হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রাফিদা আহমেদ বন্যা বলেছেন, পৃথিবীর নানা অংশে যখন আমরা ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান দেখতে পাচ্ছি, ঠিক একই সময়ে উত্থান ঘটছে অন্য রাষ্ট্রের মানুষের প্রতি ঘৃণামূলক মনোভাবের জাতীয়তাবাদ। এই দুটির মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও কার্যক্রম ও বিশ্বাসে তারা আসলে এক।
শুক্রবার দি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক লেখায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ধর্মীয় মৌলবাদীদের আন্দোলন খুবই প্রতিক্রিয়াশীল এবং দ্রুত। বাস্তব, নিকট বাস্তব বা কল্পিত যাইহোক, তাদের একটি বা একদল শত্রুপক্ষ রয়েছে। যাদেরকে তারা হুমকি হিসেবে দেখে এবং তাদের প্রতি মারাত্মকভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে।
বেক্সিট, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণাসহ বিভিন্ন কারণ ‘ইসলামিক মৌলবাদ’কে উস্কে দিচ্ছে এবং ইমিগ্রান্ট-সংখ্যালঘুদের জন্য নানা সমস্যা তৈরি করছে বলে জানান রাফিদা আহমেদ বন্যা।
ট্রাম্পের সমালোচনা করে বন্যা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, সেখানে নাইন ইলেভেনের হামলার সাথে জড়িতদের ১৯ জনের প্রায় ১৭ জনের আবাসভূমি যে দুটি দেশে, সেই সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব-আমিরাতকে কেন ওই তালিকা থেকে বাদ দেয়া হলো? দেশগুলো কি খুব ধনী, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা ও কৌশলগত স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? কেন এই নিষেধাজ্ঞাকে ট্রাম্প সংকোচনের নীতি হিসেবে অভিহিত করলেন? কারণ ব্যাপক জনপ্রিয় এই সিদ্ধান্ত সেইসব ভোটারদের আশঙ্কার কারণ হিসেবে এসেছে, যা তাকে ভোটে জিততে সহায়তা করেছিলো। ইসলামিক স্টেট বা আল-কায়েদা পশ্চিমার আধুনিকতা, সাম্রাজ্যবাদ এবং জাতীয়তাবাদ ও সাস্কৃতিকে অভিশাপ হিসেবে অভিহিত করলেও ট্রাম্প এসব বিষয় নিয়ে কিন্তু কোনো জবাব দিচ্ছেন না।
নব্য উদারনীতিক পলিসি এবং বৈশ্বিক শ্রম পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে তথ্য ও বিশ্বায়নের মাধ্যমে অর্জিত মূলধনবিশ্ব নতুন ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে বেড়েছে চরম আয় বৈষম্য। শুধু গরীব দেশগুলোর সিংহভাগ দরিদ্র মানুষের জন্যই নয়, পশ্চিমা দেশের কর্মজীবী শ্রেণীর মানুষের জন্যও এই অর্থনৈতিক মডেল কাজ করছে না। যার কারণে মূল ধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চরম অবিশ্বাস সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো তাদের নিজেদের কিছু সমস্যার সাথে লড়ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতার উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনীতি, ধর্ম এবং তেল রাজনীতি দেশগুলোতে মৌলবাদের উত্থানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সময়ের সাথে ইসলামের সংস্কার না হওয়ার বিষয়টিও এর সাথে জড়িত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কাঠামোর দেশগুলোতেই মৌলবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান বিষয়ে বন্যা বলেন, একটি নতুন এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ধর্মীয় কারণের থেকে এখানে বড় ভূমিকা পালন করছে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনৈতিক সংগ্রাম। দুই বছর আগে বাংলাদেশে আমাদের উপর অতর্কিতভাবে হামলা করা হয়েছিলো।হামলাকারীদের বিপক্ষে যেসব পশ্চিমা জনপ্রিয় নেতারা বিরোধিতা করেছিলো, তারাই এখন মৌলবাদকে উস্কে দিচ্ছে।তারা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
স্বামীর মৃত্যুর ভয়াবহ স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাস্তার উপর আমার স্বামীর রক্তাক্ত ও নিথর দেহ পড়ে আছে। চাপাতির চারটি ভারি কোপে আমার মাথা রক্তাক্ত ও আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে পড়ে গেছে। এর পাশেই আমি হাত উঁচিয়ে সাহায্য চাইছি। এই দৃশ্য ছাড়া ওই হামলার কোনো স্পষ্ট স্মৃতিই আমার মনে নেই। ধর্মান্ধতা ও ঘৃণার এই স্মৃতি আমার আজীবন মনে থাকবে, যা আমার জীবনকে পরিবর্তিত করে দিয়েছে। আমরা কেন এই হামলার শিকার হলাম? কারণ বিজ্ঞান, দর্শন এবং ধর্মান্ধতা নিয়ে আমাদের সমালোচনামূলক লেখাসমূহকে মৌলবাদীরা বিপজ্জনক ভাবতো এবং আমাদেরকে ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো।
তিনি এসব বিষয় নিয়ে কথা শুরুর আগে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নেদারল্যান্ডের হেগ শহরের একটি বই মেলার কথা উল্লেখ করেন। দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে অভিজিৎ রায়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী এই বই মেলার আয়োজন করে হেগ পিস প্রজেক্ট এবং মুক্তমনা (২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে নিহত অভিজিৎ রায়ের তৈরি মুক্ত চিন্তার প্লাটফর্ম)।
বন্যা জানান, বাংলাদেশ থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা মুক্তমনা ব্লগার, মুসলিম দেশগুলোতে অত্যাচারিত ও হুমকিতে থাকা এলজিবিটি কর্মীরাসহ নানা ধরনের মানুষের সমাগম হয়েছিলো ওই মেলায়। নেদারল্যান্ডের মুসিলম ইমিগ্রান্টদের প্রতিনিধি যারা ছিলেন তারাসহ আমরা সবাই একই ধরনের ঘৃণার রাজনীতি ও ভীতির শিকার।