মোস্তাফিজ-সাকিব আইপিএলে খেলছে। তারা খেলার মধ্যেই আছে। ম্যাচ অনুশীলনও হচ্ছে। তারা দলের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডে যোগ দেবে। সাসেক্সে কন্ডিশনিং ক্যাম্পের অনুশীলনটা তো ম্যাচ খেলেই পুষিয়ে নেবে। -আয়ারল্যান্ড ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য বাংলাদেশ দল ঘোষণার আগেপিছে এমন বক্তব্য ছিল বিসিবির।
কিন্তু দিন গড়িয়ে বাস্তবতা, জাতীয় দলের বাকি ক্রিকেটাররা যখন প্রিমিয়ার লিগে রান-উইকেটের সাফল্যে নিজেদের ঝালিয়ে নিয়ে সাসেক্সে ক্যাম্প করছেন; তখন সাকিব-মোস্তাফিজকে মাত্র একটি করে ম্যাচ খেলেই ফিরতে হয়েছে। তাদের ম্যাচ অনুশীলনের এই ঘাটতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি টুর্নামেন্টে টাইগারদের ভোগাবে কিনা এমন প্রশ্নে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলছে সাবেক ক্রিকেটার ও কোচদের থেকে। চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে সাকিবের মানিয়ে নিতে কোন সমস্যা হবে না বললেও তাদের অনেকেই মোস্তাফিজের ব্যাপারে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারলেন না।
কাঁধের চোটের পর দীর্ঘ পুনর্বাসন। নিউজিল্যান্ড সফরে ফেরা, বিরতি দিয়ে কয়েকটি ম্যাচ খেলা, পরে শ্রীলঙ্কায়ও মাঠে নেমেছিলেন মোস্তাফিজ। পারফরম্যান্সের ওঠানামা ছিল। আগের সেই কাটার মাস্টারের দেখা মিলছিল না। লঙ্কা সফরে নিজের খেলা শেষ টি-টুয়েন্টিতে অবশ্য ৪ উইকেট নিয়ে স্বরূপে ফেরার আভাস দিয়েই আইপিএল যান। তারপর লম্বা বিরতি। সানরাইজার্সের হয়ে মুম্বাইয়ের বিপক্ষে খেলা একমাত্র ম্যাচে ২.৪ ওভারে ৩৪ রান দিয়ে উইকেটশূন্য। গত আইপিএলের ‘সেরা উদীয়মান’ খেলোয়াড়কে আর নামারই সুযোগ দেয়নি দলটি। অথচ ফিরে পেতে থাকা ছন্দটা ধরে রাখতে ম্যাচ অনুশীলন খুব জরুরি ছিল ফিজের।
সাকিবের ক্ষেত্রে আবার বিষয়টি উল্টো। সেরা ফর্মে থেকেই আইপিএলে যান। লাল-সবুজের জার্সিতে শেষ টি-টুয়েন্টিতে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন। কিন্তু আইপিএলে একটি ম্যাচ খেলেই ফিরতে হয়েছে তাকেও। কলকাতার হয়ে ইডেনের ম্যাচে পুনের বিপক্ষে ৩ ওভারে ৩১ রান দিয়ে উইকেটশূন্য। এবার বাংলাদেশের টি-টুয়েন্টি অধিনায়কেও ম্যাচ অনুশীলন ছাড়াই নেমে পড়তে হবে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে।
অথচ সাকিব-মোস্তাফিজ যখন আইপিএলে ম্যাচ পাচ্ছিলেন না, সেসময় ঘরোয়া ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিক-নাসির, রুবেল ছয় উইকেট নিয়েছেন। ব্যাটে-বলে পারফর্ম করেছেন জাতীয় দলে ডাক পাওয়া সকলেই। তাতে দুজনের প্রস্তুতিতে ঘাটতিটা থেকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
