চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

যখন পুজোর সময় থাকত খিদের সঙ্গে লড়াই

ছেলেবেলায় আমাদের গাঁয়ে কোনও বারোয়ারি দুর্গাপূজা হতো না। গোটা এলাকা জুড়ে কেবল থানা সদরে অবস্থিত গোবিন্দ-জিওয়ের মন্দিরে হতো দুর্গাপূজা। সত্যি কথা বলতে কী, দুর্গাপূজাটা গাঁয়ের অধিকাংশ মানুষের কাছেই কোনও সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না।

তখন আশ্বিন কিংবা কার্তিক মাস। আমাদের একফসলা জমির দেশে, বৈশাখ মাসের মধ্যেই ধান-চাল ফুরিয়ে যেত অধিকাংশ বাড়িতে। আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্রের মাঝামাঝি অবধি চাষের জমিতে কাজ জুটত মজুরদের। দিনান্তে আধপেটা হলেও জুটত। ভাদ্রের মাঝামাঝি থেকে পুনরায় কর্মহীন হয়ে পড়ত গাঁয়ের বারো আনা মানুষ। তারপর আসত সেই ঘোর আশ্বিন ও কার্তিক—দীর্ঘ দু’দুটো মাস। গাঁয়ের বারো আনা মানুষের ঘরে একদানাও ধান-চাল নেই। মাঠেঘাটে কাজও নেই তিলমাত্র। গোটা ছেলেবেলা জুড়েই দেখেছি, ওই দুটো মাস আমাদের এলাকায় নেমে আসত পুরোপুরি দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া। যাকে বলা হতো ‘মঙ্গা’। এলাকার বারো আনা মানুষ বলা যায় তখন অনাহারেই দিন কাটাত। বনেবাদাড়ে, পুকুরপাড়ে ঘুরে ঘুরে, কুড়িয়ে-কাড়িয়ে নিয়ে আসত কন্দকচু, শাকপাতা—দিনান্তে ওগুলোই সেদ্ধ করে পেটে পুরত। আর, উপোসি পেটে ওইসব অখাদ্য-কুখাদ্য প্রবেশ করা মাত্রই বাধিয়ে দিত ধুন্ধুমার কাণ্ড। ডায়রিয়া, কলেরা, বমি—উপোসি শরীরগুলো তাতে করে আরও অসাড় হয়ে যেত। এমনকি, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতেও দেখেছি, কোনওমতে দুটো পয়সা সংগ্রহ করে পরিবারের কর্তাটি দিনান্তে এক সের (তখনও কেজি বা কিলোগ্রাম চালু হয়নি) আটা নিয়ে বাড়ি ফিরল। সেই আটা এক হাঁড়ি জলে ফুটিয়ে বাড়িসুদ্ধ মানুষ এক বাটি করে পেটে পুরে খিদে মেটাত। মনে পড়ে, ওই দিনগুলোতে রোজ দিনই গ্রামের কোনও না কোনও প্রান্ত থেকে কান্নার রোল উঠত। শুনতাম কখনও ঘোষ পাড়ায়, কখনও কুড়ুলিয়ায়, কখনও নয়নকার বা কোনো পাড়ায় শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অকাল মৃত্যুতে কান্না। দিদিমার মুখে শুনতাম, খগেনের বউটা এক নাগাড়ে পাঁচদিন অনাহারে থেকে আজ চলেই গেল ওপারে! বাস্তবিক, আমাদের ছেলেবেলায় প্রত্যেক বছরই ওই দু-আড়াই মাস ভয়াল হয়ে দেখা দিত গোটা এলাকায়।

ঠিক তেমনই পরিস্থিতিতে ফি-বছর আশ্বিন মাসের শেষে বেজে উঠত পূজার ঢাক। উপোসি অর্ধচেতন মানুষগুলো সেই ঢাকের আওয়াজে নিভু নিভু চোখ দুটিকে অতি কষ্টে খুলত। পরমুহূর্তে আবার বুজে আসত চোখ দুটি। বলাই বাহুল্য, ওই পূজায় যোগ দেওয়ার মতো অবস্থায় থাকত না গাঁয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। তাদের তখন অষ্টপ্রহর চলছে একপেট খিদের সঙ্গে নখে-দাঁতে লড়াই।

