রোববার রিয়াল বেটিসের বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতে লা লিগা মৌসুম শুরু করেছে বার্সেলোনা। ওই ম্যাচে ব্যক্তিগত লড়াইয়ে জিততে জিততেও তিনবার হতাশায় পুড়তে হয়েছে লিওনেল মেসিকে। তার তিনটি শট বারপোস্টে প্রতিহত হয়। তবুও ম্যাচে পুরো ৯০ মিনিট ধরেই মেসির মুখের অভিব্যক্তি ছিল ভাবলেশহীন। বেটিস রক্ষণ ভেঙে একের পর এক গোলের চেষ্টা করে গেছেন আবেগের প্রকাশহীন মেসি!
সাধারণত গোল পোস্টে বল প্রতিহত হলে হতাশ থাকেন ফুটবলাররা। কিন্তু সেদিন মেসির মুখের অভিব্যক্তি ছিল তীরের মতোই তীক্ষ্ণ আর সোজা। অনেকে বলেছেন, বার্সেলোনায় সন্ত্রাসী হামলায় আক্রান্তদের কথা চিন্তা করেই আবেগহীন ছিলেন মেসি।
কিন্তু অনেকে আবার এও বলছেন, বার্সায় সুখে নেই মেসি। বিশেষ করে ক্লাব কর্মকর্তাদের ওপর বিরক্ত তিনি। আগামী বছরই বার্সেলোনার সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে আর্জেন্টাইন সুপারস্টারের। নতুন চুক্তির ব্যাপারে একের পর এক সময়ক্ষেপণ করেই যাচ্ছেন মেসি। এমনও বলা হচ্ছে, নেইমারের পথ অনুসরণ করতে পারেন তিনিও।
কয়েকদিন আগে গুঞ্জন ছড়ায় ম্যানচেস্টার সিটি নাকি ৩০০ মিলিয়ন ইউরোর রিলিজ ক্লজ পরিশোধ করেও মেসিকে কিনতে প্রস্তুত। বেশ কয়েক বছর ধরেই ফুটবল জাদুকরকে দলে পেতে মরিয়া ইংলিশ ক্লাবটি। সবশেষ খবর, মেসিকে দলে পেতে যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি প্রস্তুত সিটি।
তাহলে কি বার্সেলোনা ছাড়বেন মেসি? ইংলিশ লিগ কি অবশেষে ফুটবলের ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’কে দেখতে পাবে? দেখে নেয়া যাক বিশ্লেষকদের চোখের মেসিকে-
নতুন চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন একটা নতুন চ্যালেঞ্জ দরকার মেসির। কারণ তিনি ইতিমধ্যেই বার্সায় সবকিছু অর্জন করে ফেলেছেন। এখন ক্লাবটি ডুবে যাওয়ার আগে ইংল্যান্ডকে লাইফবোট বানিয়ে ন্যু ক্যাম্প থেকে সরে যাওয়া উচিত তার।
ক্লাব ফুটবলে যেহেতু সব অর্জন করা হয়ে গেছে, তাই নিজের উদ্দীপনা জ্বালানোর জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ অনুসন্ধান করতে পারেন মেসি। একটি নতুন ক্লাব, নতুন জার্সি এবং নতুন ভক্ত-সমর্থক, এর সবই উত্তেজনাপূর্ণ মনে হবে। কিন্তু মেসির নতুন চ্যালেঞ্জ যদি অন্য একটি ভিন্ন ক্লাব হয়, তাহলে আগের ক্লাবের কি হবে? যেখানে তিনি বছরের পর বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন।
বার্সেলোনা এই মুহূর্তে পঙ্গু, অক্ষম ও ভঙ্গুর! এই অবস্থায় মেসিকে একটু হলেও অন্য ফ্লাইটে দেখছে বার্সা সমর্থকরা। এরমধ্যে দলের মাঝ মাঠের অর্কেস্ট্রা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাও এখন অধোগামী। কিছুদিন হল বারুদে আগুন নেই লুইস সুয়ারেজেরও। তার ওপর ছয় সপ্তাহের ইনজুরিতে মাঠের বাইরে উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার।
বার্সেলোনার বর্তমান অবস্থায় নিজের আত্মরক্ষা ছাড়া মেসির বড় কোনও চ্যালেঞ্জ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর্জেন্টাইন এতদিন ক্লাবের সঙ্গে অসাধারণ সাফল্য উপভোগ করেছেন, এখন তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ নেয়ার পালা। তার ভূমিকা আগের তুলনায় আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং বার্সাকে তার দুর্দশা থেকে বের করে আনতে মেসিকে নতুনভাবে দাঁড়াতে হবে এবং সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে।
ক্যাম্প ন্যুই তার ঘর
