১৩ জুন সকাল এগারোটার কিছু পর জীবনযুদ্ধে পরাজিত হন দেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি কয়েকদিন ধরেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের আশা ছিল, তিনি সুস্থ্ হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। কিন্তু সেটা হলো না। তার জন্ম ১৯৪৮ সালে। তার মানে মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছরের কাছাকাছি। একেবারে অকাল মৃত্যু বলা যাবে না। তবে দেশের জন্য, মানুষের জন্য একটি খারাপ সময়ে তাকে চিরবিদায় নিতে হলো। করোনাভাইরাসের ভয়ে গোটা দেশে বিরাজ এক অস্বাভাবিক অবস্থা। মানুষের মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। এই দুঃসহ যন্ত্রণাকালে মোহাম্মদ নাসিমের মতো রাজনীতির পোড় খাওয়া এক নেতাকে শেষ শয্যা নিতে হলো বনানীতে মায়ের কবরে।
তার গুণগ্রাহীদের অনেকের ভাগ্যেই শেষ দেখার সুযোগ হলো না। রাজনীতির, রাজপথের সহযোদ্ধারাও দূর থেকেই সাশ্রু বিদায় দিলেন তাকে। তার প্রিয় সিরাজগঞ্জবাসীও তাকে একনজর শেষ দেখার সুযোগ পেলো না। এরচেয়ে দুঃখ ও বেদনার কিছু নেই।
মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য, পরোদস্তুর রাজনীতির মানুষ। তার বাবা ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সহচর, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের একজন মন্ত্রী। স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলে এম. মনসুর আলী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির উল্টোযাত্রা শুরু হলে যে কঠিন সময় নেমে আসে তখন আওয়ামী লীগর কেউ কেউ ঘাতকদের সঙ্গে রফা করে জীবন বাঁচানোর কৌশল নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর লাশ ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে পড়ে থাকতেই খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের অনেকেই শপথ নিয়েছিলেন। যে কয়জন ভয়কে জয় করে খুনিদের পক্ষে যাননি তাদের একজন মনসুর আলী। এর খেসারত তাকে দিতে হয়েছে জেলের ভেতরে গুলিতে প্রাণ দিয়ে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং মনসুর আলী – জাতীয় এই চার নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি অটুট আনুগত্যের প্রমাণ দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বুকের রক্ত ঢেলে রচনা করেছিলেন দেশপ্রেমের উজ্জ্বল ইতিহাস।
সেনাবাহিনীর স্বল্পকালীন চাকরি ছেড়ে মনসুর আলী ১৯৪৬ মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। তারপর সে সময়ের উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবের অনুসারী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বন্ধনে জড়িয়েছেন। ২৮ বছরের সক্রিয় রাজনীতির জীবনে তিনি কখনই আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিব থেকে দূরে সরেননি।
মনসুর আলী ছিলেন এক বিশেষ সময়ের রাজনীতির আদর্শ মানুষ। এই পিতার পুত্র হলেন মোহাম্মদ নাসিম। তিনি পিতার আদর্শের পতাকা হাতে নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দিয়েছিলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। একদিকে ভয়ভীতি, জেলজুলুম, গুম-অপহরণ, অন্যদিকে লোভ-প্রলোভন দেখিয়ে কেনাবেচার রাজনীতি চালু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার, দুর্বল করার জন্য ঘরশত্রুদের কাজে লাগানো এবং মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতবিরোধী তাবত শক্তিকে জিয়া ঐক্যবদ্ধ করেছেন। নিজে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ এই সুনাম কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, চরম সুবিধাবাদী, দুর্নীতিবাজ, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও ব্যক্তিদের কাছে টেনে রাজনীতিকে ডোবাখানায় ঠেলে দিয়েছিলেন জিয়া।
অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির জন্য চরম প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে জিয়া যখন নিজের ক্ষমতার ভিত মজবুত করার চেষ্টা করছেন, তখন বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। সে সময় অনেকেই মনে করতেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো, রাজনীতির মূলধারায় ফিরে আসা সম্ভব হবে না। ক্ষমতায় ফেরা তো অনেক দূরের বিষয়।
পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির সেই দুর্যোগকালে আওয়ামী লীগের নবীন-প্রবীণ কিছু নেতা-কর্মী দলকে পুনরায় সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাধাবিপত্তি ছিল, এমনকি মৃত্যু ভয়ও ছিল, তারপরও উজানস্রোতে নৌকার পাল টানার কষ্টকর কাজটি বন্ধ করা হয়নি। এই কঠিন কালপর্বেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজেকে সমর্পণ করেন মোহাম্মদ নাসিম। তিনি আগে অবশ্য ছাত্রলীগ এবং যুবলীগে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে একটি সম্পাদকের পদ পাওয়ার মধ্য দিয়ে তার জাতীয় রাজনীতিতে পথচলা শুরু। তারপর গত ৩৯ বছর তিনি পথ ছাড়েননি। তিনি ছয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, চারটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৪-দলীয় জোটের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু । তার রাজনীতির যাত্রাপথ বকুল বিছানো ছিল না। তিনি ড্রয়িংরুম পলিটিক্স করতেন না। তিনি ছিলেন রাজনীতির মাঠের মানুষ। গোটা জীবন তিনি রাজনীতি করেছেন। রাজনীতি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন কিন্তু আপস করেননি, নীতিভ্রষ্ট হননি।