ঘোষপপাড়ার দয়ালপ্রসাদ শাস্ত্র-পুরাণের গল্প-টল্প অল্পবিস্তর জানতেন। একান্তে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলতেন, এমন ঘোর দুর্দিনে পূজা? উৎসব? এটা তো আসল দুর্গাপূজাই নয়। রামচন্দর রাবণ-রাজাকে হারাবার তরে, লঙ্কার বালুচরে অকালবোধন করেছিল। তা, রামচন্দর ছিল রাজার ব্যাটা, তার পক্ষে বছরের সব মাসই পৌষ মাস। একালেও, তার সমকক্ষ যারা, রাজা, জমিদার—তারাই কেবল এমন অসময়ে মেতে উঠতে পারে উৎসবে। এটা হইল রাজা-রাজড়াদের দুর্গাপূজা।

দেখেছি, মহালয়ার পর থেকেই ছকবাঁধা গরুর গাড়িতে চড়ে রোজদিন আসছে সুবর্ণ-বর্ণা, সালঙ্কারা নারীর দল, সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির বউ-ঝি, আত্মীয়-কুটুমের দল। মেঠো পথে গরুর গাড়ির ঢকচানিতে তাদের সোনার অঙ্গে স্বর্ণালংকারগুলি সুরেলা হয়ে বাজত অবিরাম। অন্তঃপুরচারিণী যুবতীদের কলহাস্য, নিজেদের মধ্যে আড্ডা খুনসুটি করতে করতে মাঝে মাঝেই সুরেলা হাসিতে ভেঙে পড়তেন তাঁরা। এসব দৃশ্য দেখে এলাকার কিশোর-যুবারা স্বপ্ন-মদির চোখে ভাবালুপ হয়ে যেত। অনেকে দেবদাসের মতো দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেন।

হ্যাঁ, অভাব আর দারিদ্র্যের ছবিটাকে সড়িয়ে রাখলে পূজার অন্য ছবিও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ছেলেবেলায় পূজার ক’দিন আমাদের জীবনে ভারী মিষ্টি সুবাস বয়ে আনত। ফি-বছরই পূজার আগে সাধ্যমতো নতুন জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা হতো। বাবা আমাদের সামনে সদ্য কেনা জামা-কাপড়গুলি বের করে দিতেন। আমরা যে যার জামা-কাপড়গুলোকে নিজে নিজের গায়ের সঙ্গে লটকে দিয়ে মাপটা দেখে নিতাম। তারপর, যে যার বিছানায় ওগুলোকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।

ষষ্ঠী থেকেই শুরু হয়ে যেত আমাদের পূজা-উন্মাদনা। কিছুক্ষণ পর পরই আমরা ঢুঁ-মারতাম মন্দিরে। প্রতিমা এত আশ্চর্য সুন্দর হয়। পূজার তিনদিন সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত অব্দি চলতে ধূপ-ধূনা-প্রদ্বীপসহ আরতি! সেটাও ছিল একটা বড় আকর্ষণ।

তখনকার সঙ্গে এখনকার পুজোর দুটো লক্ষণীয় তফাত মনে করিয়ে দিতে চাই। এক, তখন মূল আকর্ষণ ছিল প্রতিমা, কিছুটা প্যান্ডেল, আলো ও আরতি। বিদ্যুতের আলো নয়, হ্যাজাকের আলো! সেই সময় ছেলেদের আর মেয়েদের লাইনের মধ্যে যে বাঁশের বেড়াটা থাকত সেটার বাঁশত্ব ছিল নির্ভেজাল। তাই প্রতিমার মুখ আর ভিড়ে আবছা দেখা কারও মুখের আদল নিয়ে মনে মনে কবি হয়ে যাওয়াটা ছিল একটা সাধারণ ব্যাপার। তবে ভিড়টা উপভোগ করতাম। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে একাত্ম হয়ে গেলে ব্যক্তি ‘আমি’র ‘আমিত্ব’টা লুপ্ত হয়ে যায়। সেটার বোধহয় প্রয়োজন আছে!