বিষয়টিকে অবশ্য সেভাবে দেখছেন না বিসিবির ক্রিকেট অপারেশান্স কমিটির চেয়ারম্যান আকরাম খান। ম্যাচ অনুশীলনের অভাবকে বড় করে দেখছেন না তিনি, ‘সাকিব আইপিএলে ক্যাম্প কন্ডিশনের মধ্যেই ছিল। ওর খুব একটা সমস্যা হবে না। ও তো অনেক জায়গায় যেয়ে খেলে। মানিয়ে নেওয়ার স্ট্রেন্থটা অসাধারণ। আইপিএলে খেলানো হয়নি, এটা দুঃখজনক। হয়তো টিম কম্বিনেশনের কারণে খেলায়নি। খেলালে ভালো হত। তবে আয়ারল্যান্ড-ইংল্যান্ডে ভিন্ন ফরম্যাটে খেলা। আমার আশা সাকিব সেখানে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারবে।’
যদিও মোস্তাফিজের ব্যাপারে আকরাম একটু চিন্তিতই থাকলেন। সাকিবের মত জোর দিয়ে বলতে পারলেন না। ম্যাচ অনুশীলনটা ফিজেরই বেশি করে দরকার ছিল বলে মত সাবেক এই অধিনায়কের, ‘মোস্তাফিজের জন্য খেলাটা বেশি দরকারি ছিল। ও তো অনেকদিন পর ফিরেছে। খেলতে পারলে ভাল হত। ম্যাচ প্র্যাকটিসটা ওকে সাহায্য করতো। খেলায়নি এটা দুঃখজনক। আশা করি আয়ারল্যান্ডে গিয়ে সেও দ্রুত মানিয়ে নেবে।’
আরেক সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তার কাছেও আইপিএলে কোন দল কাকে খেলাবে সেটা টিম কম্বিনেশনের ব্যাপার। তবে জাতীয় দলের প্রসঙ্গে ম্যাচ অনুশীলনের বিষয়টি অন্যভাবে দেখতে বলেও ইতিবাচকই থাকলেন মাসুদ, ‘দেখুন, তারা একটা হাইলেভেল ক্রিকেট কোর্সের মধ্যে ছিল। এমন নয় বসে ছিল। সেখানে কঠোর অনুশীলনই করেছে, জিম করেছে। ক্রিকেটীয় সবকিছুই করেছে। তারা তো প্রফেশনাল ক্রিকেটার, কিভাবে ফিরে এসে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে সেটা জানে। সময়টা সেভাবেই নিজেদের প্রস্তুতির মধ্যে রেখেছে। ম্যাচ অনুশীলন হল কি না, কন্ডিশনিং ক্যাম্পে থাকা হল কি না, সেটি মুখ্য নয়। উচ্চপর্যায়ের এসব ক্রিকেটারের যেকোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতাটা আছে। দুটো গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টকে জাতীয় দল অনুশীলন ঘাটতির প্রভাবে কোনভাবে ভুগবে বলে আমার মনে হয় না।’
পাইলট অবশ্য অন্য একটি প্রসঙ্গও টানলেন। জানালেন ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ারের কথাও ভাবতে হবে। তাদের আর্নিং সোর্সের কথাও ভাবতে হবে। আইপিএলে সুযোগ পায় সেরারা। সাকিব-মোস্তাফিজ সুযোগ পেয়েছে। তাদের সেই সুযোগটা নিতে দিতে হবে বলেও মত তার।
জাতীয় দলের সাবেক ওপেনার জাভেদ ওমর বেলিমও পেশাদারিত্বের প্রসঙ্গেই হাঁটলেন। ম্যাচ অনুশীলনের কোনও বিকল্প নেই মেনে নিয়েই সাকিবের প্রায় এক যুগের অভিজ্ঞতা বিশ্বাস যোগাচ্ছে তাকে, ‘সাকিব প্রায় ১১ বছর ধরে শীর্ষ পর্যায়ে খেলছে। তার জন্য এটি বড় কোনও বিষয় হয়ে উঠবে না। পেশাদার একজন ক্রিকেটার যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতেই মানিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য রাখে। সে তো ওখানে গিয়ে বসে ছিল না। একাদশে হয়তো সুযোগ পায়নি, কিন্তু অনুশীলন আর ক্যাম্প আবহর মধ্যেই ছিল। আইপিএলে তো শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটাররাই অংশ নেয়। অনুশীলন মানটাও শীর্ষ পর্যায়েরই হয়। আমার বিশ্বাস সেটি সাকিবের প্রস্তুতিতে কোনও ঘাটতি রাখেনি।’