অত্যন্ত হৃদয়বান, কর্মীবান্ধব, দরদি মনের মানুষ মোহাম্মদ নাসিম রাজনীতির এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কিছু কুলাঙ্গার, কিছু ভ্রষ্ট মানুষ যেভাবে তার মৃত্যু নিয়ে বিকৃত উল্লাস করেছেন, তা রীতিমতো নিষ্ঠুর এবং অমানবিক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকতে তিনি দুর্নীর লাগাম টেনে না ধরে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, নিজের ছেলের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারেননি। এসব অভিযোগ তুলে একজন মৃত মানুষকে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যেসব বিদ্রূপ-কটাক্ষ করা হচ্ছে বা হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় কি নিচু মানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চা আমাদের দেশে চলছে। দেশে ক্রোধ এবং বিদ্বেষের যে রাজনীতি চর্চা চলছে তা অনেকের যুক্তিবোধকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। অনেকের সাধারণ ভদ্রতাবোধও লুপ্ত হয়েছে বলে মনে হয়।
এমন ভাবে প্রচার করা হচ্ছে যাতে মনে হয়, মোহাম্মদ নাসিমই বাংলাদেশের প্রথম এবং শেষ স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তার কারণেই আজ করোনাকালে স্বাস্থ্য খাত বেআবরু হয়ে পড়েছে। এই যে একজন মানুষকে সব ব্যর্থতার জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে, তা কী একেবারে উদ্দেশ্যহীন? এর পেছনে কী কোনো রাজনীতি নেই? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংগঠিত এবং বিশেষ বিশেষ মহলের সুপরিকল্পিত প্রচারণা থেকে মনে হয়, এরা বুঝি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। কিন্তু আসলে কী তাই? এরা কী দুর্নীতিমুক্ত দেশ চায়, নাকি ব্যক্তিবিশেষের চরিত্রহনন করে পানি ঘোলা করতে চায়?
এই প্রচারবিশারদরা বিএনপি-জামায়াতের দুর্নীতি নিয়ে মুখ খোলে না। আওয়ামী লীগের ব্যাপারে তারা নির্দয়, ক্ষমাহীন। এদের নীতিবাগীশতাও পক্ষপাত দুষ্ট। কেউ মারা গেলেই তার খারাপ কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যাবে না তা নয়। তবে মোহাম্মদ নাসিমের ক্ষেত্রে যা হলো তা ভবিষ্যতের জন্য মন্দ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, মোহাম্মদ নাসিম যদি বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার প্রতি অবিচল না থাকতেন, তিনি যদি বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব পোষণ না করতেন, একাত্তরের ঘাতক-দালালদের ব্যাপারে নমনীয় থাকতেন, তাহলেও হয়তো তার ‘দুর্নীতির’ অভিযোগ এমন দৃষ্টিকটূভাবে সামনে আসতো না। মন্ত্রীত্ব না পেয়ে অভিমান করে শেখ হাসিনার সঙ্গে দূরত্ব রেখে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় থাকলেও তিনি সম্ভবত শকুনের থাবামুক্ত থাকতে পারতেন।
আওয়ামী লীগের জন্য মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যু-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। দলের কোনো মন্ত্রী-এমপি-নেতার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তা ধামাচাপা দেওয়া ঠিক হবে না। আওয়ামী লীগ এখন কিন্তু বন্ধুহীন অবস্থায় আছে। সব কিছুর পেছনে জামায়াত-বিএনপির হাত না দেখে আরও কারা, কোন দিক থেকে কলকাঠি নেড়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মানুষের মনে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে তা বুঝতে হবে। ঘরের মধ্যও বিষধর সাপের উপস্থিতির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
দারিদ্র, কর্মহীনতা, অনাহার বাড়লে পরিস্থিতি কিন্তু গুজব রটনাকারী ও অপশক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে। নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আছে, তাদের চোখের সামনে দেখতে থাকলে মানুষ কিন্তু বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।
সব দৃষ্টি যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে, তখন তাকে কঠোর হতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালের শেষ দিকে স্লোগান উঠেছিল, ‘মুজিব তুমি কঠোর হও’। তিনি কঠোর হতে কিছুটা সময় নিয়েছিলেন। শত্রুরা সেই কালক্ষেপণের সুযোগ নিয়ে একরাতে সব শেষ করে দিয়েছে। শত্রুদের সময় দেওয়ার কৌশল রাজনীতিতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনার আশঙ্কা তৈরি করে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)