চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বৃদ্ধিতে বেড়েছে অর্থপাচারের ঝুঁকি

মোবাইল রিচার্জ, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, টাকার আদান-প্রদান, বীমা প্রিমিয়াম জমাসহ নানামুখী ব্যবহারের সুযোগ থাকায় বেড়েই চলেছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পরিধি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মাত্র এক মাসেই (এপ্রিল) ৩৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।

২০১৯ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসে যথাক্রমে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ৬২৬ কোটি, ৩১ হাজার ৫১৩ কোটি, ৩৪ হাজার ৬৭৮ কোটি ও ৩৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা।

অথচ মাত্র দুই বছর আগেও মাসিক লেনদেন ২৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

তখন অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে টাকার লেনদেন ঠেকাতে লেনদেনের সীমা কমিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্ত ‘নগদ’ সেবা চালু হওয়ার পর গত ১৯ মে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেনের সীমা আবারও বাড়িয়ে দেয়া হয়।

এখন থেকে একজন গ্রাহক তার অ্যাকাউন্টে দিনে ৫ বারে ৩০ হাজার টাকা ক্যাশ ইন বা জমা করতে পারবেন। আর মাসে ২৫ বারে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা ক্যাশ ইন করা যাবে। এত দিন একজন গ্রাহক একদিনে দুই বারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা ক্যাশ ইন করতে পারতেন।

একই সঙ্গে দিনে সর্বোচ্চ ৫ বারে ২৫ হাজার টাকা তোলা বা ক্যাশ আউট করা যাবে। মাসে ২০ বারে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করা যাবে। এত দিন একদিনে ২ বারে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা তোলা বা ক্যাশ আউট করা যেত। মাসে ১০ বারে ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন সুবিধা ছিল।

এ বিষয়ে কী বলছেন বিশ্লেষকরা
তবে ব্যাংক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা বাড়ানো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। এতে আবারও অবৈধভাবে অর্থের লেনদেন বাড়বে। অর্থপাচার হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: লেনদেনের এই সীমা বাড়ানো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তিকে অযৌক্তিক মনে হয়। যা ছিল তা-ই রাখা উচিত ছিল।

তিনি বলেন: নগদ’ হচ্ছে সরকারি মাধ্যম। কিন্তু এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকেও বাড়িয়ে দেয়া অযৌক্তিক। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাইভেট সেক্টরের চাপে পড়ে কয়েকটি অনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা মোটেও ঠিক হয়নি। এর ফলে আবারও অবৈধভাবে লেনদেন বেড়ে যাবে।

আমার মতে, ব্যাংকিং খাতকে আরো আধুনিক করে পুরোপুরি অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হোক। এই মাধ্যমে সেবা প্রদানের আওতা বাড়ানো উচিত। কারণ, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে চার্জ অনেক বেশি।

অর্থপাচারের ঝুঁকি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদও মনে করেন এটা ঠিক হয়নি।

তিনি বলেন: এর মাধ্যমে অর্থপাচার যে হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? এটা নিশ্চিত না হয়ে সীমা বাড়ানো ঠিক হয়নি। যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সব ইউনিটকে এ ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকতে হবে।

কী বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চাহিদা থাকায় সীমা বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: কারো চাপে এটা করা হয়নি।

তিনি বলেন: লেনদেনের সীমা বাড়ানো হোক আর কমানো হোক মানুষের চাহিদা অনুযায়ী অর্থাৎ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ‘নগদ’ লেনদেনে সীমা বেশি। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংগুলোকে তার চেয়ে অর্ধেক কমিয়ে দিবে এটা যৌক্তিক নয়।

‘যে সব প্রতিষ্ঠানকে মোবাইল ব্যাংকিং এর সুযোগ দেয়া হয়েছে তাদের দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। সীমা বাড়ানো বড় কথা নয়, এটাকে নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে বড় বিষয়।’

তিনি বলেন: এই মাধ্যমের লেনদেনে মাঝে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

‘এটা একটা যৌক্তিক কথা যে ‘নগদ’কে দ্বিগুণ দেবে কিন্তু বেসরকারি খাতকে দেবে না কেন? কিন্তু দেয়া বড় বিষয় নয়, তাদের লেনদেন এখনও গুরুত্বসহকারে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিভিন্নভাবে তাদের কাছ থেকে তথ্য নেয়া হচ্ছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের এপ্রিলভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ৬ কোটি ৮৩ লাখ। যা আগের মাসে (মার্চ) ছিল ৬ কোটি ৭৫ লাখ।

এক মাসের ব্যবধানে গ্রাহক বেড়েছে ৮ লাখ। তবে নিবন্ধিত গ্রাহকদের মধ্যে অনেক হিসাবই সক্রিয় নেই।

এপ্রিল শেষে প্রায় ৩৩ লাখ সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যা কমে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে মোবাইলের সক্রিয় গ্রাহক রয়েছে ২ কোটি ৯১ লাখ। এক মাস আগেও এর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ২৪ লাখ। এ মাসে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা লেনদেন করেছেন গ্রাহকরা।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মোট এজেন্ট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৩ জন।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেসব কাজ করা যায়
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো, ক্যাশ ইন, ক্যাশ আউট, একজনের অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যজনের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো, ইউটিলিটি বিল দেওয়া, মোবাইল ফোনের এয়ার টাইম কেনা, পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে মার্চেন্ট পেমেন্ট, সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন দেয়া, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা, বীমা প্রিমিয়াম, ডিপিএস দেয়া ইত্যাদি লেনদেন করা যায়।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ইতিহাস
সুবিধাবঞ্চিতদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং চালুর অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরের বছর পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা করে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু হয়।

১৯৯৯ সালে ইউরোপিয়ান ব্যাংকে সর্বপ্রথম মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু হয়। মূলত, স্মার্টফোন উদ্ভাবনের পরে মোবাইল ওয়াপ (ওয়্যারলেস অ্যাপ্লিকেশন প্রটোকল) পদ্ধতির মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হয়।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা মোবাইল অপারেটর ভিত্তিক হলেও বাংলাদেশে এ সেবা ব্যাংকভিত্তিক। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ সেবা দিচ্ছে। দেশের বর্তমানে ৫৮টি ব্যাংকের মধ্যে ২৯টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন নিয়েছে। তবে বর্তমানে কার্যক্রম আছে ১৬টি ব্যাংকের।