তবে মোস্তাফিজের ক্ষেত্রে একইরকম বিশ্বাস পাচ্ছেন না জাভেদ। ম্যাচ অনুশীলন ফিজের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখত বলে মত এই সাবেকের, ‘মোস্তাফিজের বিষয়টা একটু অন্যরকম। ও তো অনেকদিন পর ফিরেছে। সব ম্যাচে খেলেওনি। ওর জন্য ম্যাচ অনুশীলনটা দারুণ কিছু হতে পারত। আত্মবিশ্বাস ফেরাতে ভূমিকা রাখতে পারত। সেটি যখন হয়নি, তখন অন্যভাবনাই ভাবতে হবে। ওখানে অনুশীলন করেছে, সেটাই কাজে লাগাতে হবে। পারফর্মার বোলার, ছন্দ খুঁজে নিতে তারও কোন সমস্যা হবে না আশা রাখি।’
সাকিবকে শৈশব থেকে দেখে আসা কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দীনের অভিমতও একই। বিকেএসপিতে ভিত্তি গড়ে ওঠার সময়টাতে তার ছাত্র ছিলেন সাকিব। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের শক্তি-দুর্বলতার দিকগুলো ভালোই জানা। বর্তমানে প্রিমিয়ারে গাজী গ্রুপকে কোচিং করানো এই অভিজ্ঞ অত বিচার-বিশ্লেষণে গেলেন না। চেনা পরিধি থেকেই বললেন, ‘আমার মনে হয় না ওর কোনও সমস্যা হবে। মোস্তাফিজের একটু আত্মবিশ্বাস ফেরা দরকার। তবে ওরও কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। দুজনেই পেশাদার ক্রিকেটার। যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো পর্যায়ের ক্রিকেট খেলার জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখতে পারে তারা। আয়ারল্যান্ড বা ইংল্যান্ডে গিয়ে দ্রুতই মানিয়ে নিতে পারবে। অনুশীলনের মধ্যেই ছিল। মানিয়ে নিতে খুব একটা সময় লাগার কথা নয়।’
জাতীয় দলের সাবেক কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরীও ম্যাচ অনুশীলন না হওয়াতে ক্ষতির কিছু দেখছেন না, ‘তাদের খেলানো হয়নি। তাতে তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। আমরা হয়তো মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছি। সেখানে খুব স্কিলড ট্রেইনাররা আছেন। কোচরাও ভালো। নিশ্চয়ই তারা সেখানে অনুশীলনের ভেতর ছিল। সাকিব খুব ভালো জানে কিভাবে মানিয়ে নিতে হয়। হয়তো তাদের মানসিক অতৃপ্তি থাকতে পরে। তবে খুব একটা ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।’
বিনোদনমূলক প্যাকেজ ক্রিকেট আইপিএলে খেলা বা না খেলা কারো সামর্থ্য বাড়িয়ে দেবে বা একেবারেই কেড়ে নেবে সেটি হয়তো নয়। কিন্তু এই আইপিএলে পারফর্ম করেই হেনরিক্স-লিনরা যখন জাতীয় দলে ডাক পান, ভিলিয়ার্স-উইলিয়ামসনরা নিজেদের ঝালিয়ে নেন; তখন দুই টাইগার তারকার সাইডবেঞ্চ গরম করার অভিজ্ঞতা একেবারেই যে কোনও প্রভাব ফেলবে না সেটিও নয়। অবশ্য মোস্তাফিজ-সাকিব চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার। তারা পুষিয়ে নিতে জানেন। ম্যাচ অনুশীলনের তাদের এই ঘাটতি জাতীয় দলের জার্সিতে কী প্রভাব ফেলবে সেটি আপাতত সময়ের হাতেই তুলে রাখতে হচ্ছে।