‘অভিনয়ে অনেককেই মা ডাকে! সেটা তো ওর অভিনয়। যতজনকে ডাকুক দিন শেষে সিয়ামের মা’তো আমিই। (হাসি) টেলিফোনের ওপার থেকে মাহমুদা বেগমের প্রাণখোলা নির্ভার হাসির আওয়াজ শোনা যায়। এ হাসি মায়ের হাসি। ভালোবাসার হাসি।’
মা দিবসের আগের সন্ধ্যায় ফোনেই চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা চলে টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনয় মুখ কিংবা বর্তমানে সিনেমার ‘পোড়ামন ২’ বা ‘দহন’ অভিনেতা সিয়াম আহমেদ-এর মা মাহমুদা বেগমের সঙ্গে। মায়ের হাতে ফোনটি ধরিয়ে দেন সিয়াম নিজেই।
নিজের বিষয়ে কিছু বলার আগ্রহ নেই তার। কেবল সন্তান প্রসঙ্গেই কথা বলতে চান তিনি। মায়েরা বুঝি এমনই হয়। নিজেকে উহ্য রেখে সন্তানকে তুলে ধরেন সামনে। ‘সন্তান নয় অভিনেতা সিয়াম নিয়ে মূল্যায়ণ কী? কত নম্বর দেবেন?’ প্রশ্নে টেলিফোনের ওপারে তার চিন্তামগ্ন মুখের ছবি কল্পনা করা যায়। তিনি বলেন, নম্বর কম দেব কেন? দশ-এ দশই দেব। তবে ওর অভিনয়ের সবচেয়ে বড় সমালোচক কিন্তু আমি আর ওর বাবা। দুজনের যেগুলো ঠিক মনে হয়না সেগুলো ওর সঙ্গে আলোচনা করি। ও কিন্তু ঠিক শুধরে নেয়।’ নিজের পরে অভিনয়ে যাদের মা ডাকে তাদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশি সিয়ামের মায়ের মত বলে মনে হয়?’ প্রশ্নে দরাজ হাসেন। বলেন, ‘এভাবে তো ভাবিনি কখনও। এবার থেকে ভাববো।’
‘খুব লক্ষ্মী ছেলে একদম তাহলে সিয়াম? কোন দুষ্টুমি করেনা কিংবা ছোট বেলাতেও করেনি?’ প্রশ্নে ফিক শিশু সুলভ হাসির আওয়াজ শোনা যায়। তিনি বলেন, না আসলেই সিয়াম লক্ষ্মী ছেলে। মিথ্যা বলেনা একদম। সব কিছু শেয়ার করে। বিশেষ করে আমার কাছে কিছু লুকায়না। কাকে পছন্দ করে না করে সব বলে! মানুষকে সম্মান করে তার যতটুকু প্রাপ্য। কাউকে হেয় করে কথা বলে না। কারো ক্ষতির মানসিকতা নেই।’ একটু থেমে গর্বিত মা বলেন, দুষ্টুতো কিছুটা ছোটবেলায় ছিলোই। ওটা তো সব ছেলেমেয়েই থাকে। তেমন বড় কিছু না।’ তারপর নিজে থেকেই ছোটবেলার দুষ্টু সিয়ামের ঘটনা তুলে ধরেন।
বলেন, তখন ওর তিন থেকে চার বছর বয়স হবে। আমি কাজে গেছি। ওর বাবাও অফিসে। বাসায় কাজের মেয়ের কাছে ছিল। কাজের মেয়ে ওকে ফিডার দিয়ে একটু বাথরুমে গেছে। আর দুষ্টু বিছানা থেকে কোন ভাবে নেমে কাজের মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে তার বাথরুম বাইরে থেকে লক করে দিয়েছে। এখন মেয়েটাকে না দেখে সে চিৎকার করে কেঁদে তারপর সোফায় ঘুমিয়ে গেছে ফিডার হাতে। পাশের ভাড়াটিয়ারা আমাকে ফোন দিয়েছে। আমি ওর বাবাকে। এসে দরজা ভেঙ্গে কাজের মেয়েকে উদ্ধার করেছি। আর সে ঘুম।’ তিনি স্মৃতি রোমন্থন করে চলেন। বলেন, আরেকবার ৫/৬ এ পড়ে সম্ভবত। কাজের ছেলেটার সঙ্গে খেলতে গেছে বাইরে। রাস্তায় এক মাইক্রোবাস ড্রাইভার ওকে গাড়িতে নিয়ে ওর হাত থেকে সোনার আংটি নিয়ে নিয়েছে। ভাগ্যিস ওকে নিয়ে যায়নি।’
মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের কথোপকথন শুনছিলেন সিয়াম। মায়ের কথা শেষ হতেই ফোনে বলেন, আমি কিন্তু সত্যি ভালো ছেলে। দুষ্ট নই। ‘যে বয়সে নিজেকে অনেকটাই দূরে সরিয়ে নেয় বেশিরভাগ সন্তান সে সময় আমি আরো আকড়ে ধরছি। কার যখন মাকে বেশি কাছে পাওয়ার কথা মানে শৈশবে এবং কৈশোরের একটা বড় সময়, তখন খুব বেশি পাইনি। নানু-খালা-কাজের মেয়ের কাছে সময় কেটেছে বেশি। কারণ মা চাকরি করতেন। তার ওপর আমি একমাত্র সন্তান। অসম্ভব অভিমান ছিল। কেন তারা বেশি সময় দেননি। কেন আমি একা? এসব আমাকে কষ্ট দিত। কিন্তু পরে বুঝেছি নিজে থেকেই আমার জন্যই এ কষ্ট করেছেন। আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে খেটেছেন। নিজের চাওয়া পাওয়া দূরে ঠেলে প্রানান্ত পরিশ্রম করেছেন। যে কারণে আজকের প্রায় ব্যারিস্টার আমি। কিঞ্চিৎ পরিচিত অভিনয় শিল্পী আমি।’
অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা ভরা কণ্ঠে সিয়াম বলে চলেন, ‘ ফলে যত সময় গিয়েছে বাবা-মায়ের কাছে এসেছি। তাদেরকে বেশি করে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করি। ছোটবেলার ঘাটতিটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য। তাদের কাছে আমি অকপট হয়েছি। কারণ বুঝতে পারি মা কিংবা বাবার চাইতে নিঃস্বার্থ বন্ধু কেউ নেই। আমি ছোট থেকে পড়াশোনায় বেশি আগ্রহী। স্কুলে বা কলেজে দেখেছি ভালো রেজাল্ট করলে বন্ধু হওয়ার হিড়িক পড়ত। একটু খারাপ হলে সেই বন্ধুদের অনেকে দূরে সরে যেত। স্বার্থের আঁচ বুঝেছি তখনই।
অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন আহমেদ এবং মাহমুদা বেগমের একমাত্র সন্তান সিয়াম আহমেদ। গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর। জন্ম এবং বড় হওয়া রাজধানীর শাজাহানপুরে। বর্তমানে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ‘দহন’ সিনেমার জন্য।
সবশেষে সিয়াম বলেন, আমার কাছে প্রতিটা দিন মা দিবস। তারপরও মা দিবসে মাকে বলব, মা আমি জানিনা তোমাকে কতটা ভালোবাসি! বোঝাতেও পারবনা কতটা ভালোবাসি।
মা’কে বুকে টেনে নিয়ে যে ফোনের ওপার থেকে কথাটা বলছেন সিয়াম তার উষ্ণতা ফোনের এপার থেকেও ঠিক টের পাওয়া যায়।