দুই.
পুরাণ-উপপুরাণ অনুসারে শরৎকালে রামচন্দ্র রাবণ বধের আশায় যে পূজা করেছিলেন সেটাই অকাল বোধন। দক্ষিণায়নে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। শরৎকালে শ্রাবণ থেকে পৌষ পর্যন্ত এই কাল। তাই দেবীকে জাগ্রত করতে রামচন্দ্রকে অকাল বোধন করতে হয়। জয়লাভের জন্য তিনি দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হন। কেননা, দেবী পাপ, ভয়, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, শত্রু থেকে ভক্তকে রক্ষা করেন। তবে আমরা বাঙালিরা দেবী দুর্গাকে ঘরের মেয়ে বানিয়ে পূজা করি। বাংলায় ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা কংসনারায়ণ দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিন কল্পারম্ভ ও বোধন হয়। তারপর আমন্ত্রণ, তারপর অধিবাস। এভাবেই নিয়ম মেনে চলে আসছে দুর্গা পূজা। শৈশব ও কৈশোরে আমরা যে পূজা দেখেছি।

সেকাল-একালের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য চোখে পড়ে দুটি বিশেষ অনুষ্ঠানে। একটি কুমারী পূজা, অন্যটি বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠান। শ্রীরামচন্দ্র পূজাকালীন নবমী তিথিতে দেবীকে দর্শন করেন কুমারীরূপে। তিনি তখন তাঁকে পূজা করেন। সেই থেকে নবমীর দিন কুমারী পূজার প্রচলন হয়ে যায়। অবশ্য ভিন্ন মত অনুসারে অষ্টমী তিথিতেও কুমারী পূজার চল রয়েছে। শাস্ত্র অনুসারে এই কুমারীকে হতে হবে ব্রাহ্মণ কন্যা। কেননা দেবীর বিভিন্ন রূপ কল্পনা করে এই পূজা করা হয়।

যেমন এক বছরের কন্যা সন্ধ্যারূপে, দু বছরের কন্যা সরস্বতীরূপে, তিন বছরের কন্যা ত্রিধামমূর্তিতে, চার বছরের কন্যা কালিকারূপে, পাঁচ বছরের কন্যা সুভগারূপে, ছয় বছরের কন্যা উমারূপে, সাত বছরের কন্যা মালিনীরূপে, আট বছরের কন্যা কুব্জিকারূপে, নয় বছরের কন্যা দেবী সন্দর্ভারূপে, দশ বছরের কন্যা অপরাজিতারূপে, এগারো বছরের কন্যা রুদ্রাণীরূপে, বারো বছরের কন্যা ভৈরবীরূপে, তেরো বছরের কন্যা মহালক্ষ্মীরূপে, চোদ্দো বছরের কন্যা পীঠনায়িকারূপে, পনেরো বছরের কন্যা ক্ষেত্রজ্ঞারূপে, ষোলো বছরের কন্যা অম্বিকারূপে পূজিতা হয়।

এই নিয়ম চলে আসছিল বহুকাল পর্যন্ত। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ এই শাস্ত্রনীতি ভঙ্গ করেন। ১৮৯৮ সালে কাশ্মীর ভ্রমণের সময় তিনি এক মুসলমান মাঝির চার বছরের কন্যাকে কুমারীরূপে পূজা করলেন। জাতপাত ও বর্ণের বৈষম্য ঘুচিয়ে তিনি বললেন সব কুমারীর মধ্যেই দেবীর অধিষ্ঠান রয়েছে। ১৯০১ সালে নয়জন কন্যাকে তিনি কুমারী সাজিয়ে পূজা করেন দেবীর নবরূপের কল্পনা করে। ভাবের ঘোরে তিনি নবরূপে দেবীকে দর্শন করেন এদের মধ্যে।

