মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী বীরসেনানী মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন চিরকালের জন্যে চলে গেলেন অনন্তলোকে। গত ২৮ জুলাই শুক্রবার সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঐ দিন ভোরে সিঙ্গাপুর পেরিয়ে খবরটা চলে আসে বাংলাদেশে।
অনলাইন মিডিয়ার আগেই ফেসবুক আর এসএমএস-এর মাধ্যমে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টরের সাহসী সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিনের চলে যাওয়ার বিষাদময় খবরটি। আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্খির বাইরে এই খবরে প্রাক্তন ও বর্তমান জাসদ পরিবারের সদস্য এবং নবম সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাগণ বড় বেশি উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেন। অনেকের কাছে খবরটি এতোটাই বিষাদময়তা তৈরি করে যে, খবরের শতভাগ সত্যতা যাচাই করতে সাতসকালে এদিক-ওদিক অুনসন্ধান করতে থাকেন। টিভি স্ক্রলে খবরটি না দেখে অনেকের মধ্যে মেজর (অব.) জিয়ার বেঁচে থাকার আশা যেনো উঁকি দিতে থাকে। কিন্তু ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সংবাদকর্মীরা নিশ্চিত হন মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আর বেঁচে নেই। সুন্দরবনের মহারাজ মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন চিরবিদায় নিয়েছেন চিরকালের জন্যে।
পরেরদিন শনিবার মেজর জিয়ার মৃতদেহ সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় আনা হয়। ৩০ জুলাই সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্যে এই বীরযোদ্ধার মৃতদেহ জাতীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সবশেষে পিরোজপুরে শেষ জানাযার পর ১ আগস্ট তাঁকে পিরোজপুরের বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়। পিরোজপুরে শেষ জানাযায় ছিল সর্বস্তরের জনগণের ঢল। আওয়ামী লীগ, জাসদেও নেতৃবৃন্দসহ পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনার বিপুলসংখ্যক মানুষ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার জানাযায় অংশগ্রহণ করেন।
দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে তিনি যে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন তার প্রমাণ মেলে তার জানাযায় অসংখ্য মানুষের অংশগ্রহণ এবং শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। বিপ্লবী চেহারা, আজন্ম সাহস এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী এক কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শেষ অব্দি সুন্দরবনের মহারাজ হিসেবেই খ্যাত হয়েছিলেন।
নির্লোভ নায়কোচিত ব্যক্তিত্ব আর উদার মনের অধিকারী হওয়ার কারণে রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে থেকেও ভীষণ জনপ্রিয় থেকেছেন। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন।
তারুণ্যেই তিনি আলোচনায় উঠে আসেন মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য সাহস দেখানোর কারণে। ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ছুটিতে বাড়ি আসেন। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৯নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিলের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। জিয়াউদ্দিন সুন্দরবন এলাকায় কবির আহমেদ মধুসহ অন্যান্যদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলেন। মূলত তাঁকে সামনে রেখেই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত সংঘটিত হতে শুরু করেন। লে. জিয়াউদ্দিন ভারত থেকে অস্ত্র নিয়ে এলে সুন্দরবন এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে অনেকটাই মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। এরপর লে. জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে পিরোজপুর এবং বাগেরহাটের বিভিন্ন স্থানে একাধিক অপারেশন চালিয়ে পাকসেনা ও রাজাকারদের ঘাঁটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় থাকেন।