বার্সেলোনার ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামকে নিজের বাড়ি হিসাবে অনেক বছর ধরেই বিবেচনা করেছেন মেসি। এই বাড়ি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ না হলেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় এক সম্রাট হিসাবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এক দশকেরও বেশি সময় হয়েছে, মেসি যখন পেশাদার হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছান এবং তার ফুটবল জীবনজুড়ে রয়েছে একক রঙ; সেটা কাতালানদের লাল এবং নীল।
তিনি এই জায়গাটিকে ভালোবাসেন। ১৩টা বছর অনেক সময়। এই লম্বা সময়ে শীর্ষ পর্যায়ের জার্সি পরার পরও তিনি একই গর্ব এবং আবেগ সঙ্গে নিয়ে খেলার মাঠে প্রবেশ করেন। গত জুলাইতেও মেসি বলেছেন, ‘বার্সেলোনা আমার বাড়ি। কারণ ক্লাব এবং এখানকার মানুষ আমাকে সবকিছু দিয়েছে।’
কে তার নিজের বাড়ি ছাড়তে চায়? এবং সেটা এমন এক সময় যখন বাড়ি ও বাড়ির মানুষজন বিপদে থাকে। মেসিও না। অতীতেও মেসি অসন্তুষ্ট ছিলেন, বোর্ডের সঙ্গে, তাদের নীতির সাথে, কিন্তু একবারও তিনি ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করেননি। বার্সেলোনাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি নেইমারকে ধরে রাখতে অনেক চেষ্টাও করেছেন।
বার্সেলোনায় মেসি সবসময়ই থাকবেন এবং বার্সেলোনা যদি কখনও তাকে যাওয়ার অনুমতি দেয় তাহলে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। আর্জেন্টিনায় তার শৈশবের ক্লাব- নিউয়েল ওল্ড বয়েজেই যাবেন। ম্যানচেস্টার সিটি তিন বছর ধরে চেষ্টা করেছে, কিন্তু বার্সেলোনার জন্য মেসি তো মূল্যাতীত।
বার্সার কি হবে?
কল্পনা করুন, মেসি ম্যানচেস্টার সিটিতে চলে গেছেন। তাহলে বার্সেলোনার আর কি বাকি থাকে? মোটের উপর স্প্যানিশ লিগেরও?
মেসির উপস্থিতি শুধু বার্সেলোনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, স্পেনের জন্যও বিষয়টি একই। ফুটবলের দুই সেরা তারকা মেসি এবং রোনালদো থাকা স্প্যানিশ লা লিগার জন্য তো একটি আর্থিক বিজয়। সারাবিশ্বের মানুষ তাদের খেলা দেখতে স্পেন ভ্রমণ করেন, প্রতি বছর মেসি ও রোনালদোর লাখ লাখ জার্সি বিক্রি হয় এবং টেলিভিশন রেটিং প্রতিবারই আকাশ ছোঁয়া থাকে। মেসি চলে গেলে না বার্সেলোনা না স্পেনের এই ক্ষতি পোষার ক্ষমতা আছে।
মেসির অব্যাহতির অর্থ এই যে, বার্সেলোনাকে মানুষ তখন বলবে একটা সময় দলটা সেরা ছিল। মেসি ছাড়া বার্সেলোনার পুনর্নির্মাণ অনেক বছরও লেগে যেতে পারে।
ছেড়ে দাও, কিন্তু কিসের জন্য?
অর্থ? তিনি তো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ফুটবলারদের একজন।
ট্রফি? ৮টা লিগ শিরোপা, ৫টা স্প্যানিশ কাপ, ৬টা সুপার কাপ, ৪টা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ৩টা উয়েফা সুপার কাপ এবং ৩টা ফিফা বিশ্বকাপ।
পুরস্কার? ৫টা ব্যালন ডি অর, ৪টি ইউরোপিয়ান গোল্ডেন সু এবং আরও
শত শত।
অবশ্য তিনি ইংল্যান্ডের কোল্ড নাইট স্টোকে খেলার সম্মান পাননি। কিন্তু ইংলিশ ক্লাবগুলো তো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের জন্য যোগ্য এবং তারা বার্সেলোনার মুখোমুখি হয় এবং হবে।
মেসি যেহেতু চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন। যেমন আগে বলেছিলেন, চিরদিনের জন্য খারাপের দিকে ঠেলে দিলেও রিয়াল মাদ্রিদের সর্বকালের এবং সবচেয়ে বড় ক্লাব চ্যালেঞ্জের নাম বার্সেলোনা। সে কথা স্মরণ করে নিজের চ্যালেঞ্জেই থাকা উচিত তার।