‘স্যার, আমার একজন বন্ধু আছে যে আমার চেয়েও ভালো খেলে। আমি কী তাকে আগামী সপ্তাহে নিয়ে আসবো?’
৫০ বছর আগে ১৯৬৯ সালের এক বিকেলে গোয়ো কারিজোর কথাটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন ফ্রান্সিস করেনহো। গোয়ো তার অনূর্ধ্ব-১০ দলের সেরা খেলোয়াড়দের একজন। সে যখন বলছে তারচেয়েও ভালো খেলা ফুটবলার আছে, তখন তো পরখ করতেই হয়! আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের কোচ করেনহো সায় দিলেন। এই সায় দেয়াতেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন করেনহো। বিশ্ব পেল সর্বকালের অন্যতম সেরা একজন ফুটবল জাদুকরের দেখা!
১৯৫৩ সাল থেকে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের কোচের দায়িত্বে ছিলেন করেনহো। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের কাছে তিনি বিখ্যাত অন্য আরেক কারণে। তিনিই সেই কোচ যার হাত ধরে উত্থান হয়েছে ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামের এক ফুটবল বিস্ময়ের! শুধু তাই নয়, বিখ্যাত অনেক ফুটবলারের আঁতুড়ঘর আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলেছিলেন এই করেনহোই।
২০০৮ সালে মারা যান করেনহো। তার আগে লিখে গেছেন ‘চেবোল্লিতা ম্যারাডোনা’ নামের এক বই, যার মাধ্যমে ১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন অধিনায়কের উত্থান বিষয়ক তথ্য জানতে পেরেছে ফুটবলপ্রেমীরা। বইয়ে করেনহো লিখেছেন, ‘প্রত্যেক মানুষই জীবনে একবার হলেও অলৌকিকতার দর্শন পায়। কিন্তু সবাই সেটা উপলব্ধি করতে পারে না।’
‘আমার জীবনে অলৌকিক ঘটনার দর্শন ঘটে ১৯৬৯ সালে, এক বৃষ্টিস্নাত শনিবারের বিকেলে। আট বছরের এক বালক দেখে আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি যে কোনো কিশোর বল পায়ে এমন জাদু দেখাতে পারে!’
ম্যারাডোনার আবিষ্কারের কৃতিত্বটা যদি ফ্রান্সিস করেনহোকে দেয়া হয়, তবে গড়ে তোলার পূর্ণ প্রশংসাটা পাবে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স। ইউরোপে যে দায়িত্বটা পালন করে আয়াক্স আমস্টারডাম, সাউথ আমেরিকায় সে কাজের ভার আর্জেন্টিনোসের কাঁধে। দুই ক্লাবের খেলোয়াড়রা গড়ে ওঠেন একই ভাবনা ভেবে- বলের জন্য ভালোবাসা আর সমস্ত ভক্তি বরাদ্দ থাকবে তাদের যুব একাডেমির জন্য।
১৯৮২ সাল থেকে আয়াক্স যতগুলো ম্যাচ খেলেছে(১,৭৫৩ ম্যাচ) সবগুলো ম্যাচেই কমপক্ষে একজন করে হলেও তাদের যুব একাডেমির খেলোয়াড় ছিলেনই। আর্জেন্টিনোস এই কাজটা করছে ১৯৭৯ সাল থেকে। সেই সময় থেকে ক্লাবটি প্রতিটি ম্যাচে(১,৬৬৮ ম্যাচ) তাদের যুব একাডেমির একজন অন্তত ফুটবলার খেলিয়েছে।
দুই ক্লাবই জন্ম দিয়েছে একজন করে কিংবদন্তি ফুটবলারের। আয়াক্সের যেমন ইয়োহান ক্রুইফ, আর্জেন্টিনোসের তেমনি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ২০১৬ সালে পরলোকগত ক্রুইফকে আয়াক্স সম্মানিত করেছে তার নামে তাদের স্টেডিয়ামকে নামাঙ্কিত করে। তাদের স্টেডিয়ামের নাম এখন ইয়োহান ক্রুইফ অ্যারেনা। আর্জেন্টিনোসও তাদের কিংবদন্তিকে মনে রেখেছে। তাইতো তাদের মাঠের নাম এস্তাডিও ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা।