তবে জিয়াউদ্দিন আবার আলোচনায় আসেন ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর ৭ নভেম্বর পরবর্তীতে সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করার ঘটনায়। রক্তাক্ত আগস্টে তিনি ডিজিএফআই ঢাকা ডিটাচমেন্টের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা এবং পরবর্তীতে ৩ ও ৭ নভেম্বরের ঘটনার পর তিনি বীর উত্তম তাহেরের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঠাঁই নেন নিজেরই হাতে গড়া মুক্তাঞ্চল সুন্দরবনে। ৭ নভেম্বরের ঘটনার পর জিয়াউর রহমানের কমান্ডকে তিনি সম্পূর্ণরুপে অমান্য করেন। অবশেষে নভেম্বরের ঘটনায় তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাহেরের সাথে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তাঁকেও অভিযুক্ত করা হয়। সুন্দরবন থেকে গ্রেফতারের সময় জিয়াউর রহমানের নির্দেশে তার উপর অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়। ৭৬ সালে বিশেষ সামরিক ট্রাইবুনালে যে প্রহসনের গোপন মামলায় বীরউত্তম কর্ণেল (অব.) আবু তাহেরের ফাঁসি হয় সেই মামলায় মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়। পরবর্তীতে তিনি সাধারণ ক্ষমায় জেল থেকে বেরিয়ে আসেন।
মেজর জিয়াউদ্দিন বরাবরই ছিলেন এদেশের রাজনৈতিক শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক কণ্ঠস্বর। সবসময়ই শোষিত, নির্যাতিতদের পক্ষে কথা বলেছেন। মিডিয়া, সভা- সেমিনারসহ যখনই যেখানে গিয়েছেন সেখানেই দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন সমাজ পরিবর্তনের কথা। বলেছেন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা। প্রথাগত রাজনীতির প্রতি কোনোকালেই তাঁর আস্থা, বিশ্বাস ছিল না। এ কারণে সৈনিক জীবনের চলার পথে বিপ্লবের পথকেই মুক্তির পথ হিসেবে আকড়ে ধরেছিলেন।
বীর উত্তম কর্ণেল আবু তাহেরের সহযোগী হয়েছিলেন। চেয়েছিলেন শোষককে পরাজিত করে নতুন সমাজ নির্মাণ করার। তার শোবার ঘরে সবসময় শোভা পেত চে-গুয়েভারা. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং বীর উত্তম তাহেরের ছবি।
এখানেই শেষ নয়, ব্যক্তি মেজর (অব.) জিয়া ছিলেন এক অন্যরকম মানুষ। বিরাট এক অন্তর ছিল তার। প্রতিটি মানুষকেই ভালোবেসে, শ্রদ্ধায় বুকের গভীরে ঠাঁই দিতে পারতেন। শ্রমিক, কৃষক, মৎস্যজীবী সবাইকেই আপন করে বুকে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জায়গাটাই ছিল দৃঢ়। সিপাহী জনতার অভূত্থানের নায়ক বীর উত্তম তাহেরের মৃত্যুদন্ডকে হত্যাকান্ড বলে হাইকোর্ট যে ঐতিহাসিক রায় দেয় সেই মামলার অন্যতম রিটকারীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। ২০১০ সালের ২১ আগস্ট তিনি আদালতে রিটটি করেছিলেন। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন তিনি।
দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন তার বিশ্বাস এবং অবস্থান থেকে কখনই কক্ষচ্যুত হননি। তিনি মনে করতেন মুক্তিযুদ্ধে সমাজের বিভিন্ন ধরনের সাধারণ মানুষের অবদান ও আত্মত্যাগ সবচাইতে বেশি। ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার অভূত্থানের ঘটনাকে নানা মিথ্যাচারে কালিমালিপ্ত করা হলেও বীর উত্তম তাহেরের সমাজ বিপ্লব আকাঙ্খার সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে গেছেন মৃত্য অব্দি। নির্মোহভাবে ব্যাখা করেছেন সেই সময়ের ঘটনাবলী, জিয়াউর রহমানের ঘৃণ্য সিদ্ধান্তসমূহ। সর্বত্র জামাতিকরণের বিরুদ্ধেও তিনি সবসময় সোচ্চার থেকেছেন।
বহুবিধ কারণেই মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন ছিলেন এক আলোচিত মানুষ। সাধারণ্যে মুক্তিযোদ্ধা জিয়া, জাসদ জিয়া, সুন্দরবনের জিয়া, টাইগার জিয়া হিসেবেই তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মতো ভারি কণ্ঠস্বর ছিল তাঁর। গুছিয়ে কথা বলতেন। কথায় ক্লাসিক্যাল আমেজ ঝরে পড়তো। কবি নজরুলের মতো বাবরি দুলানো চুল তাঁকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দিত। আড্ডায় আলাপনে কবিতা আবৃত্তি করতেন। বলতে দ্বিধা নেই সক্রিয় রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে থেকেও মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন অন্যরকম এক আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। আবারও বলি প্রথাগত অনেককিছুই তিনি বিশ্বাস করতেন না। সমাজ পরিবর্তনের কথা তিনি সবসময়ই ভাবতেন।
৭৬ সালের ১৭ জুলাই বীর উত্তম তাহেরের ফাঁসির রায় হলে কারাগারে নিজ সেলে বসে বীর উত্তম তাহেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছিলেন-জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে/ কাঁপিয়ে দিলাম/ জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙব বলে/ ভেঙে দিলাম/ জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করবে বলে/ করেই গেলাম/ জন্ম আর মৃত্যুর দুটি বিশাল পাথর/ রেখে গেলাম/ পাথরের নিছে শোষক আর শাসকের/ কবর দিলাম/ পৃথিবী – অবশেষে এবারের মত বিদায় নিলাম। এখনও এই কবিতার লাইনগুলো ভেসে বেড়ায়।
মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন অনন্তলোকে। সত্যিই এক নক্ষত্র বিদায় নিল আমাদের মাঝ থেকে। চলে গেলেন এক সাহসী মানুষ। যখন সাহসী মানুষের সংখ্যা কমে আসছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)