরকম দুর্বল ভাস্কর্য স্থাপন করতে পারলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এই প্রশ্নগুলো আরও আগেই ওঠা উচিত ছিল। তবে এখানে এককভাবে তাকে দোষারোপের সুযোগ নেই।
সুপ্রিম কোর্টের মতো এলাকায় একজন নারী বিচারকের ভাস্কর্য স্থাপনের আইডিয়া হয়তো মৃণাল হক বিচার বিভাগকে দিয়েছেন অথবা সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষই তাকে বলেছে যে, এরকম একটি ভাস্কর্য তৈরি করে দিন; এখানে মূল দায়িত্বটা কার? আাবর মৃণাল হক এটি যখন নির্মাণ সম্পন্ন করলেন তখন এটি উন্মোচনের আগে এর শিল্পমান এবং এটি নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক হতে পারে কি না, সেসব বিবেচনা করার দায়িত্ব ছিল কাদের? তারা সেই দায়িত্ব পালন করেছেন? সুপ্রিম কোর্টের মতো একটি স্পর্শকাতর জায়গায় কী ভাস্কর্য বসানো হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা যেত না? বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ হলেও যে দেশের সকল রাজনৈতিক দল ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে এবং ধর্মীয় বিষয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকে, সেখানে একজন নারীর হাত তলোয়ার আবার পরনে শাড়ি-এরকম একটি হাস্যকর ভাস্কর্য সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপন করা হলে তা নিয়ে যে ধর্মীয় কোনো গোষ্ঠী উন্মাদনা তৈরি করবে, সেটি কি আগেই বোঝা উচিত ছিল না? এখন হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে এটি সরিয়ে ফেলায় কার মর্যাদা বাড়লো আর কার কমলো? কে জিতলো আর কে হারলো? এই ভাস্কর্যটি যদি শিল্প মানে উত্তীর্ণ হতো, যদি এটি সত্যিই সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপনের যোগ্য হতো, তাহলে এ নিয়ে হেফাজতের আন্দোলন হালে পানি পেত না এবং আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীও এই ইস্যুতে কথা বলতেন না।
তবে যত যাই হোক, মৃণাল হককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা উচিত নয় এ কারণে যে, তিনি সিটি করপোরেশন বা সরকারের অন্যান্য দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের বুঝিয়ে শুনিয়ে সড়কের পাশে ভাস্কর্য স্থাপনের অনুমতি নিলেও, এখানে দায় মূলত সরকারের ওইসব দপ্তরের। রাজধানীর বুকে কোথায় কী ভাস্কর্য স্থাপন হবে, সেটি নিশ্চয়ই একজন শিল্পী নির্ধারণ করবেন না। এরজন্য একটি শক্তিশালী কমিটি থাকতে হবে। দেশের প্রখ্যাত ভাস্কররা সেই কমিটির সদস্য হবেন। আবার সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান যদি মনে করে যে, অমুক স্থানে একটি ভাস্কর্য নির্মিত হবে, তাহলে সেখান দরপত্র আহ্বানের মতো নিয়ম মানতে হবে। যে ভাস্কর সেটি নির্মাণ করবেন, কাজ শেষ হবার আগে ওই কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে যে, এটার শিল্পমান ঠিক আছে কি না, এটি নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ আছে কি না? একজন শিল্পী চাইবেন আর প্রধান সড়কের পাশে বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় তার ইচ্ছেমতো একটা ভাস্কর্য স্থাপন করে দেবেন, তা হতে পারে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)