দুর্গাপূজা
দুর্গাপূজা

যাহোক, আমাদের কৈশোরে দুর্গাপূজার সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল বিজয়া দিন। আমরা অপেক্ষা করতাম বিজয়ার রাতের প্রণামির জন্য। আমরা সহস্র সহস্র বছর ধরে বিশ্বাস করে এসেছি যে, মা আমাদের বিজয়দাত্রী। মায়ের কৃপা হলেই জয় পাব, জয়ন্তী, জয়দাত্রী-বিজয়া মায়ের নাম। বিজয়, মানে বিশেষ রূপে জয়। স্ত্রীলিঙ্গে বিজয়া, কারণ বিজয়া একটি তিথিবিশেষ। পুরাকালে রাজারা এই তিথিতে যুদ্ধযাত্রা করতেন। কারণ এদিন যাত্রা করলে নাকি জয় অবধারিত। মহাবল পদ্ম নামে দৈত্যকে পরাজিত করে দেবী হন বিজয়া, সুরগণকে পরাজিত করে তিনি হয়েছিলেন বিজয়া। বিজয়ার অন্য অর্থ হল পীযূষরূপা। সমুদ্র মন্থনকালে উত্থিত অমৃতের আর এক নাম বিজয়া। অমৃত হল মানুষের শুভশক্তি ও শুভবুদ্ধি। বিজয় উৎসব হল তারই প্রতীক। রাম রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করে—বিজয় উৎসব পালন করেছিলেন এই দিনে। আবার মায়ের বিসর্জনের তিথিও হল এই বিজয়া দশমী তিথি।

সেকালের বিজয়ার সূচনা হতো আনন্দঘন মুহূর্ত আর বেদনার মিশ্রণে। মা এসেছেন চার দিনের জন্যে বাপের বাড়ি। বিজয়ার দিন সব অন্ধকার করে তিনি ফিরে যাবেন পতির কাছে। তাই সবার চোখে জল। রাত পোহালেই দশমী। কবি মেনকার কথায় গেয়ে ওঠেন—নবমী নিশি পোহাইও না!

কখনও বা বলেছেন এবার আমার উমা এলে আর মাকে পাঠাব না। একবার রানি রাসমণির জামাই মথুরবাবু বিজয়ার দিনে মায়ের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন। তিন দিন পরম আনন্দে কাটাবার পর দশমীর পূজা শেষ করে পুরোহিত খবর দিলেন দর্পণ বিসর্জন হয়েছে। এবার সন্ধ্যাবেলা মায়ের বিসর্জন হবে। মথুরবাবু ঘোরের মধ্যে ছিলেন চমকে উঠলেন। বললেন—না মায়ের বিসর্জন হবে না। আমি এই আনন্দের হাট ভাঙতে দেব না। কেউ যখন বুঝিয়ে পারল না—শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব এসে মথুরবাবুর বুকে হাত বুলিয়ে বললেন—মা কি কখনও সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারেন! এতদিন বাইরের দালানে বসে তোমার পূজা নিয়েছেন, এবার সর্বদা তোমার হৃদয়ে বসে পূজা নেবেন। আসল পূজা তো বাইরে নয়, অন্তরে।