নিজের ১৬তম জন্মদিনের ঠিক ১০দিন আগে আর্জেন্টিনোসের হয়ে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় ম্যারাডোনার। সময়টা ১৯৭৬ সাল। পাঁচ বছর বাদে বোকা জুনিয়র্সে চলে যান আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি। আর্জেন্টিনোসের মাঠেই আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলেছেন মেসি। ২০০৪ সালে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে অনূর্ধ্ব-২০ প্রীতি ম্যাচে।
ম্যারাডোনাকে স্মরণীয় করে রাখতে সবরকম ব্যবস্থাই করেছে আর্জেন্টিনোস। স্টেডিয়ামে তার নামে আছে জাদুঘর, আছে ম্যারাডোনা থিম পার্ক। ম্যারাডোনার বিশাল প্রতিকৃতির মধ্যদিয়ে মাঠে প্রবেশ করেন ফুটবলাররা। গত বছর স্টেডিয়ামের সামনে উন্মোচন করা হয়েছে ম্যারাডোনার ভাস্কর্যও।
আর্জেন্টিনোসের সঙ্গে চুক্তির পর ক্লাবের কাছ থেকে একটি ফ্ল্যাট পেয়েছিলেন ম্যারাডোনা। সেই ফ্ল্যাটের নাম এখন ‘কাসা ডে ডিওস’। আর্জেন্টিনোসের সাবেক এক বোর্ড কর্মকর্তা ফ্ল্যাটটি কিনে নিয়েছেন। ম্যারাডোনা যেসব আসবাব ব্যবহার করতেন সেগুলো সংগ্রহ করে বানিয়েছেন এক জাদুঘর। ১৯৭০ সাল থেকে ‘ফুটবল ঈশ্বরে’র অনেক দুষ্প্রাপ্য ছবি দেখতে পাবেন দর্শকরা।
আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স গড়ে উঠেছে রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের পাশের শহর লা প্যাটার্নালে। বুয়েন্স আয়ার্সের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে রিভার প্লেট, বোকা জুনিয়র্স, রেসিং ক্লাব, ইন্ডিপেনডেন্টে, সান লরেঞ্জো, হুরাকানের মতো বড় ও ভয়ঙ্কর সব ক্লাব থাকায় দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করেছে আর্জেন্টিনোস।
আর্জেন্টিনার প্রতিটি বড় ক্লাবেরই নিজস্ব যুব একাডেমি আছে। তারা সেরা প্রতিভাদের খুঁজে বের করে। তাদের পরিচর্যা করে। ব্যাপারটা অনেকখানি পুকুরে মাছ ধরার মতো।
কিন্তু আর্জেন্টিনোসের পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। তারা শুধু মাছই ধরে না, খেলোয়াড়দের তৈরি করে। একজন কিশোর ফুটবলারের সুপ্ত প্রতিভাকে বের করে এনে হীরাতে রূপান্তর করার কাজে আর্জেন্টিনোস সেরা। তাদের প্রতিটি কাজে থাকে স্বকীয়তার ছাপ।
‘আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য হল, তাদের কাজের ধরণ। আর এটা নতুন কিছু নয়। তারা ৫০ বছর ধরে এভাবেই কাজ করছে।’ কথাটা বলেছেন রবের্তো সাপোরিতি। তার আরেক পরিচয় ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী কোচ সেজার মেনোত্তির সহকারী ছিলেন তিনি।
১৯৭৬ সালে ম্যারাডোনার অভিষেক ম্যাচ মাঠে দাঁড়িয়েই দেখেছেন মেনোত্তি ও সাপোরিতি। পরে অনেকেই অবশ্য সেই ম্যাচ চাক্ষুষ দেখার কৃতিত্ব নিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত ম্যারাডোনা একবার নিজেই বলেছেন, ‘যে পরিমাণ লোক দাবী করে যে তারা আমার অভিষেক ম্যাচ দেখেছে, তাদের কথা সত্যি হলে ম্যাচটা মারাকানায় হতো!’