বিজয়ার দিন দুপুর বেলায় বড় গামলায় হলুদ জল গোলা রাখা হতো, তাতে দর্পণ দিয়ে তার ভেতর দিয়ে বাড়ির সকলে দেখতেন মায়ের চরণ-যুগল। এবার মায়ের যাত্রাকাল উপস্থিত। উপস্থিত আত্মীয়া, বাড়ির বয়স্কা নারী এয়োতিরা সকলে এগিয়ে আসতেন মাকে বরণ করে বিদায় জানাতে। তাঁদের হাতে থাকত শাঁখ, বরণডালা, মিষ্টি, জল, কনকাঞ্জলির চালের থালা। মায়ের পায়ে ছুঁইয়ে দিতেন শাঁখা, পলা, লোহা। পাঁচ, সাত, নয়—বিজোড় সংখ্যায় এয়োরা বরণ করতেন উলু দিয়ে। এয়োরা সাজতেন কনের সাজে। বিদায়ক্ষণটা হয়ে উঠত স্বর্গীয়। ঢাকি ঢাকে বোল তুলত—মা থাকবে কতক্ষণ মা যাবে বিসর্জন।

এরপর শুরু হ’ত সিঁদুর খেলা। হোলির মতো ছোটখাট একটা অনুষ্ঠান। মায়ের বিদায় ব্যথা কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে সবাই মেতে উঠত আনন্দে। এদিকে দুটো বাঁশের ওপর মার মূর্তি তোলা হতো। আগাগোড়া কাঁধে করে যেতেন মা। শোভাযাত্রা হতো দেখার মতো। পেছন পেছন যেতেন বাড়ির যুবা পুরুষ। মেয়েদের কোনও স্থান ছিল না। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বাড়ির ছেলেরা যেতেন। কর্তার হাতে থাকত মঙ্গলঘট। এর পর কোনো এক পুকুরে মায়ের বিসর্জন হলে মঙ্গলঘটে জল পূর্ণ করে সবাই ফিরে আসতেন বাড়িতে। মঙ্গলঘট রাখা হ’ত বেদিতে বড় পিলসুজে জ্বলত প্রদীপ, শান্তির জল ছিটিয়ে দেওয়া হতো। ছোট ছোট কলাপাতায় লাল কালিতে ডুবিয়ে খাগের কলম দিয়ে লেখা হতো শ্রীদুর্গা নাম। সকাল থেকেই বাড়িতে বিভিন্ন খাদ্যউপকরণ তৈরির উদ্যোগ শুরু হয়ে যেত। সন্দেশ, নারকেলের নাড়ু, বিভিন্ন ধরনের মোয়া (মুড়ি-চিড়া), খইয়ের মুরকি ইত্যাদি তৈরি হতো। লুচি-লাবড়া, পায়েস, মিষ্টিও তৈরি হতো। দেবী বিসর্জনের পর থেকেই শুরু হয়ে যেত বাড়িতে মানুষের আনাগোনা। যে যেখানে থাকতেন সবাই চলে আসতেন। এসেই ধান-দুর্বাসহ প্রণামের পালা চলত, চলত কোলাকুলি—পূর্বপুরুষদের ছবিতে প্রণাম। প্রণাম মানেই হচ্ছে প্রণামি। আমরা যারা ছোট ছিলাম, তাদের জুটত খুচরো পয়সা। আর বড়দের জন্য টাকা। এরপর পেট পুরে খাওয়া। প্রথমে নাড়ু-খই। তারপর লাবড়া-লুচি-পায়েস-মিষ্টি। যে সব বাড়িতে গেলে প্রণামি মিলতে পারে, আমরা সেসব বাড়িতে গিয়ে হানা দিতাম। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের কাছে তখন খাওয়া কিংবা প্রণাম তখন মুখ্য ছিল না, প্রণামিটাই মুখ্য ছিল!

যদিও এখন আচার-অনুষ্ঠান বদলাচ্ছে। বিজয়ার পর প্রণাম প্রায় নেই বললেই চলে। সময়ের অভাব, ইচ্ছার অভাব, ব্যস্ততার অজুহাতে ফোনেই সব সারা হয়। কেউ কারও বাড়ি মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছে এমন উদাহরণ কম। কারণ সেই আন্তরিকতাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। সবাই মিলেমিশে থাকার সেই আনন্দটাই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশ্যই অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে, তবে তা সংখ্যায় খুবই কম!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)