আর্জেন্টিনোস তাদের নিজেদের দাবী করে ‘এল সেমিলেরো ডেল মুন্ডো’ মানে পৃথিবীর একাডেমি বলে। নামটা যথার্থ বলে মনে করেন এই ক্লাবেরই সাবেক খেলোয়াড় ও বর্তমান অনূর্ধ্ব-২০ কোচ ফার্নান্দো বাতিস্তা। কী কারণে, সেটাও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
‘কী পরিমাণ দারুণ সব ফুটবলার এই ক্লাব থেকে বের হয়েছে যে তার হিসেবে করাও দুঃসাধ্য। একটা সোনালি প্রজন্মকে দিয়ে একে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। একে মাপতে হবে এর পরিশ্রম দিয়ে। আর্জেন্টিনোসের পদ্ধতি কখনোই হারিয়ে যাবে না।’
‘আর্জেন্টিনোস কেবল ফুটবলীয় ধরণটাই শেখায় না। খুঁটিনাটির পাশাপাশি মানবীয় দিকগুলোও এখানে শেখানো হয়। আর এই কারণে ম্যারাডোনার পর থেকে ডিয়েগো মারকিচ, হুয়ান পাবলো সরিনদের মতো অধিনায়ক পাওয়াটা মোটেও কাকতালীয় কিছু নয়।’
ফার্নান্দো রেদোনদো, হুয়ান রোমান রিকেলমে, সার্জিও বাতিস্তা, ফ্যাব্রিও কোলোচ্চিনি, ক্লদিও বোরঘি এবং এস্তাবান ক্যাম্বিয়াসোর মতো অনেক আর্জেন্টাইন ফুটবলারের আঁতুড়ঘর এই আর্জেন্টিনোস। বর্তমানে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে খেলা আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব-২০ দলের অধিনায়ক নেহুয়েন পেরেজও আর্জেন্টিনোসের একজন ডিগ্রীধারী ফুটবলার।
তবে ম্যারাডোনার পর আর্জেন্টিনোসের সবচেয়ে বিখ্যাত নামটি হল হোসে পেকারম্যান। ১৯৮০ সালে একাডেমির দায়িত্ব নেন এ কৃতি কোচ। পেকারম্যান ২০০৪-২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন আর্জেন্টিনার কোচ। ২০১২-২০১৮ সাল পর্যন্ত সামলেছেন কলম্বিয়া কোচের দায়িত্বও।
১৯৮০ সালে যে তরুণদের কোচিং করিয়েছেন পেকারম্যান, তাদের হাত ধরেই ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে আর্জেন্টাইন ঘরোয়া লিগ শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনোস। ১৯৮৫ সালে জেতে মহাদেশীয় সেরার ট্রফি কোপা লির্বাতোদোরেস। সেবারই ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে (বর্তমানে ক্লাব বিশ্বকাপ) মিশেল প্লাতিনির জুভেন্টাসকে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল আর্জেন্টিনোস।
৮০ দশকের সুসময়টা পরের দশকে যেতেই নিজেদের রঙ হারাতে থাকে আর্জেন্টিনোস। মূল কারণটা আর্থিক। ১৯৯৩-৯৪ সালে কেবল অর্থের জন্যই ১ হাজার কিমি দূরের মেন্ডেঞ্জা প্রদেশে খেলতে হয়েছে তাদের।
তবে আর্জেন্টিনোস সবচেয়ে সমস্যায় পড়ে ১৯৯৬ সালে। সেবছর ক্লাব পার্ককে কিনে নেয় বোকা জুনিয়র্স। ছোট এই ক্লাবটি ছিল আর্জেন্টিনোসের প্রতিভা সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস। এরআগে অবনমনের কারণে চার বছর শীর্ষ লিগে খেলতে পারেনি ক্লাবটি।
এরপরও প্রতিভা অন্বেষণ থেকে বিরত থাকেনি ক্লাবটি। অতীতের মতো অনেক মেধাবী ফুটবলার এসেছেন ক্লাবটিতে, ভবিষ্যতেও আসবে। বর্তমান সময়ে ক্লাবটির সবচেয়ে মেধাবী ফুটবলারের নাম মাতকো মিলেভিচ। ১৭ বছর বয়সী মার্কিন বংশোদ্ভূত এই ফুটবলার সাত মৌসুম কাটিয়েছেন একাডেমিতে। ১০৭ ম্যাচ খেলে করেছেন ৪৯ গোল। তাকে জাতীয় দলে পেতে একইসঙ্গে কোমর বেঁধে নেমেছে- আর্জেন্টিনা, ক্রোয়েশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মাতকো মিলেভিচদের মতো প্রতিভাকে ধরে রাখতে এবার বেশ সচেষ্ট আর্জেন্টিনোস। অতীতে রিকেলমে, কোলোচ্চিনি, ক্যাম্বিয়াসোদের মতো মেধাবী ফুটবলাররা আর্জেন্টিনোসের মূল দলে না খেলে নাম লেখান বোকা জুনিয়র্সে। ভবিষ্যতে এই ভুলটা আর হতে দিতে চায় না ক্লাবটি। আয়াক্স যেমন তাদের একাডেমির ফুটবলার দিয়ে ইউরোপ মাতাচ্ছে, আর্জেন্টিনোসও চায় সাউথ আমেরিকার ফুটবলে শাসন করতে। আর সে লড়াইয়ে তাদের প্রধান অস্ত্র হবে একাডেমির তরুণ ফুটবলাররাই। হয়তো এদেরই কেউ হয়ে উঠবেন ভবিষ্যতের ম্যারাডোনা, যার হাত ধরে কেবল আর্জেন্টিনোসই নয়, ফুটবল বিশ্ব শাসন করবে খোদ আর্জেন্টিনাও!
বিবিসি.কম অবলম্বনে